অভিষেক চাচান খুনে মূল অভিযুক্ত সুরজিৎ দাসের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিল শিলিগুড়ির অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালত, ফাস্ট কোর্ট।
ওই খুনের ঘটনায় অন্য দুই অভিযুক্ত রোমান সরকার ও সহিদুর রহমানকে প্রমাণ লোপাটে র দায়ে তিন বছরের সাজা দেওয়া হল। কিন্তু মামলা চলাকালীন ইতিমধ্যেই প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর জেল হাজতে থাকায় তাদের তিন হাজার টাকা জরিমানা করেই মুক্তি দেয় আদালত। তবে ওই রায়ে খুশি নন অভিষেক চাচান কিংবা সুরজিতের পরিবার। দু’পক্ষই এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। |
দিনান্তে বাড়ি ফিরে অভিষেকের ছবির সামনে
বাবা -মা। শনিবার ছবিটি তুলেছেন বিশ্বরূপ বসাক। |
শনিবার সকাল থেকেই শিলিগুড়ির ওই আদালত চত্বর আইনজীবী, পুলিশ, সংবাদমাধ্যম এবং সাধারণের ভিড়ে সরগরম ছিল। তারই মাঝে ঘন ঘন সিগারেট খেতে দেখা যাচ্ছিল যাঁকে, দিনান্তে সেই মাঝ বয়সী ভদ্রলোক নিতান্তই ম্লান গলায় জানালেন, “বিচার ব্যবস্থার প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। তবে এ দিনের রায়ে আমি খুশি নই। ছ’জনে মিলে আমার ছেলেটাকে খুন করল আর যাবজ্জীবন হল এক জনের। এমন হলে তো অপরাধ বাড়তেই থাকবে। আমি এই লড়াই থামাচ্ছি না। কলকাতা হাইকোর্টে যাচ্ছি।” তিনি অরবিন্দ চাচান। অভিষেকের বাবা। আর, সারাটা দিন আদালতের বাইরে বসে মন আর চোখ যিনি ফেলে রাখলেন আদালতের দুয়ারে, দিন শেষে মাথা নীচু করে ফিরে যাওয়ার আগে যিনি একটি কথাও বললেন না, সেই অভিযুক্ত সুরজিতের দাদা বিশ্বজিৎ -ও আইনজীবী মারফৎ জানাচ্ছেন, তাঁরাও কিন্তু ভরসা রাখছেন কলকাতা হাইকোর্টের উপরেই।
রায় ঘোষণার আগে সুরজিৎ, রোমান এবং সহিদুরের সঙ্গে কথা বলেন বিচারক সৌম্যব্রত সরকার মূল অভিযুক্ত সুরজিৎ ছাড়াও অন্য দুই অভিযুক্ত সহিদুর এবং রোমানের কাছে জানতে চান, তাঁদের কিছু বলার আছে কিনা। সুরজিৎ ও সহিদুর নিজেদের নির্দোষ বলে দাবি করে কাঠগড়ার পিছনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। তবে এগিয়ে এসে অনেক কথাই বলেন রোমান। তিনি বিচারককে জানান, সাড়ে পাঁচ বছর কেটে গিয়েছে। চোখের সামনে মামলা চলল। অনেক কিছু দেখা হল। আবার অনেক কিছু মনে হয় মামলায় বাদ থেকে গেল।
বিকালে ছোট ছেলে অঙ্কিতকে সঙ্গে নিয়ে দেশবন্ধুপাড়ার তিনতলা আবাসনে ফিরে ছেলের ছবিতে প্রদীপ জ্বালান অরবিন্দবাবু এবং তাঁর স্ত্রী বেলাদেবী। চোখে জল নিয়ে বেলাদেবী বলেন, “আমার ছেলে ফিরবে না ঠিকই। তবে এই রায়ে মনে শান্তি পাচ্ছি না। আমরা এখানে থামব না।”
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত সুরজিতের আইনজীবী পার্থ চৌধুরী বলেন, “আমরা রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আবেদন করব। সুরজিত এবং ওর দাদার সঙ্গে কথা বলেছি।”
রায়ের পর অবশ্য অনেকটাই হালকা দেখিয়েছে রোমান এবং সহিদুরকে। এজলাসের বাইরে থাকা তাদের পরিবারের লোকেরা অবশ্য চোখের জল আটকে রাখতে পারেননি। পুলিশ কর্মী সহিদুরের বাবা মতিউর রহমান এবং খড়িবাড়ি গ্রন্থাগারের কর্মী রোমানের বাবা রঞ্জিতবাবু ছলছলে চোখে বলেন, “সাড়ে পাঁচ বছর চলে গিয়েছে। অনেক স্বপ্ন হারিয়ে গিয়েছে। নতুন করে সব শুরু করতে হবে।” দু’জনের আইজীবী অত্রি শর্মা বলেন, “বিচারকের রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। ওরা দোষী প্রমাণিত হয়েছে। সাজার মেয়াদ জেলে আগেই কাটিয়ে দেওয়ায় ছাড়া পেয়েছেন।”
কল সেন্টারের কর্মী অভিষেক চাচান ২০০৮ সালের ২২ মে দেশবন্ধুপাড়ার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেননি। ২৪ মে ফাঁসিদেওয়া মধুজোত থেকে দেহটি উদ্ধার করে পুলিশ। তদন্তে নেমে পুলিশ অভিষেকের বন্ধু সুরজিৎ দাস, রোমান সরকার, সইদুর রহমান, অমিত মণ্ডল, আনন্দ গুপ্ত এবং নীলকমল শর্মাকে গ্রেফতার করে। পুলিশ জানায়, এক বান্ধবীকে নিয়ে রেষারেষির জেরেই সুরজিৎ ২০০৮ সালের ২২ মে বিয়ারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে অভিষেককে খাইয়ে অচৈতন্য করে। তারপরে শ্বাসরোধ করে খুন করে তাঁকে। তাকে সঙ্গ দেয় পাঁচ জন। তবে শুক্রবার তথ্য প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস পান অমিত, আনন্দ এবং নীলকমল। এ দিন বাকি ‘বন্ধু’দের দেখতে আদালতেও এসেছিল অমিত, নীলকমলেরাও। |