‘রিসোর্স রুম’ অন্ধকারে, পথ দেখাচ্ছেন হিরুরাই
ছ’ বছরের অঞ্জলি জন্ম থেকেই অন্ধ। দুবরাজপুরের রাজগঞ্জের এক আদিবাসী পরিবারের ওই মেয়ে এখন গ্রামেরই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। আবার ‘ব্লাইন্ড স্টিক’ নিয়ে কারও সাহায্য ছাড়াই দু’ পা হেঁটে স্কুলে যেতে শিখেছে হাজরাপুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী হালিমা খাতুনও। অঞ্জলির মতোই ১৩ বছরের ওই কিশোরীও জন্মান্ধ। দু’ জনেরই মতো স্কুলে পড়াশোনা করে বাবা-মাকে ভরসা জোগাচ্ছে সূর্য মণ্ডল। রাওতাড়া গ্রামের সাত বছরের ওই শিশু ৮০ শতাংশ মানসিক প্রতিবন্ধী। তিন জনেরই পরিবার কোনও দিন কল্পনা করেনি, তাঁদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে আর পাঁচটা শিশুর সঙ্গে মিলে পড়াশোনা করবে। আর যাঁর জন্য এমনটা সম্ভব হয়েছে, তিনি শেখ হিরু। দুবরাজপুরের জামথলিয়া গ্রামের ওই বাসিন্দা এলাকায় সর্বশিক্ষা মিশনের ‘কি রিসোর্স পার্সন’।
এক প্রতিবন্ধীর সঙ্গে শেখ হিরু। — নিজস্ব চিত্র।
জেলা সর্বশিক্ষা মিশন দফতর সূত্রে খবর, কয়েক বছর আগে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়ের অভিভাবকদের জন্য চালু হয়েছিল ‘কি রিসোর্স পার্সন’ হওয়ার প্রশিক্ষণ। আবেদন করার শর্ত ছিল ন্যূনতম মাধ্যমিক উত্তীর্ণ। বীরভূমে প্রতিটি পঞ্চায়েত এলাকায় এক জন করে অভিভাবক ওই প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। সাময়িক ভাবে ছ’ মাসের জন্য তাঁরা কিছু টাকা ভাতাও পেয়েছিলেন। জানা গিয়েছে, বর্তমানে ১৬৭টি পঞ্চায়েত এলাকার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিভাবকদের মধ্যে মাত্র ৩-৪ জনই ‘কি রিসোর্স পার্সন’ হিসেবে কাজ করে চলেছেন। শেখ হিরু তাঁদেরই অন্যতম। তাঁরই বিশেষ উদ্যোগে দুবরাজপুর ব্লক এলাকার বহু প্রতিবন্ধী শিশু স্কুলে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছে। ওই সব শিশুদের স্কুলে ভর্তি করতে উৎসাহিত করা, তাদের চিকিৎসা কোথায় কী ভাবে হবে, শংসাপত্র কী ভাবে মিলবে, স্কুলে তারা ঠিক কী কী সুবিধা পেতে পারে, খেলাধুলার ক্ষেত্রেই বা ওই ছেলেমেয়েরা কী করতে পারে এমন গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য ও পরামর্শ ওই ‘কি রিসোর্স পার্সন’-এর কাছ থেকে পেয়ে উপকৃত হয়েছেন তাদের বাবা-মায়েরা।
স্থানীয় ও প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, শেখ হিরুর মতো ব্যক্তির প্রচেষ্টায় শুধু মাত্র দুবরাজপুরের পারুলিয়া পঞ্চায়েত এলাকাতেই এমন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ৯৭ জন ছাত্রছাত্রী স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু স্কুলে ভর্তি হলেই কাজ শেষ হয় না। ওই সব শিশুর জন্য স্কুলে বিশেষ প্রশিক্ষকের থাকা প্রয়োজনা। বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে ওই সব ছাত্রছাত্রী এবং সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তৈরি হওয়া দূরত্ব কাটিয়ে দিতে হবে। আর তার জন্য ‘সর্বশিক্ষা মিশন’ ‘স্পেশ্যাল এডুকেটর’ নিয়োগ করেছে। জেলায় ১৬৭টি ‘রিসোর্স রুম’ (যেখানে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করবেন এক জন স্পেশ্যাল এডুকেটর) থাকলেও চালু আছে মাত্র ৫৪টি। শেখ হিরুদের অভিযোগ, প্রয়োজনের তুলনায় এই জেলায় ‘স্পেশ্যাল এডুকেটর’ কম থাকা এবং অধিকাংশ ‘রিসোর্স রুম’ সক্রিয় না থাকায় ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে পড়াশোনার চালিয়ে যাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে শেখ হিরু বলছেন, “ওই ছেলেমেয়েরাও তো নিজেদের প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে তোলার জন্য সব রকমের চেষ্টা চালাচ্ছে। আমাদেরও সীমিত ক্ষমতার মধ্যেও যতটুকু বেশি করা যায়, সেই কাজটাই করে যেতে হবে।”
