রাজ্য সরকারের কাজকর্মে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। কিন্তু সেই অনুপাতে শাসক দল তৃণমূলের শক্তিক্ষয় হচ্ছে না। এর জন্য তাঁদের সাংগঠনিক ব্যর্থতাই দায়ী বলে রাজ্য কমিটির অন্দরে স্বীকার করে নিলেন সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। রাজ্যে রাজনৈতিক ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটানোর জন্য সর্বত্র একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নকে সামনে রেখে প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন বুদ্ধবাবু।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর মতে, নানা অপকর্ম সত্ত্বেও রাজ্যের রাজনৈতিক ভারসাম্য এখনও তৃণমূলের দিকে ঝুঁকে রয়েছে। এই অবস্থার বদল ঘটানোর জন্য বামেদেরই বাড়তি পরিশ্রম করতে হবে। গ্রামাঞ্চলে কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের সমস্যা নিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন করতে হবে। শহরাঞ্চলে গুরুত্ব দিতে হবে অসংগঠিত শ্রমিকদের ক্ষেত্রটিকে। তৃণমূলের দিকে পাল্লা ভারী থাকার পাশাপাশি রাজ্যের সর্বত্র যে একই রকম পরিস্থিতি নেই, সে কথাও রবিবার আলিমুদ্দিনে রাজ্য কমিটির বৈঠকে ব্যাখ্যা করেছেন বুদ্ধবাবু। তার জন্য উদাহরণ হিসাবে ব্যবহার করেছেন সদ্য অনুষ্ঠিত পাঁচটি পুরসভা ও ২৯টি ওয়ার্ডের উপনির্বাচনের ফলাফলকে। |
বারাসতে দলের সভায় প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের
সঙ্গে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। রবিবার। ছবি: সুদীপ ঘোষ। |
সিপিএম সূত্রের খবর, শিলিগুড়ির একটি ওয়ার্ডের উপনির্বাচনে বামেদের ৫২% ভোট পাওয়ার ঘটনাকে তাৎপর্যপূর্ণ বলেছেন বুদ্ধবাবু। কিন্তু একই সঙ্গে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন একই দিনে অনুষ্ঠিত হাওড়া পুরসভার ভোট নিয়ে। হাওড়ায় বামেদের ভোট ৪১% থেকে এ বার কমে প্রায় ২৫%-এ দাঁড়িয়েছে! কয়েক মাস আগেই হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের সময় পুরসভার কয়েকটি ওয়ার্ডে সিপিএম প্রার্থী প্রায় ৫৫% ভোট পেয়েছিলেন। সেই এলাকাতেই এ বার ভোট কমে হয়েছে ৮-৯%!
সামনের লোকসভা ভোটই এখন সিপিএমের লক্ষ্য। বুদ্ধবাবুও এ দিন লোকসভা ভোটে তৃণমূলকে সকলের থেকে ‘বিচ্ছিন্ন’ করে দেওয়ার লক্ষ্য সামনে রেখে এগোনোর কথা বলেছেন। কিন্তু তার জন্য ছোট থেকে বড় জায়গায় আন্দোলন তুলে আনার দাওয়াই দিয়েছেন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তি, শহরে বড় জনসভা বা কর্মসূচি নিশ্চয়ই হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কলকাতায় একটা বড় সমাবেশ মানেই রাতারাতি রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্য বদলে যাওয়া নয়! সেটা করতে গেলে গ্রামে ধান কাটা, ফসলের দাম নিয়ে চিরাচরিত আন্দোলনেই বামপন্থীদের গুরুত্ব দিতে হবে। ধরতে হবে অসংগঠিত শ্রমিকদের জীবনের নানা সমস্যাকে। দলের এক রাজ্য নেতার ব্যাখ্যা, গুচ্ছ বিষয় নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত না-করে মূল্যবৃদ্ধি, গণতন্ত্রের উপরে আক্রমণ, নারী নিগ্রহ এবং সারদার মতো লগ্নি সংস্থার রমরমা এই চারটি হাতিয়ারে শান দেওয়ার কথা বৈঠকে স্পষ্ট বলেছেন বুদ্ধবাবু।
আরও একটি পরামর্শ দিয়েছেন দলের এই পলিটব্যুরো সদস্য। যে সব এলাকা এখন তৃণমূলের অত্যাচারে ‘সন্ত্রস্ত’, সেখানে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করতে গিয়ে অতীতের ‘কিছু ঘটনার পুনরাবৃত্তি’ যেন না হয় সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি। দলের একাংশের মতে, অতীতে হুগলির আরামবাগ, গোঘাট, বর্ধমান বা পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায় শাসক দল হিসাবে সিপিএম যে ভাবে ছড়ি ঘোরাত, সেই ভুল আর না-করার বার্তাই দিতে চেয়েছেন বুদ্ধবাবু।
সিপিএম সূত্রের খবর, এ দিন বুদ্ধবাবুর বক্তব্যের পরেও বর্ধমানের দুই নেতা বৈঠকে বলেছেন, নেতারা বেশি আত্মসমালোচনা করলে কর্মীদের আত্মবিশ্বাসের অভাব হবেই! এমন বক্তব্যের লক্ষ্য বুদ্ধবাবুই, মনে করছে দলের একাংশ।
জবাবি ভাষণে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুও স্থানীয় দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনের কথা বলেছেন। পাশাপাশি তাঁর বার্তা, এই কঠিন সময়ে আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়েও যাঁরা কাজ করতে এগিয়ে আসছেন, সংগঠনে তাঁদেরই সামনে তুলে আনতে হবে। তৃণমূল যে ভাবে পঞ্চায়েত ও পুরসভা দখল করছে, তার বিরুদ্ধে প্রচার গড়ে তোলার ডাকও এ দিন দেন বিমানবাবু।
রাজ্য কমিটির যে ক’টি ফাঁকা জায়গা আছে, তার একটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কোচবিহার জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য প্রদীপ নাথকে। জলপাইগুড়ি ও পূর্ব মেদিনীপুর থেকে কাউকে রাজ্য কমিটিতে আনার ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। |