প্রবন্ধ ১...
হইচই করলেই শিশুমৃত্যু কমবে না
শিশুমৃত্যু আজকাল প্রায়শই সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে। যে কোনও পরিবারের কাছে শিশুমৃত্যু মর্মান্তিক ও অসীম দুঃখজনক। তাই বহু পথ অতিক্রম করে, কষ্টসাধ্য ব্যয়ের পর হাসপাতালে পৌঁছে শিশুমৃত্যু হলে কোনও পরিবারই তা স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারে না। অশিক্ষা ও আক্ষেপের আবহে এই মর্মন্তুদ ঘটনার প্রতিফলন ঘটে হাসপাতালের সম্পত্তি ভাঙচুর ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিগ্রহে। ফলত, তা দ্রুত উঠে আসে খবরের কাগজে, টিভির পর্দায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, একটি শিশুর মৃত্যু কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সমাজের জনস্বাস্থ্যের সার্বিক চিত্রটি এবং সরকারের বৃহত্তর স্বাস্থ্যনীতির প্রেক্ষাপট।
গত বছর অক্টোবর মাসে প্রকাশিত শেষ স্যাম্পল রেজিস্ট্রেশন সার্ভে (এস আর এস) অনুযায়ী ২০১০ সালের শিশুমৃত্যুর হার (ইনফ্যান্ট মর্টালিটি রেট) এ রাজ্যে ৩২, যেখানে ভারতের গড় সংখ্যা হল ৫৪। (যত জীবিত শিশু ভূমিষ্ঠ হয়, তাদের মধ্যে এক বছরের জন্মদিনের আগে যত জন মারা যায়, শিশুমৃত্যুর হার বলতে সে অনুপাতই বোঝায়; তবে এ ক্ষেত্রে অনুপাতটা কষা হয় শতকরা হিসেবে নয়, হাজার প্রতি। যেমন ধরা যাক, কোনও একটি সময়কালে এক লক্ষ জীবিত শিশুর জন্ম হল এবং তাদের মধ্যে পাঁচ হাজার শিশু এক বছর বয়স হওয়ার আগে মারা গেল; তা হলে শিশুমৃত্যুর হার হবে ৫০।) শিশুমৃত্যুর হার অনুযায়ী সাজালে যে রাজ্য যত নীচে থাকবে, স্পষ্টতই তার ফল তত ভাল। সেই হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে চতুর্থ স্থানে। কিন্তু ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১০ সালে এ রাজ্যে শিশুমৃত্যুর হার বেড়েছে এক পয়েন্ট, যেটা রীতিমত আশঙ্কাজনক।
শিশুমৃত্যুকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়: নবজাতক মৃত্যু (নিয়োনেটাল মর্টালিটি) আর নবজাতক-পরবর্তী মৃত্যু (পোস্ট নিয়োনেটাল মর্টালিটি)। জন্মের প্রথম এক মাসের মধ্যে মৃত্যু হলে তাকে বলা হয় নবজাতক মৃত্যু। আর দ্বিতীয় থেকে দ্বাদশ মাসের মধ্যে মৃত্যু হলে বলে নবজাতক পরবর্তী মৃত্যু। যে কোনও দেশে নবজাতক মৃত্যুর হারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সাধারণ জনস্বাস্থ্য ও কিছু জন্মকালীন ত্রুটির বিষয়। মায়ের অপুষ্টি, গর্ভকালীন সময়ে মায়ের স্বাস্থ্য পরিষেবা (অ্যান্টিনেটাল কেয়ার), প্রসবকালীন পরিষেবা এবং প্রসব-পরবর্তী মা ও শিশুর স্বাস্থ্য পরিচর্যা (পোস্টনেটাল কেয়ার) ইত্যাদি বিষয়গুলি নবজাতক মৃত্যুর সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। উন্নয়নের সঙ্গে জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত এই পরিষেবাগুলির উন্নতি হয় ঠিকই, কিন্তু চিকিৎসা সম্পর্কিত পরিষেবার তুলনায় ধীর গতিতে। আবার জন্মকালীন ত্রুটি (কনজেনিটাল ডিফেক্ট্স) সহ জন্মানোর ফলে শিশুর মৃত্যুর ঘটনা খুব একটা কমানো প্রায় অসম্ভব। অন্য দিকে, চিকিৎসা ব্যবস্থার দ্রুত উন্নতির সঙ্গে কমতে থাকে নবজাতক পরবর্তী মৃত্যুর হার। ফলত, উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণত শিশুমৃত্যুর (জন্মের এক বছরের মধ্যে) মধ্যে নবজাতক মৃত্যুর (জন্মের এক মাসের মধ্যে) অনুপাত বাড়তে থাকে। তাই ধনী দেশগুলিতে এই অনুপাত ৬০ শতাংশ (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু-এর ২০১০-এর তথ্য অনুযায়ী) এবং আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলিতে ৪৯ শতাংশ।
কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার হল, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে এই অনুপাত পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক (৬৭ শতাংশ) এবং ভারতের ক্ষেত্রে এই ভাগ ৭০ শতাংশ। আরও আশ্চর্যের ঘটনা হল, পশ্চিমবঙ্গে এই ভাগ ৭৪ শতাংশ! তা হলে কি বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গ শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে পৃথিবীর ধনী দেশগুলির থেকেও উন্নতি করেছে, যার ফলে নবজাতক শিশুর মৃত্যুই শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে?
