পুরসভার বয়স ১৩৭ বছর হলেও বহরমপুরের বয়স কিন্তু তার কয়েক গুণ বেশি। বহরমপুর পুরসভা এলাকায় রয়েছে কালিকাপুর, সৈয়দাবাদ, কাশিমবাজর, খাগড়া, গোরাবাজার। রেশম, মসলিন, কাঁসা ও অন্য ব্যবসার টানে কালিকাপুরে ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে কুঠি স্থাপন করে ওলন্দাজরা, ১৬৫৮ সালে কাশিমবাজারে কুঠি স্থাপন করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দাবাদে গড়ে ওঠে আর্মেনিয়দের কুঠি এবং ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দাবাদ লাগোয়া ফরাসডাঙায় গড়ে ওঠে ফরাসিদের কুঠি। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজের পরাজয়ের পর ইংরেজরা সুবে বাংলার রাজধানী লালবাগ (মুর্শিদাবাদ) থেকে বহরমপুরে স্থানান্তরিত করে।
মুর্শিদাবাদের ইতিহাস গবেষক বিজয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ‘শহর বহরমপুর’ গ্রন্থে লিখেছেন, ১৭৬৫-৬৭ খ্রিস্টাব্দে বহরমপুর শহরের প্রায় মধ্যস্থলে গড়ে ওঠে ক্যান্টনমেন্ট এলাকা। ৪২৬৭ বিঘা জমি জুড়ে গড়ে তোলা হয় ক্যান্টনমেন্ট, প্রশাসনিক ভবন, প্রশাসকদের বাসভবন ও ব্যারাক স্কোয়ার ময়দান। বহরমপুর পুরসভার গঠনের সলতে পাকানোর কাজটি এ ভাবেই শুরু হয়েছিল প্রায় ৪০০ বছর আগে। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় মিউনিসিপ্যাল আইন প্রবর্তিত হওয়ার আগে ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১ এপ্রিল গোরাবাজার, ক্যান্টনমেন্ট, বহরমপুর, খাগড়া, সৈয়দাবাদ ও কাশিমবাজার মিলে মোট ৬টি ওয়ার্ড নিয়ে গড়ে ওঠে বহরমপুর পুরসভা। |
বিশিষ্ট আইনজীবী প্রয়াত বিজকুমার গুপ্ত বহরমপুর পুরসভার কাউন্সিলর ছিলেন টানা ২৫ বছর। তিনি ‘শতবর্ষের আলোকে বহরমপুর পুরসভা’ নিবন্ধে লিখেছেন, “সরকার ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় মিউনিসিপ্যাল বিধান অনুসারে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে পৌরসভার দায়িত্বভার ১৪ জন নির্বাচিত এবং ৫ জন সরকার মনোনীত ৫ জন প্রতিনিধির উপর অর্পণ করেন। জেলা উকিলসভার সভাপতি বৈকুন্ঠনাথ সেন পৌরসভার প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন।” জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২৭ হাজার। আজ লাখ দু’য়েক। উত্তর-দক্ষিণ বরাবর ৭ কিলেমিটার লম্বা বহরমপুর শহরের আয়তন ৩১.৪২ বর্গ কিলোমিটার।
মুর্শিদাবাদ জেলায় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম প্রয়াত অপর্ণাকিঙ্কর ভট্টাচার্য ‘শহর বহরমপুরের ক্রমবিকাশ একটি স্মৃতিচারণা’ নিবন্ধে লিখেছেন, “১৯৩৯ সালে বহরমপুরের রাস্তাঘাট ছিল সুড়কির কেবল মেইন রোডের অনেকখানি পিচঢালা ছিল। পৌর এলাকায় মাত্র চারশো বিজলিবাতির স্তম্ভ এবং প্রায় সমসংখ্যক কেরোসিন বাতি জ্বালাবার ব্যবস্থা ছিল। কাশিমবাজার ওয়ার্ডের একাংশে গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে এমন ঝোপজঙ্গল ছিল যে শীতকালে সেখানে বাঘ চলে আসত।” সেই শহরে এখন লোকসখ্যা ২ লক্ষ। দেশ ভাগ ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফলে পূর্ববঙ্গের অনেকে বহরমপুর শহরে পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ভূমি আন্দোলন ও খুনের রাজনীতির জেরে মুর্শিদাবাদ জেলার গ্রামীন মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি অংশ নিরাপত্তার কারণে বহরমপুর শহরে বসবাস শুরু করে।
চাকরি ও সন্তানদের লেখাপড়ার তাগিদে বিগত দুই দশক ধরে বহরমপুর শহরে বসবাসের চাপ বাড়তে থাকে। বহরমপুরের পুরপ্রধান নীলরতন আঢ্য বলেন, “বহরমপুর শহরে জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। ওই চাপ সামাল দিতে বহুতল আবাসন গড়ে উঠছে।” গড়ে ওঠা শ’ তিনেক বহুতল আবাসন নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত সাহা। তিনি বলেন, “বহুতল আবাসনে সাবমারসিবল পাম্প দিয়ে ভূগর্ভের জল তুলে নেওয়ায় জলস্তর নেমে যাচ্ছে। তার ফলে একতলা ও দোতলা বাড়ির লোকজন সাধারণ নলকূপ থেকে জল পাচ্ছে না। পানীয় জলের সঙ্কট হয়েছে।” রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরির পাল্টা প্রশ্ন, “সারা রাজ্য জুড়েই ভূগর্ভের জলস্তর নেমে যাচ্ছে। তার জন্য কি বহরমপুর পুরসভা দায়ী?”
১৮৯৪ সালে মহারানি স্বর্ণময়ীর দানে গড়ে ওঠে কুঞ্জঘাটায় জলকল প্রকল্প। পরবর্তীতে গ্রান্টহলের কাছে গড়ে তোলা হয় জলট্যাঙ্ক। পরে শহরের বিভিন্ন এলাকায় আরও কয়েকটি জল প্রকল্প গড়ে ওঠে। ওই সব প্রকল্প মিলিয়ে বর্তমানে দৈনিক মোট ১১ লক্ষ গ্যালন জল সরবরাহের করা হয়। এ কথা জানিয়ে পুরপ্রধান নীলরতন আঢ্যের বলেন, “অথচ দৈনিক প্রয়োজন ২৭ লক্ষ গ্যালন জল। সেই ঘাটতি মেটাতে আর্সেনিক দূষণমুক্ত পানীয় জলের একটি প্রকল্প গড়তে সাঁসদ অধীর চৌধুরির উদ্যোগে কেন্দ্র ৩১ কোটি টাকা দিয়েছে। প্রকল্প থেকে দৈনিক ৩০ লক্ষ গ্যালন পানীয় জল সরবরাহ করা হবে। প্রকল্পটির প্রথম পর্যায় ডিসেম্বর মাসে চালু হবে। পরবর্তী কাজ শেষ হবে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে। তখন ভূগর্ভের জল তোলার প্রয়োজন পড়বে না।” |