জীবনের বৃত্তটা বোধহয় সম্পূর্ণ হবে।
আজকের মতো সেটাও ছিল দিল্লির শীতের এক সকাল। বাংলার ড্রেসিংরুমে বসা ছেলেটার কত বয়স হবে? সতেরো কী আঠারো? ও আজ খেলবে না, ও আজ টুয়েলফথ ম্যান। মুখচোখে তবু আলগা ভাললাগা, শিরশিরে উত্তেজনা।
আজ আবার দিল্লি, আজ আবার এক শীতের সকাল। বাংলার ড্রেসিংরুমে আজও পাওয়া যাবে বছর পনেরো আগের ওই ছেলেটাকে।
ও আজ খেলবে। ও আজ ক্যাপ্টেন!
লক্ষ্মীরতন শুক্লের সামনে বৃহস্পতিবার এমন একটা মাইলস্টোন, যা এর আগে স্পর্শ করতে পারেননি বঙ্গজ কোনও ক্রিকেটার। আঠারো বছরের ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ কেরিয়ারে সেঞ্চুরি এসেছে অনেক। তবে এ রকম সেঞ্চুরি এই প্রথম। বাংলার হয়ে রঞ্জি ম্যাচ খেলার সেঞ্চুরি।
তবু এত স্পেশ্যাল একটা ম্যাচও কি না তাঁর কাছে ‘জাস্ট অ্যানাদার’ ম্যাচ! “সত্যি বলতে কী, আমার মনেও ছিল না যে একশোটা ম্যাচ খেলতে নামছি। টিমমেটরাই বলল,” দিল্লি থেকে ফোনে বলছিলেন লক্ষ্মী। তাঁর একশোতম নিয়ে মাতামাতি করতে যিনি বারণ করে দিয়েছেন সতীর্থদের। যিনি নিজেও ম্যাচটাকে দেখছেন স্রেফ বাংলা বনাম সার্ভিসেস হিসেবে। যে বিশেষ ম্যাচের আগের দিন তাঁর রুটিনে পার্টি নেই, প্র্যাকটিস আছে। আত্মতুষ্টি নেই, সংকল্প আছে।
যা না থাকলে লক্ষ্মীর জীবনে আজকের দিনটা বোধহয় আসত না। অনূর্ধ্ব তেরো টুর্নামেন্টে চরণজিৎ সিংহের টিমের হয়ে ১৩৬ দিয়ে শুরু। যে সময় তাঁর ‘কনট্রাস্ট’ সুইং তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ময়দানকে। তার পর গোড়ালির চোটে বলের গতি কমে যাওয়া, আর ব্যাটিংয়ে মন। মুগ্ধ ময়দানের ফের অবাক হয়ে দেখা, ব্যক্তিগত কোনও কোচ ছাড়াই কী ভাবে একজন নিজেই নিজেকে ব্যাটিংয়ের ‘এ-বি-সি-ডি’ শেখাচ্ছে! কী ভাবে অরুণলাল, উৎপল চট্টোপাধ্যায়, দেবাঙ্গ গাঁধীদের যুগ শেষে ময়দানে জন্ম নিচ্ছে ‘শুক্ল-পক্ষ।’
|
মাহেন্দ্রক্ষণের পূর্বলগ্নেও এ দিন সন্ধেয় ময়দানের কেউ কেউ আফসোস করছিলেন, লক্ষ্মীর প্রতিভার দশ শতাংশই দেখল বাংলা ক্রিকেট। বাকি নব্বই শতাংশ কেড়ে নিল গোড়ালির ওই চোট, আর ভারতীয় টিমে সময়ের আগে ঢোকা। ইন্ডিয়া জার্সিতে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ খেলার বছর দুয়েকের মধ্যে যে ডাক আসে, স্বপ্নভঙ্গও আসে পিছু পিছু। অন্য কেউ হলে হয়তো সেই বিপর্যয়ের ধাক্কা সামলে উঠতে পারতেন না। কিন্তু লক্ষ্মী অন্য ধাতু দিয়ে তৈরি। যাঁর অভিধানে ‘অতীত’ বলে কোনও শব্দ নেই। যিনি পিছনে ফিরে দেখায় বিশ্বাস করেন না। বাংলার প্রতি দায়বদ্ধতা যাঁর জীবনের ধ্রুবতারা। “তখন অনেকে বলেছিল, তুই অন্য রাজ্যে চেষ্টা কর। বাংলার প্লেয়াররা তো সে ভাবে ব্যাকিং পায় না,” বলতে বলতেই লক্ষ্মী ছুড়ে দেন প্রশ্ন, “বাংলার হয়ে খেলাটাকে কী ভাবে কেউ জাতীয় দলে ঢোকার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেখতে পারে?”
