প্রবন্ধ ২...
‘ঈশ্বর’ বলে আসলে কিছু নেই, ওটা গুজব
নপ্রিয়তার দৌড়ে এই মুহূর্তে ভারতের এক নম্বর কে, তা নিয়ে তর্কের সম্ভাবনাই নেই। সচিন তেন্ডুলকর। আর, এই দৌড়ে লাস্ট বয়ের নামটিও একই রকম তর্কাতীত মনমোহন সিংহ। এ বার যদি বলি, মনমোহন সিংহ না থাকলে সচিন তেন্ডুলকরও থাকতেন না, অন্তত এমন ঐশ্বরিক মহিমা নিয়ে নয়, কত জন একমত হবেন?
এক জন যে হবেনই, বাজি ধরতে পারি। তিনি সাংবাদিক সুমিত চক্রবর্তী। সম্প্রতি ‘মাস্টার লাস্টার: হোয়াট দে ডোন্ট টেল ইউ অ্যাবাউট সচিন তেন্ডুলকর’ (হে হাউস পাবলিশার্স) নামে একটি বই লিখেছেন এই ক্রীড়া সাংবাদিক। ১৯৪ পাতা জুড়ে, সচিনের ২৪ বছরের কেরিয়ারের বিভিন্ন পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে, তিনি কিছু বিস্ফোরক তথ্য তুলে এনেছেন। কয়েকটা তথ্য পেশ করা যাক।
, তাঁর ২০০ টেস্টের কেরিয়ারে মাত্র দুটো ইনিংস রয়েছে, যেখানে তিনি একই সঙ্গে তিনটি শর্ত কঠিন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কঠিন উইকেটে, চতুর্থ ইনিংসের প্রবল চাপ সামলে, ম্যাচ বাঁচানো বা জেতানো ইনিংস খেলেছেন। দুটোই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে এবং ১৮ বছরের ব্যবধানে। প্রথমটি ওল্ড ট্রাফোর্ডে ১৯৯০ সালে ১১৯ নট আউট, এবং দ্বিতীয়টি ২০০৮ সালে চিপকে ১০৩ নট আউট। সচিনের ৫১টি সেঞ্চুরি বিশ্লেষণ করে সুমিত দেখিয়েছেন, আর কোনও ইনিংস সম্পর্কে এই কথা বলার উপায় নেই। বরং, তাঁর ১৩টি সেঞ্চুরি, মোট সেঞ্চুরির সিকিভাগ, এই তিনটি শর্তের একটিও পূরণ করে না।
, এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে সচিনের ৪৯টি সেঞ্চুরি। সেই খেলাগুলোর মধ্যে ভারত হেরেছিল ১৬টা খেলায় (বাংলাদেশের সঙ্গে যে ম্যাচে সচিন ‘শততম শতরান’ করেন, সেটাও এই তালিকায় আছে)। অর্থাৎ, ওপেনার হিসেবে নেমে সচিন ১০০ বা তার বেশি রান করার পরেও ভারত ৩৩ শতাংশ ম্যাচ হেরেছে। তাঁর দুই ওপেনিং পার্টনার, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং বীরেন্দ্র সহবাগ যে ম্যাচগুলোয় শতরান করেছেন, তার মধ্যে ভারত জিতেছে যথাক্রমে ৮২ শতাংশ এবং ৯৩ শতাংশ। সচিন তাঁর শেষ ২৪টি শতরান যে ম্যাচগুলোয় করেছেন, তার মধ্যে ভারত জিতেছে মাত্র ৫২ শতাংশ। আর, সচিনের শেষ চারটি শতরানের তিনটিতেই ভারত হেরেছে। লেখকের বিশ্লেষণ সচিন ব্যক্তিগত রেকর্ডের দিকে তাকিয়ে দলের কথা ভাবতে ভুলে গিয়েছিলেন। তাঁর স্লো স্কোরিং রেটই ভারতকে হারিয়েছে।
, নিজেদের কেরিয়ারের বছরগুলোয় দলের মোট রানের ১৫ শতাংশ বা তার বেশি করেছেন, গোটা দুনিয়ায় এমন ৪৫ জন ক্রিকেটার আছেন। সচিন সেই তালিকাতেই নেই। ব্রায়ান লারা আছেন তিন নম্বরে, এবং সুনীল মনোহর গাওস্কর ১৬ নম্বরে।

মুখ ঢেকে যায়। ভারতের বিজ্ঞাপনের বাজার ‘আইকন’ সচিনকেই চেয়েছে।
সুমিত চক্রবর্তীর মূল প্রতিপাদ্য তিনটি।
, সচিনের রেকর্ড দেখে ভারতীয় ক্রিকেটে তাঁর গুরুত্বের আঁচ পাওয়া যাবে না। তাঁর রানের সিংহভাগ এই উপমহাদেশের পাটা উইকেটে, এবং দুর্বল দলের বিরুদ্ধে।
