মহকুমা হাসপাতাল। মোট চিকিৎসক ২৭ জন। কিন্তু অভিযোগ, ন্যূনতম পরিষেবা মেলা দূর অস্ত, সময় মতো দেখা মিলছে না তাঁদের একটা বড় অংশেরই। চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই হাসপাতালের বদলে প্রাইভেট প্রাক্টিসেই বেশি মন দিয়েছেন বলে তাঁরা দাবি করছেন। আর তা নিয়েই গত কয়েক দিন ধরে বোলপুর মহকুমা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং রোগীদের মধ্যে শুরু হয়েছে চাপানউতোর। ইতিমধ্যে রোগীদের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে হাসপাতালে আচমকা ঢুঁ মেরেছেন জেলার সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরীও। তাঁর দাবি, অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। সভাধিপতি বলছেন, “ওই হাসপাতালের পরিষেবা নিয়ে রোগীরা নানা অভিযোগ তুলছেন। হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানে জরুরি পরিষেবা বিঘ্নিত হবে তা কোন ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।”
সরকারি হিসেব অনুযায়ী এই হাসপাতালে ২০০টি শয্যা রয়েছে। কিন্তু ভর্তি থাকেন ২৩০-২৫০ জন। বিশেষজ্ঞ নিয়ে চিকিৎসক ২৭ জন। সেই অনুপাতে নার্সও রয়েছেন। ফলে বোলপুরের মহকুমা হাসপাতালে যে পরিকাঠামো, তাতে সর্দি কাশি, জ্বর, পেটের অসুখ-সহ নানা নিয়মিত সমস্যার ক্ষেত্রে সেখানে উপযুক্ত পরিষেবা পাওয়ার কথা। রয়েছে প্রসবের সুব্যবস্থা, সঙ্গে আইসিসিইউও। অথচ রোগীদের একটা বড় অংশেরই হাসপাতালের পরিষেবা নিয়ে বিস্তর ক্ষোভ। তাঁদের অভিযোগ, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে না পেয়ে রোগীদের অস্ত্রোপচারের জন্যে এখানে দিনের পর দিন অপেক্ষা করে থাকতে হয়। ভুক্তভোগী রোগীদের অভিযোগ, প্রাইভেট প্র্যাক্টিসে ব্যস্ত থাকার জন্যই এই হাসপাতালের চিকিৎসকদের একাংশ সর্বনিম্ন সময়টুকুও রোগীদের জন্য বরাদ্দ করতে পারেন না। এমনকী, একাধিক চিকিৎসক বোলপুরের বাসিন্দা হয়ে চুটিয়ে বাইরে প্র্যাক্টিস করলেও কর্তব্যের সময় তাঁরা হাসপাতালে অনুপস্থিত থাকছেন। তা ছাড়াও রয়েছে, রোগী ভর্তি হওয়ার পরেও কয়েক ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও তাঁদের দেখতে না যাওয়ারও অভিযোগ।
স্থানীয় তৃণমূল নেতা রাজা রায় বলছেন, “বর্তমানে যা পরিকাঠামো রয়েছে, তাতে জরুরিকালীন রোগী পরিষেবা থেকে শুরু করে নানা রকমের অস্ত্রোপচার-সহ বিভিন্ন পরিষেবা এই হাসপাতাল থেকে অনায়াসে দেওয়া যায়। কিন্তু চিকিৎসার মতো জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত এই হাসপাতালে যুক্তদের একাংশের অমনোযোগী থাকা এবং অনীহার কারণে দৈনন্দিন পরিষেবা ব্যাহত হচ্ছে। ফলে নিত্য ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষদের।” বুধবারই পরিষেবা নিয়ে নানা অভিযোগ পেয়ে বিকাশবাবু আচমকা হাসপাতালে পৌঁছে ছিলেন। হাতের নাগালে সভাধিপতিকে পেয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন রোগীরা। মঙ্গলকোট থেকে আসা পৃথ্বীশ নন্দী বলেন, “অস্ত্রোপচার করাবো বলে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে এখানে হন্যে হয়ে ঘুরছি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক সময় দিচ্ছেন না।” তাঁর মতোই চিকিৎকের দেখা পাচ্ছেন না কোমর ও পায়ের যন্ত্রণায় ভোগা কসবার সামসুনেহা বিবিও। ওই দিন বিকাশবাবু নিজেই দেখে যান, নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যাওয়ার দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত হাসপাতালের ৭০ শতাংশ চিকিৎসকই অনুপস্থিত। পরে অবশ্য জেলার সভাধিপতির বিশেষ পরিদর্শনের খবর পেয়ে তাঁরা একে একে হাসপাতালে চলে আসেন। হাসপাতালের চিকিৎসা পরিষেবার মান নিয়ে বিকাশবাবু প্রকাশ্যে ক্ষোভ উগরে দেন।
এ দিকে, আগের সুপার সুদীপ মণ্ডল বদলি হয়ে যাওয়ার পরে চিকিৎসকদের একাংশ কাজে ফাঁকি দেওয়ার পুরনো অভ্যেসে ফিরেছেন বলে অভিযোগ। বর্তমান সুপার প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য দায়িত্বে আসার পরে একাধিক বৈঠক করেছেন। কিন্তু অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয়নি বলেই রোগীদের দাবি। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ১৪ নভেম্বরই সুপার একটি জরুরি বৈঠক ডাকেন। বৈঠকে ২৬ জন চিকিৎসক হাজির ছিলেন। সেখানে প্রদীপ্তবাবু সাম্প্রতিক কালে রোগী পরিষেবা বিঘ্নিত হওয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বলে জানা গিয়েছে। বৈঠকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসকদের সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত এবং এক্সরে স্টাফদের সকাল ৮টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত ডিউটি করার প্রস্তাব দেন। যদিও চিকিসৎকদের সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টো পর্যন্ত ডিউটি করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু অভিযোগ, বাস্তবে তার কিছুই রূপায়িত হচ্ছে না। সপ্তাহে বড়জোর ১১ থেকে ১৩ ঘণ্টা মাত্র ডিউটি করেন চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ। ফলে অস্ত্রোপচারের জন্য রোগীদের মাসের পরে মাস অপেক্ষা করতে হচ্ছে বলে দাবি। সুপার অবশ্য বলছেন, “ওই বৈঠকের পর কে কেমন ডিউটি করছেন, সে দিকে নজর দেওয়া হয়েছে। পরিষেবার মানোন্নয়ন নিয়ে হাসপাতালের চিকিৎসক এবং অন্যদের সঙ্গে আলোচনাও হয়েছে। অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” বিষয়টি নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন জেলার রোগীকল্যাণ সমিতির সভাপতি চন্দ্রনাথ সিংহও। তিনি বলেন, “উন্নতমানের পরিষেবা দেওয়ার জন্য আমরা সব রকমের পদক্ষেপ করব।” এ দিকে বিকাশবাবুর কাছ থেকে ওই হাসপাতাল নিয়ে একটি রিপোর্ট পেয়ে ইতিমধ্যেই রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বীরভূমে তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। অনুব্রতর দাবি, “চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি, সুপারের অনুপস্থিতি-সহ চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে রোগীদের ক্ষোভের কথা মন্ত্রীকে জানিয়েছি। তিনি ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।” বৃহস্পতিবারও অবশ্য কয়েক জন চিকিৎসকে নির্দিষ্ট সময়েরও পরে কাজে যোগ দিতে দেখা যায়। |