প্রবন্ধ ২...
শেষ পর্যন্ত এটা তো একটা মেয়ের গল্প
মেয়েটাকে আপনি চেনেন। রোজই ওর কথা পড়েন কোথাও না কোথাও। রাস্তাঘাটে, অফিসে, স্কুল-কলেজে ও যেখানেই যায়, সহযাত্রী, সহকর্মী কিংবা উঁচুতলার ‘বস’, সকলের হাতে কী ভাবে রোজ রোজ ওর মেয়েবেলার পাওনা মেটে, সে খবর আপনার জানা। তবে আপনি কল্পনাই করতে পারেন না যে, এমন খবরের পেছনে কখনও আপনার বোন কি মেয়ের মুখও বসতেই পারে। তাই ওদের গল্পগুলো আপনি হয়তো মন দিয়ে শোনেনই না। ঘটনাগুলো যখন আপনার আশেপাশেই ঘটে, তখনও আপনি কিছুটা গা বাঁচিয়েই চলেন। আর ঠিক সেই জন্যই আপনি জানতেই পারেন না, কোন কোন দিক থেকে উৎপাত শুরু হতে পারে আপনার পরিবারের মেয়েটির ওপরেও।
তবে যে গল্পটা আমি এখন বলব, সেটা কারও খুব একটা পরিচিত নয়। আপনার মেধাবী মেয়েটি যখন স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করে পিএইচ ডি করতে যাবে ঝকঝকে একটা রিসার্চ ইনস্টিটিউটে, তখন ওর সঙ্গে সঙ্গে আপনিও স্বপ্ন দেখবেন ও খুব ভাল কাজ করবে, ভাল ভাল ‘পেপার’ হবে, নিজের কাজের সূত্রেই দেশ-বিদেশে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হবে। আপনি ভাবতেই পারবেন না, গাছপালা-ঘেরা যে বাড়িগুলোর দিকে সাধারণ লোকে সম্ভ্রমের নজরে তাকায়, যেখানে গড়পড়তা প্রতিটি লোকই উচ্চশিক্ষিত, সেখানেও আপনার মেয়েকে শেষ পর্যন্ত একটা ‘মেয়ে’ হিসেবেই দেখা হতে পারে। আর, কেবল নিজের কাজটুকু ঠিক ভাবে করতে গেলেও অনেক কিছুর সঙ্গে ‘সমঝোতা’ করতে হতে পারে।
সে দিন যখন তরুণ তেজপাল সহকর্মীকে যৌন হেনস্থার অভিযোগে গ্রেফতার হচ্ছেন, তার কিছু দিন আগে এই রকম একটি মেয়ে পরিস্থিতির চাপে তার অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিল তার রিসার্চ গাইডের উপর থেকে। একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে গবেষক বা ‘রিসার্চ ফেলো’ হিসেবে কাজ শুরু করার পর থেকেই মেয়েটি তার গাইডের কাছ থেকে নানা ধরনের অশোভন আচরণ, কুৎসিত মন্তব্য, ইঙ্গিত পেত। ভেবেছিল, এ সব অগ্রাহ্য করে নিজের কাজটুকু করে চলবে মন দিয়ে, সেই ভাবে কাটিয়েও দিয়েছিল কয়েক বছর। কিন্তু পরিস্থিতি দিন দিন এমন ঘোরালো হয়ে উঠল যে মেয়েটির কাজে যাওয়াই বন্ধ হবার উপক্রম। শেষ পর্যন্ত মেয়েটি বাধ্য হয়েই কিছু তথ্যপ্রমাণ সমেত লিখিত অভিযোগ জমা দেয় তার প্রতিষ্ঠানের ‘উইমেন্স গ্রিভান্স সেল’-এর কাছে। ও ভেবেছিল, এ রকম একটা অভিযোগ জমা পড়লেই কর্তৃপক্ষ চটপট ব্যবস্থা নিয়ে ফেলবেন, বিশেষ করে যেখানে অভিযোগটা এত বছর ধরে হেনস্থা করার। কিন্তু ঘটনাটা ঘটল অন্য রকম, আসল খেলাটা শুরু হল তার পর।