, বহু দিন ধরেই তিনি দেশের চেয়ে নিজের রেকর্ডকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
, সচিন বড় মঞ্চে, উত্তুঙ্গ চাপের মুখে অনেক কম সফল।
তাঁর যুক্তির সবটাই তর্কাতীত নয়। মোট পরিসংখ্যান দেখে যেমন সবটা বোঝা যায় না, কাটাছেঁড়াতেও সব কথা ধরা পড়ে না। রেকর্ড বই বলবে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চিপকে তিনি জয়ের মাত্র ১৭ রান আগে আউট হয়ে গিয়েছিলেন, এবং ভারতীয় দলের টেল-এন্ডাররা সেই রানটুকুও তুলতে পারেননি। কিন্তু এই কথাটা বলবে না, কোন শারীরিক অবস্থায় সেই ১৫৫ রান করেছিলেন সচিন। তর্ক থাকবেই।
কিন্তু সব তর্কের বাইরে একটা কথা বলা যায় সচিনকে যে ‘ঈশ্বরের সমতুল্য’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, সেটা বাড়াবাড়ি। ঈশ্বর বলে আসলে কিছু নেই। ওটা নিতান্তই গুজব।
কিন্তু সেই গুজবটি যে তৈরি হল, এবং প্রশ্নাতীত সত্যের স্বীকৃতি পেল, সেটা কি মনমোহন সিংহ নামক মৃদুভাষী অর্থনীতিবিদ না থাকলে হত? প্রধানমন্ত্রী নন, অর্থমন্ত্রী মনমোহন। ভারতে উদার অর্থনীতি এবং বাজার ঢুকেছিল যাঁর হাত ধরে। সচিন তেন্ডুলকর নামক ‘ফেনোমেনন’-টিকে বুঝতে হলে বাজারকে অস্বীকার করলে চলবে না কিছুতেই। স্বীকার করতে হবে সেই সমাপতনকে সচিনের উত্থান, বাজার উন্মুক্ত হওয়া ও স্যাটেলাইট টেলিভিশনের বিস্ফোরণ প্রায় একই সঙ্গে ঘটেছিল এই তিনটি ঘটনা। এই সময়েই ক্রিকেট খেলা থেকে ধর্ম হয়ে উঠতে আরম্ভ করল, এই সময়েই ভারত হয়ে উঠল ক্রিকেটের বৃহত্তম বাজার।
গত শতকের শেষ দশক থেকে ক্রিকেট আর বলিউড এমন অভিন্ন অস্তিত্ব হয়ে উঠল কী করে? সচিনের ফেয়ারওয়েল পার্টিতে কেন উপস্থিত থাকেন বলিউডের হুজ হু-রা? এই প্রশ্নের উত্তর আছে বিজ্ঞাপনের বাজারে। ভারতের ত্রিশ কোটি ক্রয়ক্ষমতাসম্পন্ন মধ্যবিত্ত ক্রিকেট আর বলিউডেই মজেছে। ফলে, পণ্য বেচতে হলে এই দুই দুনিয়াই ভরসা। লিও বার্নেট সাউথ এশিয়ার চিফ ক্রিয়েটিভ অফিসার কে ভি শ্রীধর মন্তব্য করেছেন, ‘সচিন ঠিক মহাত্মা গাঁধীর মতো ব্র্যান্ড নন, আইকন। তাঁর সঙ্গে এক জনেরই তুলনা চলতে পারে। তিনি অমিতাভ বচ্চন।’ বাজার ক্রিকেটার আর অভিনেতায় ফারাক করে না। যাঁকে দেখে মানুষ জিনিস কিনবে, বিজ্ঞাপন তাঁকেই দেখাবে। তিনি ‘আইকন’ হলে অনেক বেশি পণ্য, দামি পণ্য আসবে তাঁর দিকে।
সচিনের ২৪ বছরের কেরিয়ার জুড়ে থাকা বিজ্ঞাপনগুলোর দিকে তাকাতে পারেন। পেপসি, আদিদাস, এম আর এফ, ক্যানন, তোশিবা, ফিলিপস, ভিসা, রয়্যাল ব্যাঙ্ক অব স্কটল্যান্ড, ক্যাস্ট্রল, ফিয়াট প্যালিও, ইএসপিএন স্টার স্পোর্টস, আভিভা, রিলায়েন্স লম্বা তালিকা। বিজ্ঞাপনবাবদ সচিনের সারা জীবনের আয় প্রায় পাঁচশো কোটি টাকা। কিন্তু, তাঁর হাত ধরে মোট ক’হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করছে সংস্থাগুলো, সে হিসেব কষে দেখলে ঘিলু পিলপিলিয়ে যেতে পারে।
