আর্থিক ঘাটতি কমাতে সব মন্ত্রকের বরাদ্দ ছাঁটাইয়ের প্রস্তাব দিয়ে ক’দিন আগেই কার্যত মন্ত্রীদের বিদ্রোহের মুখে পড়েছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম। তবু হাল ছাড়েননি তিনি। আবার লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেসের পক্ষেও তাঁর তেতো দাওয়াই মেনে নেওয়া পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। উল্টে ভোটের আগে জনগণের মনোলোভা হয়ে ওঠে এমন কিছু ‘পপুলিস্ট’ ঘোষণার জন্য মনমোহন-চিদম্বরমের ওপর চাপ বাড়াচ্ছেন কংগ্রেসের নেতা-মন্ত্রীরা। তাঁদের এই তৎপরতার পিছনে কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের সমর্থন রয়েছে বলেই দলীয় সূত্রের খবর।
কংগ্রেসের নেতা-মন্ত্রীদের মূল দাবি দু’টি। এক, বার্ধক্য পেনশনে কেন্দ্রের অনুদান ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা করা হোক। সেই সঙ্গে আশি বছরের বেশি বয়স্কদের পেনশনে কেন্দ্রের দেয় অংশ ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হোক ২ হাজার টাকা। দুই, মজুরি বাড়ানো হোক একশো দিনের কাজ প্রকল্পে।
সামাজিক বিচার মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, বার্ধক্য পেনশন বাড়ানোর ব্যাপারে চূড়ান্ত প্রস্তাব শীঘ্রই মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। আর একশো দিনের কাজ প্রকল্পে মজুরি বাড়ানোর ব্যাপারে একটি কমিটি গড়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক। কংগ্রেস সূত্রে বলা হচ্ছে, এই দুই দাবিতে সনিয়া-রাহুলের যে সায় রয়েছে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। কারণ, সামাজিক ন্যায়বিচার মন্ত্রী কুমারী সেলজা এবং গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ উভয়েই দশ জনপথের বিশেষ আস্থাভাজন।
সামাজিক বিচার মন্ত্রকের আওতায় বার্ধক্য পেনশন হিসেবে মাথাপিছু ২০০ টাকা দেয় কেন্দ্র। আর রাজ্য সরকার দেয় কমবেশি তার সমান টাকা। কিছু রাজ্য কেন্দ্রের থেকে বেশিও দেয়। যেমন পশ্চিমবঙ্গ সরকার দেয় ৩০০ টাকা। আবার সম্প্রতি রাজস্থান সরকার ৮০০ টাকা দিতে শুরু করেছে। ফলে কেন্দ্র যদি এ বার ১ হাজার টাকা বার্ধক্য পেনশন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে রাজ্যগুলিও চাপে পড়বে। কিন্তু এত আর্থিক দায় কেন্দ্রই বা বহন করবে কী ভাবে?
এই প্রশ্নের মুখে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির এক বর্ষীয়ান সদস্য বলেন, “সেটা চিদম্বরমকেই ভাবতে হবে। ভোটে কংগ্রেস হারলে কোন সরকারের অর্থমন্ত্রী হবেন তিনি?”
বেছে বেছে এই দু’টি প্রকল্পকে কেন অগ্রাধিকার দিচ্ছে কংগ্রেস! কংগ্রেস নেতাদের বক্তব্য, লোকসভা ভোটে এ বার কংগ্রেসের প্রচার কৌশলের অন্যতম বিষয়ই হল, গ্রাম ও গরিব। খাদ্য সুরক্ষা বা জমি আইন নিয়ে সনিয়া-রাহুল রাজ্যওয়াড়ি প্রচার শুরু করেছেন ইতিমধ্যেই। গত লোকসভা ভোটে একশো দিনের কাজ প্রকল্পের রূপায়ণ ও কৃষিঋণ মকুবের সিদ্ধান্ত গ্রামাঞ্চলে কংগ্রেসের জনভিত্তি মজবুত করেছিল অনেকটাই। সেই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যেতেই এ বার একশো দিনের কাজ প্রকল্পে মজুরি বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে।
বার্ধক্য পেনশন বাড়ানো নিয়েও একই যুক্তি কংগ্রেস নেতাদের। রাজস্থানে কংগ্রেস সরকার বার্ধক্য পেনশন বাড়ানোয় ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গিয়েছে। বয়স্কদের অনেকের মধ্যে ইন্দিরা-রাজীবের স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল। ইন্দিরা গাঁধীর নামেই তাই নামকরণ করা হয়েছিল পেনশন প্রকল্পটির। বার্ধক্য পেনশন এক ধাক্কায় পাঁচ গুণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলে হাতেনাতে ফল পাওয়ার আশা করছেন কংগ্রেস নেতারা।
যদিও রাজনৈতিক ব্যাখ্যাকে আড়ালে রেখে সরকারি ভাবে এ দু’টি সম্ভাব্য সিদ্ধান্তের পোশাকি ব্যাখ্যাও দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ বলেন, “মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে সময়ে-সময়ে একশো দিনের কাজ প্রকল্পে মজুরি বাড়ানোর প্রস্তাব গোড়া থেকেই রয়েছে।
সরকার শুধু সেই প্রশাসনিক কাজটি করছে। এর পিছনে রাজনীতি খোঁজা অর্থহীন।”
সামাজিক বিচার মন্ত্রকের বক্তব্য, ২০০১-এর তুলনায় বৃদ্ধদের সংখ্যা ৩৫ শতাংশ হারে বেড়েছে। ২০১১ সালের জনগণনা বলেছে, দেশে বৃদ্ধের সংখ্যা ১০.৪ কোটি। এঁদের কল্যাণের দিকে নজর দেওয়ার কর্তব্য রয়েছে সরকারের। আর সে কারণেই বয়স্কদের জন্য একটি জাতীয় নীতি প্রণয়ন করতে চায় মন্ত্রক। মন্ত্রকের এক যুগ্ম সচিব জানান, খসড়া নীতিতে বৃদ্ধদের সামাজিক কল্যাণের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ করার প্রস্তাব রয়েছে।
তার মূল চারটি হল:
• কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে তাঁদের সামাজিক দায় খাতে বরাদ্দ অর্থের ১০ শতাংশ বয়স্কদের কল্যাণে খরচ করতে হবে।
• বার্ধক্য পেনশন পাঁচ গুণ বাড়াতে হবে। কারণ, দু’-চারশো টাকায় কারও জীবন চলে না। ৮০ বছর বয়স হলে পেনশন বাড়িয়ে ২ হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেওয়ার পিছনে রয়েছে দু’টি যুক্তি। এক, এই বয়সে চিকিৎসার খরচ এমনিতেই বেড়ে যায়। দুই, বেশি বয়সে শারীরিক ক্ষমতা যখন কমে আসে, তখন ছেলে-বউমারা মারা গেলে দেখার লোক থাকে না, তখন অর্থের প্রয়োজন পড়ে বেশি।
• অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে সরকারকে।
• বৃদ্ধদের খাদ্য সুরক্ষার আওতায় এনে তাঁদের পুষ্টিকর খাবার জোগানোর বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে হবে।
সামাজিক বিচার মন্ত্রক সূত্রে এ-ও বলা হচ্ছে, এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সঙ্গে ইতিমধ্যেই তাঁদের কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, পাঁচ রাজ্যে ভোটের ফল বেরনোর কিছু দিনের মধ্যেই মন্ত্রিসভা সায় দিয়ে দেবে প্রস্তাবগুলিতে। |