স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে বলেছিলেন ‘আঠারো শতকের শ্রেষ্ঠ ভারতীয়দের অন্যতম’। হাজি মহম্মদ মহসিন (১৭৩২-১৮১২) ছিলেন এক বিস্ময়কর মানুষ, যিনি নিজেকে নিঃস্ব করে সমগ্র ভূ-সম্পত্তি দরিদ্র মানুষের সেবায় দান করেছিলেন, যার সুফল প্রায় দু’শো বছর ধরে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী, দরিদ্র অনাথ, অসহায় বঙ্গবাসী ভোগ করেছে। আজও করছে। শুধু দাতা নয়, এক জন মহান মানুষের সর্বগুণের বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে মহসিনের জীবনে। যাঁর এক দিকে রয়েছে ধার্মিকতা, উদারতা, মানবতা, অন্য দিকে প্রগতিশীলতা, পাণ্ডিত্য, শিক্ষানুরাগ।
লক্ষণীয়, ভারতে শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের দু’জন অগ্রনায়ক রামমোহন রায় ও সৈয়দ আহমদ খানের কর্মময় জীবনের বহু পূর্বে মহসিনের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। ১৮০৬ সালের ২০ এপ্রিল মহসিন তাঁর বিশাল ভূ-সম্পত্তি মূলত মুসলিমদের আর্থিক ও শিক্ষাগত কল্যাণে দান করেন। দানপত্রে স্থির হয়, ব্রিটিশ সরকারের প্রাপ্য রাজস্ব মিটিয়ে জমির অবশিষ্ট আয় থেকে প্রাপ্ত অর্থ নয় ভাগ করা হবে। যার অন্তত তিন ভাগ মাদ্রাসা-সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালানো, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের অনুদান, চিকিৎসা, রাস্তাঘাট নির্মাণ, পুকুর খনন ইত্যাদি কার্যাদিসহ ধর্মানুষ্ঠানের খাতে ব্যয় হবে।
১৮৩৫ সালে ব্রিটিশ গভর্নর চার্লস মেটকাফের হস্তক্ষেপে গঠিত হয় ‘মহসিন শিক্ষা তহবিল’। শুরু হয় মহসিনের অর্থে শিক্ষা বিস্তারের স্বর্ণযুগ। বাস্তবে মহসিনের ওয়াকফ থেকে সংগৃহীত বিপুল অর্থের যথাযথ বাস্তবায়নে ব্রিটিশ সরকার উপযুক্ত সময়ে হস্তক্ষেপ ও বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিচালনা না করলে মহসিনের স্বপ্নই বিফল হত।
১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষানুরাগী মেটকাফের উদ্যোগে মহসিনের অর্থে হুগলি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণে এই কলেজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বর্তমানে এটি হুগলি মহসিন কলেজ নামে পরিচিত। এই কলেজের কৃতী ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, বিপ্লবী কানাইলাল, সৈয়দ আমির আলি, মহম্মদ শহীদুল্লাহের মতো অসংখ্য ব্যক্তিত্ব। ১৮৭৩-এর ১৩ জুন থেকে মহসিন ফান্ডের বদলে সরকারি অর্থে এই কলেজ চালানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অন্যত্র মহসিন ফান্ডের অর্থে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি পায়। গড়ে ওঠে হুগলি কলেজিয়েট স্কুল, হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুল, হুগলি মাদ্রাসা ইত্যাদি।
মহসিনের জন্মভূমি হুগলির সমৃদ্ধিতে তাঁর দান চিরস্মরণীয়। হুগলি-চুঁচুড়া পুরসভায় জল সরবরাহ স্বাস্থ্য পরিষেবার ভিত তৈরি হয়েছিল মহসিনের অর্থে। এখানে মহসিনের দান করা জমিতে গড়ে উঠেছে রেলের জুবিলি ব্রিজ (হুগলি) ও নির্মীয়মাণ ব্রিজ, চুঁচুড়া থানা, ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাঙ্ক, আরও নানা প্রতিষ্ঠান। এখানেই গঙ্গার তীরে মহসিনের অর্থে ৪২ বিঘা জুড়ে নির্মিত হয়েছে ‘হুগলি ইমামবাড়া’।
বহু দেশ ভ্রমণকারী, জ্ঞানপিপাসু, আপাদমস্তক আধুনিক, সুপণ্ডিত মহসিন বুঝেছিলেন, শুধু ধর্মীয় শিক্ষা নয়, আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় নিজেদের জাগ্রত করতে না পারলে জাতির মুক্তি নেই। আগে স্বাস্থ্য পরিষেবার কথাও ভেবেছিলেন মানবদরদি মহসিন। তাই তাঁর অর্থে ১৮৩৬ সালে ইমামবাড়া হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়, যে পরিষেবা আজও চলছে। বাংলাদেশেও রয়েছে একাধিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। মহসিন ফান্ডের অর্থে দরিদ্র মেধাবী ছাত্ররা যুগ যুগ ধরে স্কলারশিপ পাচ্ছে। অর্ধবেতনে বা বিনাবেতনে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পেয়েছে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী। এই ধারা আজও বন্ধ হয়নি।
দীর্ঘকাল এ বাংলায় তাঁর চর্চা নেই। অথচ আধুনিক বাংলার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহণ, পানীয় জল, পর্যটন, হেরিটেজ ইত্যাদি খাতে মহসিনের দান আমরা আজও ভোগ করছি। প্রশ্ন হল, দানশীলতা, শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে ভূমিকার জন্য যদি আমরা রামমোহন, বিদ্যাসাগরের স্বীকৃতি দিই, তা হলে মহসিনকে নয় কেন? |