পাঁচশো কোটি টাকা রোজগার করার জন্য এই সংস্থাগুলোকে সচিনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সচিনকে একই রকম, বা তার চেয়েও বেশি, প্রয়োজন ছিল এই সংস্থাগুলির। ক্রিকেটার সচিন নন, ‘আইকন’ সচিন। ‘ঈশ্বর’ সচিন। মহানায়ক হয়ে ওঠার কিছু মসলা নিয়েই তাঁর আবির্ভাব। একটা ষোলো বছরের ছেলে ইমরান খান, ওয়াসিম আক্রমকে খেলে দিচ্ছে নির্ভয়ে মহানায়ক হওয়ার নির্ভুল চিত্রনাট্য। এবং, চূড়ান্ত সফল হওয়ার পরেও সেই ছেলেটা ‘পাশের বাড়ির ছেলে’ হয়েই থেকে যাচ্ছে, হাসিতেও অমলিন থাকছে তার সরলতা, হেলমেটে থাকছে তেরঙ্গা স্টিকার মন জিতে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। বিশ্বায়িত ভারতের প্রত্যয় আর সনাতন ভারতের মূল্যবোধের একেবারে নিখুঁত মিশেল। হয়তো আরও কুড়ি বছর পরে কোনও ক্রীড়া সাংবাদিকের বিস্ফোরক আত্মজীবনীতে সচিনের কোনও দুর্বল মুহূর্তের গল্প, বা হয়তো তেমন কিছু কখনও ছিলই না কিন্তু ২৪ বছরে একটি বারও কোনও বিতর্কে জড়িয়ে না পড়াও ঈশ্বর হয়ে ওঠার উপাদান।
এর পর বাকি থাকে একটামাত্র কাজ ধারাবাহিক ভাবে রান করে যাওয়া। সচিন যে সব সময় পেরেছেন, তা নয়। কিন্তু তাঁকে দল থেকে বাদ দেওয়ার কথা উচ্চারিত হয়নি কখনও। বোর্ড কর্তারা বলেছেন, সচিন কবে খেলা ছাড়বেন, সেটা ঠিক করবেন তিনি নিজেই। খারাপ খেলেও দলে থেকে যাওয়া যায়, তার বহু প্রমাণ আছে। ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ায় পর পর দুটো সিরিজে ০-৪ হারার পরেও দলের অধিনায়ক থাকতে পারেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। কিন্তু তাঁর জন্য এন শ্রীনিবাসন ছিলেন। সৌরভের ছিলেন জগমোহন ডালমিয়া। সচিনের এমন কোনও রক্ষাকর্তার নাম মনে পড়ছে কি? স্মৃতির দোষ নয়। আসলে সচিনকে বাঁচাতে কোনও মানুষের প্রয়োজন পড়েনি। তাঁর জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্রিকেট বাজার ছিল। অতএব, ধারাভাষ্যকার থেকে বিজ্ঞাপনের কপি রাইটার অথবা কোনও সাংবাদিক সচিনের খারাপ ফর্ম, রানের অভাব অথবা মন্থরতায় কেউ টুঁ শব্দটি করেননি সচরাচর। হ্যাঁ, সচিন পুষিয়ে দিয়েছেন রানের পাহাড় দিয়ে। সেই রানে দল জিতুক আর না-ই জিতুক, সেটা অন্য তর্ক।
রাজবাড়িতে ভোজের স্বরচিত গল্পে যেমন মোল্লা নাসিরুদ্দিনও শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন, মিডিয়াও তেমনই সচিনের ঈশ্বর হয়ে ওঠার গল্প বিশ্বাস করে নিয়েছে। মানুষও। এই পুরো ছবিটা মাথায় রাখলে সুমিত চক্রবর্তীর ধাঁধার উত্তর পাওয়া যায়। ম্যাচ বাঁচানো বা জেতানো নয়, ২৪ বছর ধরে তাঁর রেকর্ডের দাপটেই অতিমানবিক হয়ে উঠেছেন সচিন। সেই রেকর্ডের পিছনে দৌড়েছেন তিনি, কারণ রেকর্ডই তাঁর বাজার ধরে রেখেছে। সচিন তেন্ডুলকর আসলে সেই বাজারের ঈশ্বর, যিনি ছুয়ে দিলে মাটিও সোনা হয়ে যায়।
কথাটা সুমিত চক্রবর্তীও বিলক্ষণ জানেন। নয়তো, এই উদ্দাম সচিন-পুজোর বাজারেই নিজের বইটি প্রকাশ করবেন কেন?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.