এক সময় নিজেকে শেষ করে দিতে চাইত শতদ্রু। এখন করছে সৃষ্টি।
মুখে বোল ফোটে না। কানে বাইরের শব্দ পৌঁছয় না। বছর কুড়ির ওই তরুণ ডাক্তারি পরিভাষায় ‘সেরিব্রল পালসিতে’ আক্রান্ত। আজন্ম প্রকৃতির এই বিরূপতার সঙ্গেই সে যুঝে চলেছে। এক দিকে পরিবার, আর অন্য দিকে তার প্রতিষ্ঠানের লাগাতার চেষ্টায় এখন শতদ্রু রীতিমতো রোজগেরে। আয়রন ফেব্রিকেশনের (লোহার উপরে চিত্রকর্ম) কাজ নিয়েছে সে একটি সংস্থায়। আর সেই সুবাদেই রাজ্য সরকার তাকে ‘রোল মডেল’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। আজ, মঙ্গলবার বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে রাজ্যপাল আর কে নারায়ণন তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন।
কী ভাবে সম্ভব হল এই অসম্ভবকে জয় করার দৌড়?
এক-আধ দিন নয়, টানা দুই দশক এই লড়াই জারি রয়েছে। চিকিৎসক সৌরভ সান্যাল বলেন, “এই রোগীদের লড়াইয়ে প্রথম দিককার দিনগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময়ে হতাশায় নিজেদেরই ওরা শেষ. করে ফেলতে চায়। কিন্তু যত্ন আর পরিচর্যা পেলে ওরাও যে ফুল ফোটাতে পারে, শতদ্রু মিত্র তার বড় প্রমাণ।”
উত্তরপাড়ার ভদ্রকালীর ‘আশ্রয়’ স্কুলেই শতদ্রু বেড়ে ওঠে। তিন বছর বয়স থেকে এ পর্যন্ত এখনও ওই স্কুলের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে সে। খুব ছোট বয়সে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণেই হতাশা তাঁকে পেয়ে বসত। কোনও কোনও সময়ে নিজেকে শেষ করে ফেলতেও উদ্যত হত সে। ওই স্কুলেরই শিক্ষক তরুণ দাশগুপ্ত বলেন, “ওর আচরণে নানা সমস্যা (পরিভাষায়, বিহেভিয়াল প্রবলেম) ছিল। এক বার তো কাচের গ্লাস থেকে রক্তপাত হয়ে মারাত্মক শারীরিক সমস্যা হয়েছিল ওর। প্রায়ই এই ধরনর ঘটনা ঘটিয়ে ফেলত। ভালবাসা আর যত্নে শতদ্রুকে এই জায়গায় পৌছে দিতে পেরে আমরা সকলেও রীতিমতো তৃপ্ত।”
শুধুমাত্র স্কুল নয়, পরিবারেরও এই দুই দশক জুড়ে ছিল লম্বা দৌড়। সর্বাণী আর সুকুমার মিত্রের এক মাত্র সন্তান শতদ্রু। মাত্র সাড়ে পাঁচ মাসেই সে ভূমিষ্ঠ হয়। প্রাথমিক ভাবে ছেলেকে যে প্রাণে বাঁচানো যাবে, সেটুকু ভরসা ছিল না মিত্র দম্পতির। টানা চিকিৎসায় তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়। যখন একটু একটু করে ভরসা পাচ্ছিলেন ছেলের সুস্থতা নিয়ে, তখন দেখা গেল অন্য সমস্যা। আর পাঁচটা স্বাভাবিক শিশু যেমন এক পা-দু’ পা করে হাঁটছে, মুখে বোল ফুটছে তখন বেবাক চুপচাপ শতদ্রু। ফের চিকিৎসকদের দরজায়-দরজায় ফেরা শুরু হয় তার অভিভাবকদের। এক সময় চিকিৎসকরাই নিশ্চিত করেন, কোনও দিনই কথা বলতে পারবে না সে। কানেও শুনতে পাবে না। কিছুটা বয়স বাড়তেই এই জাতীয় শিশুদের বিশেষ স্কুল ‘আশ্রয়’-এ ভর্তি করানো হয় তাকে। সুকুমারবাবু বলেন, “ছেলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। চিকিৎসকরাই পরামর্শ দেন, হাতের কিছু কাজ শিখলে ছেলের ভাল হবে। সেই পরামর্শেই একটি সংস্থায় আয়রন ফেব্রিকেশনের কাজ করছে ছেলে। শুধু কাজ করা নয়, রোজগারও করছে। রাজ্য সরকার এই স্বীকৃতি দেওয়ায় আমরা অভিভূত।” উত্তরপাড়ার গণ্ডী ছাড়িয়ে রাজ্যের ‘রোল মডেল’ শতদ্রুকে এখন কুর্নিশ জানাচ্ছে তার মতোই আরও অনেকে। |