কেউ কেউ দেখলেও লক্ষ্মী সেটা পারেননি। পারেন না। শততম রঞ্জি খেলতে নামার আগেও তাই তাঁর ভাবনায় নিজের আগে আসে নিজের টিম। হাঁটুর চোটে আইপিএল থেকে ছিটকে গিয়েও টানা তিন মাস ভোরে পৌঁছে যান ইডেনের ইন্ডোরে রঞ্জি আসছে, নিজেকে ফিট করে তুলতে হবে! ইডেনে পা রাখলে তাই তাঁর মনে হয়, এই তো নিজের বাড়িতে ঢুকলাম। ক্রিকেটজীবনের সায়াহ্নে পৌঁছেও ভাবেন, ভাল পারফর্ম না করতে পারলে টিমে তাঁর জায়গাটা নিশ্চিত নয়। ৯৯তম ম্যাচে দেড়শো করে উঠেও বলতে পারেন, “আমি খুব সাধারণ ক্রিকেটার। পরিবারের সমর্থন, বন্ধুদের ভালবাসা, এ সব না থাকলে একশোটা ম্যাচ খেলতেই পারতাম না।”
‘সমর্থন আর ভালবাসা’ যে কী হতে পারে, বাংলা অধিনায়কের ফেসবুক আর টুইটার প্রোফাইল না দেখলে বোঝা অসম্ভব। একশো ম্যাচে নামার অনেক আগে থেকেই আসতে শুরু করেছে পরপর শুভেচ্ছাবার্তা। সিএবি থেকে উপহার পেয়েছেন ‘১০০ রঞ্জি’ লেখা বিশেষ জার্সি। সিএবি কোষাধ্যক্ষ বিশ্বরূপ দে বুধবার রাতেই কানপুর থেকে উড়ে গিয়েছেন দিল্লি। সংবর্ধনার ব্যবস্থা সমেত। যা ম্যাচ শুরুর আগে দেওয়া হবে, যেখানে থাকবে ‘১০০’ লেখা পাগড়ি, থাকবে বিশেষ শাল, থাকবে গোলাপ ফুলের একশোটা তোড়া। “লক্ষ্মীকে জানাইনি ব্যাপারটা। তবে ইডেনে বড় করে হবে,” বলছিলেন বিশ্বরূপ। লক্ষ্মীর টিমও ক্যাপ্টেনকে ‘কিছু একটা’ দিতে চায়, যদিও ম্যাচ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে সবে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন লক্ষ্মী স্বয়ং।
কেরিয়ারের সবচেয়ে বড় মুহূর্তের আগেও যাঁর ক্রিকেট-পৃথিবীর কক্ষপথে বদল নেই। অতীত-বর্তমান ভুলে চোখ এখনও ভবিষ্যতে। মুম্বইকে একা ধ্বংস করে বিজয় হাজারে জিতলেও তো বলে দিতে পারেন, “রঞ্জিটা চাই। না হলে খেলা ছাড়ার পরেও নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারব না।”
বাংলার জন্য, বাঙালির জন্য ক’জন এমন ভাবেন, জানা নেই। তবে বাংলা ক্রিকেট জানে, পনেরো বছর আগের সেই ‘দ্বাদশ ব্যক্তি’ আজও বিপদে তার রক্ষাকবচ। ওই তিনটে অক্ষর আজও স্বপ্নের সবুজ রং।
এলআরএস! |