দেবাশিস দাশ ও শান্তনু ঘোষ • কলকাতা |
‘রেতে মশা দিনে মাছি
এই নিয়েই কলকেতায় আছি।’
ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার এই লাইনটাই আক্ষরিক অর্থে হাওড়ার চেনা ছবি হয়ে উঠেছিল!
বাসিন্দাদের অভিযোগ, ৫০০ বছরেরও পুরনো এই শহরে দিনের পর দিন নর্দমা উপচে রাস্তায় নোংরা জল গড়িয়েছে। আবর্জনার স্তূপ জমেছে। ভাঙাচোরা পথে ঘটেছে দুর্ঘটনা। বর্ষার জমা জলে ঘরবন্দি হয়ে কেটেছে। অন্ধকার রাস্তায় ছিনতাইয়ের শিকার হতে হয়েছে। এমনকী, বেআইনি বহুতলের দৌলতে এককালের ‘শেফিল্ড অফ ইস্ট’ হাওড়া শহর জতুগৃহ হয়ে উঠেছে বলেও দাবি বাসিন্দাদের। |
এই পরিস্থিতিতেই ৩০ বছর পরে বামেদের সরিয়ে বিপুল ভোটে জিতে হাওড়া পুর-বোর্ডে ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল। স্বভাবতই তৈরি হয়েছে প্রত্যাশার চাপ। হাওড়ার চেনা ভোগান্তির ছবিটা পাল্টাবে, আশায় বাসিন্দারা। ভোটের প্রচারে এসে হাওড়ার উন্নয়নে একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। পুর-ভোটের ফল ঘোষণার পরে তিনি বলেন, “আগে থেকেই হাওড়াকে সাজানোর পরিকল্পনা ছকে রেখেছিলাম। এ বার তা বাস্তবায়িত করতে হবে। সবার আগে একটা মাস্টার প্ল্যান করতে হবে। ৩৪ বছর শহরটার উন্নয়ন হয়নি। তাকে ঠিক করতে অনেক টাকার দরকার। তাই তিন চার বছরে ভাগ করে কাজটা করতে হবে।”
সবার আগে হাওড়ার সমস্ত রাস্তাঘাট সারানো হবে বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য পুর দফতর। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী অন্যান্য উন্নয়নের কাজের প্রাথমিক রূপরেখা হল—
১) শহরের কোন কোন এলাকায় বর্ষায় জল জমে, তার তালিকা তৈরি করা। কেন জল জমে আর কেনই বা তা বেরোতে পারে না, তা-ও অনুসন্ধান করা। পাশাপাশি দেখা জমা জল বার করতে ক’টি নতুন পাম্পিং স্টেশন তৈরি করা যায়। শহরের নিকাশি নালা, খালগুলির কাজ কতটা এগিয়েছে, সেগুলিও সরেজমিন দেখা।
২) পদ্মপুকুর ছাড়া আর কোনও জলপ্রকল্প দরকার কি না, তা সমীক্ষা করা। পাশাপাশি শহরের লোকসংখ্যা ও কলকারখানার নিরিখে প্রতিদিন কত জল দরকার, সেই তুলনায় কত জল উৎপাদন হচ্ছে, তারও সমীক্ষা করা।
৩) ৫০টি ওয়ার্ডে ক’টি ভ্যাট রয়েছে, সেগুলির অবস্থান ও পরিকাঠামো যথাযথ কি না, তা খতিয়ে দেখা। নিয়মিত নির্দিষ্ট সময়ে তা সাফাইয়ের বন্দোবস্ত করা।
৪) শহরের অনেক রাস্তা, গলিতে আলো নেই। সেখানে আলো লাগানো। বেআইনি নির্মাণ রোধে একদম প্রথম দিন থেকেই কড়া পদক্ষেপ করা।
বাসিন্দাদের অভিযোগ, হাওড়া শহরের সব থেকে বড় সমস্যা ছিল রাস্তাঘাট। শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণে রাজপথ থেকে অলিগলি সর্বত্রই খানাখন্দে ভর্তি। ভাঙা রাস্তার দৌলতে বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতাও তিক্ত। যেমন, উত্তর হাওড়ার বাসিন্দা সৌমেন রায়ের কথায়, “সাইকেল বা মোটরবাইক নিয়ে ভাঙা রাস্তায় চলতে-চলতে কোমরে ব্যথা হয়ে গিয়েছে।” তবে যে সমস্ত রাস্তা দীর্ঘ ১০ বছরে সারানো হয়নি, সেই সমস্ত রাস্তার একাংশ ভোটের কয়েক দিন আগে তড়িঘড়ি করে সারানো হয়েছে বলেই দাবি বাসিন্দাদের। তবে তার স্থায়িত্ব নিয়ে সংশয় রয়েছে খোদ পুরকর্তাদের একাংশেরই।
