খেলতে গিয়ে চোখে বাঁশের কঞ্চির ডগা লেগে অক্ষিগোলক ফেটে গিয়েছিল বছর পাঁচেকের শিশুটির। তার পর থেকেই ডান চোখে অন্ধকার দেখছিল সে। বাঘমুণ্ডির প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে স্থানীয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সেখান থেকে ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নিয়ে যাওয়া হয় ছেলেটিকে। পরিস্থিতি জটিল বুঝে ছেলেটিকে রেফার করা হয় ৭৫ কিলোমিটার দূরের পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে। সীমিত পরিকাঠামোর মধ্যেই বুধবার রাতে ছেলেটির চোখে জটিল অস্ত্রোপচার সম্ভব করলেন হাসপাতালের চক্ষু বিশেষজ্ঞ দেবাশিস প্রামাণিক ও শল্য চিকিৎসক পবন মণ্ডল।
দেবাশিসবাবু বলেন, “বৃহস্পতিবার সকালে একবার ব্যান্ডেজ খুলে আঘাতপ্রাপ্ত চোখে ছেলেটি দেখতে পাচ্ছে কি না, পরীক্ষা করা হয়েছে। আশার কথা, ও ঝাপসা হলেও দেখছে বলছে।” অসিত গঁরাই নামে আহত ছেলেটির বাবা গুরুচরণবাবু বলেন, “ডাক্তারবাবুরা ওকে ডিম দেখিয়েছিলেন। ছেলে বলল, ও সেটা দেখতে পেয়েছে।” অসিতকে বেশ কয়েক দিন নজরে রাখতে হবে বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। এটাই প্রথম বার নয়, এর আগেও নানা জরুরি সময়ে জটিল অস্ত্রোপচার হয়েছে এই হাসপাতালে। বহু মানুষ সেই অস্ত্রোপচারের পরে সুস্থ হয়েছেন। বাঘমুণ্ডির প্রত্যন্ত সেরেংডি গ্রামের বাসিন্দা গুরুচরণ গঁরাই জানান, মঙ্গলবার বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে অসিতের চোখে কঞ্চির ডগা কোনও ভাবে ঢুকে যায়। |
ঝরঝর করে চোখ থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। গুরুচরণবাবুর কথায়, “গ্রামে সামান্য টিউশনি করে সংসার চালাই। ছেলের চিকিৎসার জন্য কলকাতা বা অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার মতো আর্থিক সঙ্গতি আমার নেই।” শল্য চিকিৎসক পবনবাবু বলেন, “বুধবার সন্ধ্যায় ছেলেটি হাসপাতালে আসে। পরীক্ষা করে দেখা গেল, আঘাতে ডান চোখের অক্ষিগোলক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা। আমরা রাতেই অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিই।” চক্ষু বিশেষজ্ঞ দেবাশিবাবু বলেন, “ছেলেটির ডান চোখের সাদা ও কালো (অক্ষিগোলক ও মণি) অংশ, দুই জায়গাই ফেটে গিয়েছে। একে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘প্রোল্যাপ্স অব ইউভিয়াল টিস্যু অ্যান্ড ভিট্রিয়াস’ বলা হয়।” দেবাশিসবাবু জানান, একটি চোখের ‘ইউভিয়াল টিস্যু’ আক্রান্ত হলে অন্য চোখ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। তা ছাড়া মঙ্গলবার চোট লেগেছিল। আর সদর হাসপাতালে ছেলেটিকে আনা হয়েছিল বুধবার সন্ধ্যায়। আরও দেরি হলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু, সেই সময় চক্ষু বিভাগে সেবিকা ছিলেন না। অন্য বিভাগ থেকে দুই সেবিকাকে নিয়ে আসা হয়। রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ অস্ত্রোপচার শেষ হয়। শিউলি দত্ত নামে এক সেবিকার কথায়, “আমার ডিউটি শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এ রকম বিপদের কথা শুনে আমি রাতেও চলে আসি। আমারও তো ওই বয়সের সন্তান রয়েছে।” গুরুচরণবাবু বলেন, “ডাক্তারবাবুরা আমার ছেলের জন্য যা করলেন, সেই ঋণ শোধ করতে পারব না। অস্ত্রোপচারের পরেও ওঁরা প্রায় সারা রাত জেগে ছেলের কাছে বসেছিলেন।” হাসপাতালের সুপার নীলাঞ্জনা সেনের প্রতিক্রিয়া, “চক্ষু বিভাগে দুর্বল পরিকাঠামো নিয়ে যে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এই অস্ত্রোপচার সম্ভব করেছেন, তাঁদের জন্য আমি গবির্ত।” অসিতের চোখ নিয়েই এখন বেশি উদ্বিগ্ন পবনবাবু ও দেবাশিসবাবু। “আমরা কর্তব্য করেছি মাত্র। ও দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলে খুব ভালো লাগবে।”বললেন তাঁরা। |