কেউ বলছেন গুপ্তযুগের সময়কালের ধ্রুপদী শিল্পকলার নমুনা। অনেকের দাবি, পাল যুগের সমসাময়িক। প্রাচীন প্রাগজ্যোতিষপুর সাম্রাজ্যের সীমান্ত এলাকায় বিকশিত সভ্যতার অজানা তথ্য কিন্তু গবেষক মহলে বিভিন্ন সময় গুরুত্বের সঙ্গে এ ভাবে উঠে এলেও ময়নাগুড়ি ব্লক জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলি সংরক্ষণে কোনও উদ্যোগ নেই।
খোলা আকাশের নীচে আগাছা ও ঝোপজঙ্গলের মধ্যে নষ্ট হচ্ছে পাথরের মূল্যবান উপাদান। পাথরে খোদাই করা কারুকাজ রোদ বৃষ্টিতে ক্ষয়ে যাচ্ছে। শ্যাওলার পুরু আস্তরণে মুখ ঢেকেছে দ্বারপালের মতো কিছু মূর্তি। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের কর্তারা জানান, পুরাণে জল্পেশকেন্দ্রিক এলাকা রত্নপীঠ নামে পরিচিত ছিল। সেখানে পাওয়া সব উপাদানের যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। সর্বেক্ষণের কলকাতা সার্কেলে অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার শান্তনু মাইতি বলেন, “ময়নাগুড়ি ব্লকে ছড়িয়ে থাকা উপাদানগুলি সংরক্ষণের প্রস্তাব এলে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হবে।” রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতরের উপ-অধিকর্তা অমল রায় বলেন, “ওই প্রত্নস্থলের উপাদানগুলি আদি মধ্যযুগের বলে প্রাথমিক ভাবে মনে হয়েছে। যদি রাজ্য সরকারকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, তবে আমরা সংরক্ষণ করতে পারি।” |
বটেশ্বরে খোলা আকাশের নীচে ঝোপঝাড়ে পড়ে প্রত্নসামগ্রী। দীপঙ্কর ঘটকের তোলা ছবি। |
মাটি খুঁড়ে পাওয়া ধ্বংসাবশেষগুলি সংরক্ষণের জন্য সর্বেক্ষণ বা রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল কি না, ব্লক প্রশাসনের কর্তারা অবশ্য কিছু জানাতে পারেননি। যুগ্ম বিডিও সমর রায় বলেন, “খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।” যদিও কোচবিহার পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে কোঅর্ডিনেটর রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের প্রাক্তন সদস্য আনন্দগোপাল ঘোষ বলেন, “কেন্দ্রীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগে ওই বিষয়ে আগে কিছু জানানো হয়নি। কয়েকদিনেই চিঠি পাঠানো হবে।” ‘গেটওয়ে অব ডুয়ার্স’ ময়নাগুড়ির পেট চিরে বয়ে গিয়েছে জরদা নদী। পুরাণে জটদ্ভবা নামে পরিচিত নদীর এক দিকে রয়েছে বটেশ্বর অন্য দিকে জটিলেশ্বর। এ ছাড়াও পাথরের চাঁই দিয়ে তৈরি করা স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ মিলেছে সদরখই, ভদ্রেশ্বর এলাকায়। পেটকাটি এলাকায় পাওয়া যায় সাড়ে ৭ ফুট উঁচু কালো পাথরের তৈরি মূর্তি। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে শিক্ষক দীপক রায় বলেছেন, “মূর্তিটি বজ্রযান তন্ত্র সাধনার প্রতীক।”
চার দশক আগে কোথাও ঢিবি কাটতে গিয়ে, কোথাও পুকুর খননের সময় ওই সব ধ্বংসাবশেষের খোঁজ মেলে। এর পরে কিছু দিন হইচই হয়। ইতিমধ্যে প্রচুর পাথর এবং হাল্কা সরু ইট লোপাট হয়েছে। সদরখই এলাকায় স্কুল বাড়ি তৈরি করে নষ্ট করা হয়েছে মাটিতে তলায় থাকা স্থাপত্যের বিরাট অংশ। গুজরাতের মহারাজা সইয়াজি রাও বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র তমাল গোস্বামী বলেন, “বটেশ্বর জটিলেশ্বর ও ভদ্রেশ্বর এলাকায় প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষে গুপ্ত যুগের সময়কালের ধ্রুপদী শিল্পকলার ছোঁয়া রয়েছে। ঠিক মতো গবেষণা হলে কিরাতভূমির বহু অজানা তথ্য উঠে আসবে। কিন্তু যে ভাবে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে, আগামী দিনে গবেষণার জন্য কিছু থাকবে না।” |