যদি এ প্রশ্নের উত্তরে দ্ব্যর্থহীন ভাবে হ্যাঁ বলতে পারতাম, তা হলে এ রাজ্যের নাগরিক হিসেবে আত্মপ্রসাদ অনুভব করতাম। কিন্তু তেমন সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর আগে আরও কয়েকটি তথ্য পাঠককে জানানো প্রয়োজন। প্রথমত, ধনী দেশগুলির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নবজাতক মৃত্যুর প্রধান কারণ জন্মকালীন ত্রুটি এবং নির্ধারিত সময়ের পূর্বে প্রসব। অন্য দিকে, ভারতে নবজাতক মৃত্যুর প্রধান কারণগুলি হল, সংক্রমণ, অপুষ্টি, প্রসবকালীন শ্বাসরোধ ইত্যাদি। অর্থাৎ এ দেশে নবজাতকের মৃত্যুর অনুপাত বাড়ার মূল কারণ হল সাধারণ জনস্বাস্থ্যের সম্পূর্ণ অবহেলা, প্রসূতি অবস্থায় স্বাস্থ্য পরিষেবার অপ্রতুলতা এবং প্রসব পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রায় কোনও সাহায্য না পাওয়া। তাই এখানে শিশুমৃত্যুতে নবজাতক মৃত্যুর ভাগ কমানোটা খুব জরুরি।
দ্বিতীয়ত, নবজাতক মৃত্যুর হার কী গতিতে কমছে, তার হিসেব যদি দেখি, তা হলে দেখব ভারতে ২০০৩-২০০৮ সালের মধ্যে তা কমেছে বছরে গড়ে মাত্র ০.২ শতাংশ, যেখানে ১৯৯৮-২০০২ সালের মধ্যে এই হার ছিল বার্ষিক এক শতাংশ। অথচ ২০০৩-২০০৮ সময়কালটিতে জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন (ন্যাশনাল রুরাল হেল্থ মিশন) কার্যকর হয়, যার প্রধান লক্ষ্য ছিল প্রসূতি ও শিশুর চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করা। বস্তুত, এই সময়ে গর্ভকালীন পরিষেবা ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব সত্যিই উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আরও একটা আশঙ্কার কারণ হল সদ্য-নবজাতক মৃত্যুর হার (আরলি নিয়োনেটাল মর্টালিটি রেট)-এর গতিপ্রকৃতি। হাজারে কত জন শিশু প্রথম সাত দিনের মধ্যে মারা যায়, এটি তারই অনুপাত। মিশন-পরবর্তী সময়পর্বটিতে এই হার বেড়েছে ভারতে বছরে গড়ে ০.৮ শতাংশ হারে। এ রাজ্যে এই বৃদ্ধির হার কিছুটা কমলেও বর্তমানে তা প্রাক্-মিশন অবস্থা থেকে খুব বেশি দূরে নেই।
সুতরাং এ কথা অনস্বীর্কায যে প্রাতিষ্ঠানিক স্বাস্থ্য পরিষেবা গ্রহণের হার বহু গুণ বৃদ্ধি পেলেও শিশুমৃত্যু ও নবজাতক মৃত্যুর হার যথেষ্ট কমানো যাচ্ছে না; আর তাই ‘মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল’-এ শিশুমৃত্যুর লক্ষ্য এখনও ভারতের কাছে অধরা। তা হলে কী করণীয়?