শেখ হিরুর এই আত্মবিশ্বাসী-ই ওই সব প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের বাবা-মায়েকে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছেন। তা স্বীকারও করছেন অঞ্জলির মা রাসমণি মাড্ডি, হালিমার মা জয়িফাবিবি কিংবা সূর্যর বাবা রাজকুমার মণ্ডলরা। একই ভাবে সক্রিয় এই ‘কি রিসোর্স পার্সনে’র প্রশংসা করে সর্বশিক্ষা মিশনের জেলা সমন্বায়কের দায়িত্বে থাকা শুকদেব চক্রবর্তী বলছেন, “যে ভাবে তিনি দিনের পর দিন স্বার্থহীন ভাবে আমাদের সাহায্য করে চলেছেন, তা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য।” দুই প্রতিবন্ধী ছেলে আইয়াস আর আব্বাসকে তিনি প্যারা অলিম্পিকে পাঠিয়েছেন। নিজে সিকিমে গিয়ে প্যারা অলিম্পিকের একটি ইভেন্টের প্রশিক্ষকের প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। পেশায় আমিন শেখ হিরু নিজে জানাচ্ছেন, স্কুলগুলি নিজে থেকে যদি একটু সচেতন হয়, তা হলেই অনেক বাধা আপনা থেকেই সরে যায়। একটি ক্ষীণদৃষ্টি সম্পন্ন ছাত্র বা ছাত্রীর জন্য স্কুল ঠিক কী করতে পারে? তাঁর কথায়, সবার আগে শিশুটিকে প্রথম বেঞ্চে বসার সুযোগ দিতে হবে। এর ফলে তার দেখতে সুবিধা হবে। কিন্তু তাতেও যদি অসুবিধা দূর না হয়, তা হলে তাকে জানালার ধারে বসাতে হবে। ক্লাসরুমের দেওয়ালের রং সাদা রাখাটাই শ্রেয়। ডেস্কের উচ্চতা কমানো-বাড়ানো যায়, স্কুল কর্তৃপক্ষ এমন ডেস্ক ব্যবহার করলে শিশুটির অনেক সুবিধা হবে। কালো বোর্ডে লেখার বদলে উজ্জ্বল হলুদ চক ও ফাইবারের বোর্ড ব্যবহার করতে হবে। “বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ছাত্র বা ছাত্রীর জন্য একটি স্কুল সহজেই এই ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। অন্য যে কোনও শিশুর চেয়ে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদেরও শিক্ষা গ্রহণের সমান অধিকার রয়েছে,” বলছেন হিরু।
কিন্তু বর্তমানে ‘স্পেশ্যাল এডুকেটর’ এবং ‘রিসোর্স রুমে’র সক্রিয়তার অভাবে শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের ‘লিপ রিডিং’, অন্ধদের ব্রেইল পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ কিংবা মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ অনেকটাই ব্যাহত হচ্ছে। সব থেকে বড় কথা, প্রতিটি রিসোর্স রুম চালানোর জন্য অন্তত এক জন করে ‘মাল্টিপল ট্রেনার’ থাকা দরকার। কিন্তু জেলার অধিকাংশ ‘রিসোর্স রুমে’ই তা নেই। ফলে নানা দিক থেকে বাধা পেয়ে ভর্তি হয়েও মাঝপথেই বহু শিশু স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে। সমস্যার কথা মেনে নিয়েছেন জেলা সর্বশিক্ষা মিশনের কর্তারাও। সর্বশিক্ষা মিশনের জেলা প্রকল্প আধিকারিক অনিন্দ্য মণ্ডল বলছেন, “স্পেশ্যাল এডুকেটর, মাল্টিপল ট্রেনার অমিল থাকায় বীরভূমে মাত্র ৫৪টি ‘রিসোর্স রুম’ চালু আছে। ভবিষ্যতে নিয়োগ হবে কিনা, তা নিয়েও এই মুহূর্তে আমাদের কাছে কোনও নির্দেশিকা নেই।” পরিকাঠোমার এই ‘প্রতিবন্ধকতা’ সত্ত্বেও প্রতিবন্ধীদের শিশুদের অধিকার দিতে লড়াই জারি রাখার সঙ্কল্প ছাড়ছেন না শেখ হিরুরা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.