সঙ্গে থাকলে ঢেলে দেবেন।
রায়গঞ্জের জনসভা থেকে আজ এ ভাবেই সরাসরি ডাক দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সিপিএমের জেলা পরিষদ, তার উপর কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দীপা দাসমুন্সির ‘খাস তালুক’। লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এখানে মমতার প্রথম সফরে হয়তো এই রকমই কোনও বার্তা শোনার প্রতীক্ষা ছিল। তাই, গত সন্ধ্যায় এখানে পা দিয়েই যে উন্মাদনা মমতা দেখেছিলেন, আজ উত্তর দিনাজপুরের কর্ণজোড়া ময়দানের সভাস্থল থেকে শুরু করে দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমন্ডি আসা পর্যন্ত গোটা রাস্তায় তা যেন আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেল। তারই সুযোগ নিয়ে মমতাও তাঁর কর্ণজোড়া এবং কুশমন্ডির দু’টি সভায় একই সঙ্গে কংগ্রেস এবং সিপিএমকে নিশানায় বিঁধলেন। রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যায়, সভা দু’টি সরকারি অনুদান বিলি সংক্রান্ত হলেও মমতা আসলে প্রাক-নির্বাচনী সফর হিসেবে তাকে কাজে লাগালেন। |
রায়গঞ্জে আজ দিনের বেলায় শীতের লেশমাত্র ছিল না। বেলা ১২টার খর রোদে মমতা যখন কর্ণজোড়ার মাঠে পৌঁছন, বিশাল ময়দানে তখন তিলধারণের স্থান নেই। মাঠে আসার পথে যথারীতি দু’পাশে তাঁকে দেখার জন্য হাজার হাজার মানুষের সারি।
কংগ্রেস এবং সিপিএমকে এক বন্ধনীতে ফেলে ‘ব্যাটিং’ শুরু করেন মমতা। বলতে থাকেন কেন্দ্রের একের পর এক ‘বঞ্চনা’র কথা। এই প্রসঙ্গেই আসে রাজ্যের কাঁধে ঋণের বোঝার কথা। মমতা বলেন, “কেন্দ্রের ধার শোধ করতে করতে হাতে একটা টাকাও থাকছে না। অভাবে জর্জরিত হয়ে আছি। প্রতি বছর ওরা ঋণ আর সুদ বাবদ ২৮ হাজার কোটি টাকা করে কেটে নিচ্ছে। এ ছাড়া অন্যান্য কর বাবদ নিয়ে যাচ্ছে আরও ৪০ হাজার কোটি। কিন্তু আমরা তো ধার করিনি। অন্যের অন্যায়ের বোঝা আমরা বইব কেন?” কেন্দ্রের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি: “যারা অন্যায় করেছে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে।” কুশমন্ডির সভায় মমতার সংযোজন: “অন্যদের নেওয়া ধার শোধ করার জন্য ওই টাকা দিতে না হলে দশ লাখ লোকের চাকরি দিতে পারতাম।”
এখানেই শেষ নয়। ভাঙাচোরা ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের মেরামতির দায় যে কেন্দ্র নিচ্ছে না কর্ণজোড়ার সভায় সে দিকেও আঙুল তোলেন মমতা। এবং সুকৌশলে এড়িয়ে যান রায়গঞ্জে এইমস-এর ধাঁচে হাসপাতাল তৈরি নিয়ে দীপা দাসমুন্সির বিবিধ তৎপরতার প্রসঙ্গ। বরং পাল্টা জানান, এই জেলায় সরকার দু’টি মাল্টি স্পেশ্যালিটি সুপার হাসপাতাল তৈরি করবে, যার একটি খাস রায়গঞ্জে, অন্যটি ইসলামপুরে।
স্পষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়েই যে মমতা এ বার মালদহ এবং রায়গঞ্জে পর পর দু’টি সভা করলেন তা তাঁর বক্তব্যে পরিষ্কার। যেমন, গতকাল মালদহে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছেন, “বরকতদাকে শ্রদ্ধা করতাম। তাই এত দিন মালদহে নিজে থেকে কিছু করিনি। এ বার করব।” |
আর আজ প্রিয়রঞ্জন-দীপা দাসমুন্সিদের রায়গঞ্জে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দেন, তাঁর সঙ্গে থাকলে তিনি ঢেলে দেবেন। মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে এ হেন প্রতিশ্রুতির অর্থ কতটা সুদূরপ্রসারী, মাঠ ভর্তি জনতার উল্লাসে তার প্রমাণ মিলেছে। তবে তার চেয়েও নজরকাড়া দৃশ্য দেখা গিয়েছে রায়গঞ্জ থেকে কুশমন্ডি যাওয়ার পথে দীপা দাসমুন্সির নিজের পাড়া কালিয়াগঞ্জে। পথের দু’পাশে যত দূর চোখ যায় কাতারে কাতারে মানুষ।
ভিড়ের ঠেলায় এক এক সময় গাড়ি এগনোও কঠিন হয়ে পড়ছিল। অন্তত তিন কিলোমিটার জুড়ে এই অবস্থা। ক’দিন আগেই প্রিয়রঞ্জনের এক ভাই সত্যরঞ্জন কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। এ দিনের মঞ্চেও তিনি ছিলেন। এ বার রায়গঞ্জ শহরে তো বটেই, খাস কালিয়াগঞ্জে এই ছবি দেখে সত্যবাবুরা মনে করছেন, রায়গঞ্জ লোকসভার ভোটারেরা এ বার হয়তো পালাবদল ঘটাবেন। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বৃত্তটা আর একটু বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, “শুধু রায়গঞ্জ-মালদহে কংগ্রেস নয়, দক্ষিণ দিনাজপুরেও মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ঢল বুঝিয়ে দিয়েছে,
আগামী লোকসভা নির্বাচনে বামেরাও এখানে টলমল।”
মালদহ ও রায়গঞ্জের এত দিনকার দুই ‘কংগ্রেস দুর্গ’ সফরের পরে মমতা নিজেও যে বেশ আত্মবিশ্বাসী তা তাঁর হাবেভাবে ভালই বোঝা গিয়েছে। যদিও অভিজ্ঞ রাজনীতিক হিসেবে এখনই মুখে সে কথা তিনি প্রকাশ করেননি। শুধু বলেছেন, “মানুষ আমাদের বিশ্বাস করেন বলেই এ ভাবে ঘর ছেড়ে সর্বত্র আমাদের জন্য বেরিয়ে এসেছেন। এই আশীর্বাদটুকুই আমরা চাই।” |