ভাঙা রাস্তার সঙ্গেই তাল মিলিয়ে নিকাশিও শহরের আর এক বড় সমস্যা বলেই অভিযোগ বাসিন্দাদের। অভিযোগ, জেএনএনইউআরএম প্রকল্পে শহরের নিকাশির কাজ শুরু হলেও আজও তা শেষ হয়নি। বেলিলিয়াস রোডের মাত্র ১৫ মিটার অংশের কাজ গত আড়াই বছর ধরে বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। ওই কাজের জন্য এলাকায় যানচলাচল বন্ধ। যার জেরে প্রতিনিয়ত যানজটের শিকার হচ্ছে কদমতলা এলাকা। নিকাশি প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় ফি বছর বর্ষায় জলবন্দি হয়ে থাকেন হাওড়ার মানুষ।
|
৫ পরিকল্পনা |
• রাস্তাঘাটের উন্নয়ন
• পর্যাপ্ত পানীয় জল
• জঞ্জাল সাফাই
• নিকাশির উন্নয়ন
• বেআইনি নির্মাণ বন্ধ |
|
২নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা তথা হাওড়া চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি শঙ্কর সান্যাল বলেন, “রাজস্বের পরিমাণ বেড়ে চলেছে। কিন্তু প্রাপ্তি বলতে জল জমা, ভাঙা রাস্তা ও আবর্জনার পাহাড়। ঘুন ধরা শহরটার সার্বিক বদলাতে হবে।”
তবে শুধু জমা জল আর ভাঙা রাস্তাই নয়। বাসিন্দাদের অভিযোগ, সামান্য মশা তাড়াতেও এত দিন ব্যর্থ ছিল এই পুরসভা। জগাছার বাসিন্দা সাহিত্যিক ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের সরস মন্তব্য, “আমার এলাকায় যত মশা রয়েছে, মনে হয় পুরীর সমুদ্রেও ততটা বালি নেই। মশারি টাঙিয়ে লিখতে বসতে হয়। না হলে মশা মারতেই সময় চলে যায়।” তবে তিনি মনে করেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন রাজ্যের প্রধান প্রশাসনিক কার্যালয়কে হাওড়ায় আনতে পেরেছেন, তখন তিনিই পারবেন শহরটাকে বদলাতে।
প্রতি বছর গরমে হাওড়া শহর কার্যত মরুভূমির আকার ধারণ করে বলেও অভিযোগ বাসিন্দাদের। তাঁদের কথায়, পদ্মপুকুর জলপ্রকল্পের পাইপলাইন দীর্ঘ দিন সাফ না হওয়ায় পানীয় জলের স্রোত খুবই কম। প্রকল্পের ৯টি পাম্পের ৪টি অকেজো। দৈনিক ৭০ কোটি গ্যালন জলের চাহিদা থাকলেও ৪০-৫০ কোটি গ্যালনের বেশি উৎপাদন হয় না। নিয়মিত জঞ্জাল না সরানোয় নাকে রুমাল চেপে পথ চলতে হয়।
জগাছার বাসিন্দা অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষ বলেন, “নতুন পুর বোর্ড ও সরকারের কাছে অনুরোধ, হাওড়ায় উঠে আসা ঝাঁ চকচকে প্রশাসনিক ভবনের মতোই শহরের চিকিৎসা ব্যবস্থা, নিকাশি, রাস্তাঘাটগুলিও ঝাঁ চকচকে করে তুলুন। বিগত পুর বোর্ড যে উন্নয়নের কাজগুলি করেননি, আপনারা দয়া করে সেগুলি করুন।” পঞ্চাননতলার বাসিন্দা অভিনেত্রী সায়নী দত্তর কথায়, “লন্ডন না হোক। হাওড়াটা অন্তত কলকাতা তো হতে পারে। নিকাশির উন্নয়ন, রাস্তায় দখলদারি সরানো, যানজট, ভাঙা রাস্তা মেরামতির কাজটুকু অন্তত হোক।”
মানুষের যাবতীয় অভিযোগ এ বার ঘোচাতে বদ্ধ পরিকর নতুন তৃণমূল বোর্ডও। ফিরহাদ জানান, পুরসভার প্রথম বোর্ড মিটিংয়ে টাউন প্ল্যানারকে নিয়ে তিনি নিজে উপস্থিত থাকবেন। প্রয়োজন হলে কেএমডিএ থেকে প্ল্যানারকে নিয়ে যাওয়া হবে হাওড়ার উন্নয়নের পরিকল্পনা করতে। মন্ত্রী তথা তৃণমূলের জেলা সভাপতি (শহর) অরূপ রায়ের কথায়, “মানুষ যাতে সুস্থ ভাবে বাঁচতে পারেন তার জন্য প্রথমেই পানীয় জলের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করতে হবে। সঙ্গে নিকাশির জল বার করারও সুব্যবস্থা করতে হবে। ধীরে ধীরে শহরটাকে বদলে ফেলাই আমাদের লক্ষ্য।” জেলার আর এক মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেন, “মানুষ বিশ্বাস করে পুরসভায় এই পরিবর্তন এনেছেন। সেই বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে আমরাও প্রস্তুত।” আর পুরমন্ত্রীর আশা, কলকাতা শহরকে যখন মুখ্যমন্ত্রী লন্ডন বানাতে চাইছেন, তখন হাওড়া হয়ে উঠুক ম্যানচেস্টার। |