প্রথমত, মা অপুষ্ট হলে, সন্তান অপুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বহু গুণ বৃদ্ধি পায়, তার সঙ্গে বাড়ে সদ্য-নবজাতক মৃত্যুর সম্ভাবনা। আর মায়ের অপুষ্টি কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় পরিষেবা কোনও মতেই স্বাস্থ্য দফতরের কাজের মধ্যে পড়ে না। এর জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৭২ সাল থেকে চালাচ্ছে সুসংহত শিশু বিকাশ কর্মসূচি (ইন্টিগ্রেটেড চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট স্কিম বা আই সি ডি এস) যা বিভিন্ন শহর ও গ্রামে ছ’বছরের কম বয়সি শিশু, গর্ভিণী ও প্রসূতি মাকে এক বেলার সুষম খাদ্য প্রদান করে। এই কর্মসূচি চালায় প্রতিটি রাজ্যের নারী ও শিশু কল্যাণ দফতর। এই দফতরের অধীনে রাজ্য জুড়ে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিতে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী সকালে বা দুপুরে কিছু খাবার দেন, যা রান্না করা খাবার (যেমন খিচুড়ি, ডিমের ঝোল-ভাত) হতে পারে বা হতে পারে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার রেশন (চিঁড়ে, ছাতু বা চাল)। সঙ্গে দেওয়ার কথা ৩-৬ বছরের শিশুদের প্রাক্-বিদ্যালয় শিক্ষা, ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জ্ঞান। দীর্ঘ দিন ধরে চলা এই ব্যবস্থা ভারতের প্রায় ৮৯ শতাংশ অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। এ রাজ্যে এই ব্যাপ্তি ৮৮ শতাংশ। তামিলনাড়ু ও ত্রিপুরাতে এর ব্যাপ্তি যথাক্রমে ৯৭ ও ১০০ শতাংশ।
গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েরা এই ব্যবস্থা থেকে কতটা উপকৃত হন? ভারতে যে সমস্ত অঞ্চলে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র আছে, সেখানে মোট গর্ভবতী মায়েদের ২০.৫ শতাংশ সেই কেন্দ্রে গিয়ে কোনও পরিপূরক খাবার গ্রহণ করেন। পশ্চিমবঙ্গে অনুপাতটি প্রায় ২৫ শতাংশ। এ ঘটনায় খুশি হওয়ার খুব কারণ নেই, যখন দেখি যে তামিলনাড়ুতে অর্ধেকের বেশি মা এই খাবার নেন। ওড়িশার ক্ষেত্রেও অবস্থা যথেষ্ট ভাল। প্রসূতি মায়েদের মধ্যে এই খাবার নেওয়ার প্রবণতা আরও কম। অথচ একই সূত্র অনুসারে, সামগ্রিক ভাবে মেয়েদের মধ্যে ভারত, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ও তামিলনাড়ুতে যথাক্রমে ৩৫, ৩৯, ৪১ এবং ২৮ শতাংশ ক্ষীণ ও অপুষ্ট।
আর একটা তথ্য লক্ষণীয়। মোট মায়েদের মাত্র ৯ শতাংশ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে এসে স্বাস্থ্যচেতনার পাঠ পান। মনে রাখা দরকার,অপুষ্টি শুধু দিনের একটি খাবারের উপর নির্ভর করে না। মা সারা দিন বাড়িতে কতটা সুষম আহার খাচ্ছেন বা শিশুকে দিচ্ছেন, সেটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দামি দামি খাবার খেতে হবে, তা নয়, বরং সস্তার কোন খাবার খেলে কতটা পুষ্টি হতে পারে, তা মায়েদের জানানো খুবই দরকার। শুধু তা-ই নয়, সেই খাবার গ্রহণের ঠিক পদ্ধতি জানানোও একান্ত আবশ্যক। খুব সাধারণ একটা উদাহরণ দিই। দুধ ফোটালে তার ভিটামিন কমে যায়, আর তা আবার বাড়াতে পরিপূরক (নিউট্রিয়েন্ট) ওই দুধে গোলা দরকার এ কথা জানিয়ে দিয়ে পরিপূরক পানীয়ের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়। কিন্তু এই কথাটা এ দেশে মায়েদের শেখানো হয় না, যে পাস্তুরাইজ্ড দুধ ফোটানোর কোনও প্রয়োজন নেই। তাই মায়েরা শিশুদের বাইরের দুধ দেওয়ার আগে অনবরত ফুটিয়ে খাদ্যগুণ ধ্বংস করেন! সমীক্ষায় দেখা যায়, মায়ের প্রথাগত বিদ্যা নয়, সাধারণ সচেতনতাই শিশু স্বাস্থ্যের মূল উৎস। (চলবে)

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.