মহিলা কমিশনের প্রতিনিধি ওকে প্রথম প্রশ্ন করলেন যে, ও অভিযোগটা এত দিন পরে কেন করল? কেন এক মাস বা এক বছর পরে করেনি? প্রথমেই ও কেন ওই গাইড বা ওই ল্যাবরেটরি ছেড়ে দিল না, কীসের আশায় এত দিন সহ্য করে গেল এই অবাঞ্ছিত আচরণ? যাঁরা গবেষণার সঙ্গে যুক্ত আছেন, তাঁরা জানেন, এক জন ফেলোর পক্ষে গাইড বদলানোটা মোবাইল ফোন বদলানোর মতো সহজ কাজ নয়। এতে শুধু যে ছাত্রের অমূল্য সময় নষ্ট হয় না, ফেলোশিপ জোগাড় করারও সমস্যা হয়। এক প্রতিষ্ঠানের ফেলোশিপ নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করা যায় না, আবার একই প্রতিষ্ঠানে এক জনের কাছ থেকে ছেড়ে অন্য কারও কাছে কাজ করতে গেলেও কৈফিয়ত দিতে হয়।
এই সব কিছু জেনেও এক জন মহিলা বিজ্ঞানী মেয়েটিকে এই প্রশ্নই করলেন, যার মধ্যে একটা ইঙ্গিত লুকিয়ে থাকল যে, সে এই অসভ্যতা সহ্য করেছে কিছুর আশায়। ছোটবেলা থেকে মেয়েদের তো এটাই শেখানো হয় যে, ঘরে-বাইরে পুরুষের অশোভন আচরণের কথা চেপে যাও, পারলে নিজের রাস্তা বদলে নাও। এই সব কথা নিয়ে বেশি গোলমাল করলে তোমারই গায়ে কাদা লাগবে। সেই ধারণার জোরে এই মেয়েটাও ভেবেছিল, নিজে ঠিক থাকলে অন্য লোকে কী আর করবে, দু’চার বার বলবে, তার পর হাল ছেড়ে দেবে। আর গাইডের হাতে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ থাকে বলে পিএইচ ডি করার সময় বা ভবিষ্যতে গবেষণা চালিয়ে যেতে হলেও গাইডের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক থাকাটা বেশ জরুরি।
কিন্তু একটা সময়ের পর প্রত্যেক মানুষই ভাবে, এ বার ঘুরে দাঁড়ানোই ভাল। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে ‘আমি এই আচরণ সহ্য করছি কেন, তা হলে কি আমি সত্যিই এমন কিছু পাচ্ছি, যা আমার পাওয়ার কথা নয়!’ তবে পেশাদার জীবনের বড়বেলাতে এসেও এই মেয়েটিকে ঘুরিয়ে সেই ছোটবেলার কথাই বলা হল। এক জন মেয়ে কত দিন পরে অভিযোগ জানাচ্ছে তা অভিযুক্তের অপরাধের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল।
এর পর অন্য সব জায়গায় যা হয়, এখানেও ঠিক তা-ই হতে লাগল। মেয়েটিকে নানা ভাবে বোঝানো হল যে, এ নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া হলে তাকে কী কী অসুবিধায় পড়তে হতে পারে। তখনও ‘বিশাখা’ নির্দেশিকার শাখাপ্রশাখাগুলো এমন মুখে-মুখে ঘোরেনি, তাই কিছুটা ভুল বোঝানোও সম্ভব হয়েছিল। এক জন রিসার্চ ফেলোকে যে যে-কোনও সময়ে অন্য ল্যাবরেটরিতে ‘বদলি’ করে দেওয়া যায় না, সে কথা জেনেও মেয়েটিকেই বলা হল বাকি দিনগুলো অন্য ল্যাবে কাজ করতে। মোটের ওপর যাবতীয় ‘সমঝোতা’ মেয়েটিকেই করতে বলা হল, আর এই কোনও কথাবার্তাই নথিভুক্ত করা হল না, যাতে নাকি ‘মেয়েটি অসুবিধেয় না পড়ে’। অর্থাৎ, এই অভিযোগ এবং তার আগের এই দীর্ঘমেয়াদি অন্যায়ের কোথাও কোনও চিহ্ন থাকল না, যা ওই অভিযুক্ত ব্যক্তিটির ভবিষ্যতের উন্নতিতে কোথাও বিন্দুমাত্র ছাপ ফেলতে পারে।
এই রকম একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে নানা জনের প্রতিক্রিয়া থেকে যে-ছবিটা ফুটে ওঠে, সেটাই সবচেয়ে হতাশাজনক। মেয়েটার সমর্থনে দাঁড়ালেন হাতে গোনা কয়েক জন। বয়ঃক্রম নির্বিশেষে বিজ্ঞানীরা কেউ বললেন, মেয়েটা সুবিধাবাদী, যত দিন সুবিধে নিয়েছে চুপচাপ থেকেছে, এখন নিশ্চয়ই সমঝোতায় কিছু গোলমাল হয়েছে, তাই মুখ খুলছে। তাঁদের কেউ প্রশ্ন করল না যে, এক জন রিসার্চ ফেলো তার গাইডের কাছ থেকে ঠিক কী কী সুবিধে নিতে পারে, যা তার পাওয়ার কথা নয়? আর নিজের ফেলোর সঙ্গে এই রকম কিছু ‘পাইয়ে দেওয়ার’ সম্পর্ক তৈরি করাটাই যে এক জন বিজ্ঞানীর পক্ষে নীতিবিরোধী কাজ, তার শাস্তি কে পাবে? কেউ এমনও বলেছেন যে, ‘শারীরিক ভাবে কিছু করেনি’, যেন মেয়েটার শারীরিক নিগ্রহ পর্যন্ত অপেক্ষা করাই উচিত ছিল। আর যাঁরা বলছেন, ‘এই রকম হলে কোনও প্রতিষ্ঠান তো ‘মেয়ে ফেলো’ নিতেই চাইবে না’, তাঁদের কেউ মনে করিয়ে দিচ্ছে না যে, বিশেষ কোনও কারণ না থাকলে ‘মেয়ে’ ‘না নেওয়ার’ অধিকার কারও নেই। বরং তাকে নিরাপত্তা দেওয়াই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। মেয়েদের কাজে নিতে ভয় না পেয়ে বরং মেয়েদের গায়ে হাত দিতে ভয় পাওয়ার সংস্কৃতিটা তৈরি করুন, আখেরে আপনার মেয়েরও কল্যাণ হবে। একটা মেয়ের কাজকর্ম-সাফল্য আর মানসম্মান পরস্পরের বিপ্রতীপ কোণে দাঁড়াবে, বা সে কোনও অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে তাকেই অভিযুক্ত হতে হবে সে বড় সুখের কথা নয়।
যে মানুষগুলো নিজেরা এ রকম কাজ করেন না, আপাতদৃষ্টিতে এই রকম কাজকে সমর্থনও করেন না, নিজের গণ্ডির মধ্যে এই সংকটকালে তাঁরাও অপরাধীকেই বাঁচাতে চান দেখে বিস্মিত হতে গিয়েও আমরা থমকে যাই। খেয়াল হয় যে, এই রকমটাই হওয়ার কথা ছিল। পুরুষতন্ত্র আর ক্ষমতাতন্ত্র এক হয়ে গেলে তা যে পুরুষকেই রক্ষা করবে, এটাই স্বাভাবিক। দিল্লি, কামদুনি, গোয়া, সব পেরিয়ে আসলে এ তো একটা মেয়ের গল্প। রিসার্চ ফেলো হোক, বা যা-হোক একটা মেয়ের গল্প তো বটে!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.