|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা এত ভীরু কেন
‘সেকুলার’ রাজনীতি এখন এজেন্ডা স্থির করে না, কেবল কৈফিয়ত খোঁজে।
এই পরাশ্রিত ধর্মনিরপেক্ষতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই সঙ্ঘ পরিবার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চাইছে।
জয়ন্ত ঘোষাল |
বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার ঘোষণা করেছেন, পশ্চিম চম্পারণ জেলায় তিনি এক বিশাল রামমন্দির নির্মাণ করবেন। বল্লভভাই পটেলের মতো সুউচ্চ হতে পারে রামের সেই মূর্তি। নরেন্দ্র মোদীর ইটের জবাবে তাঁর পাটকেল। এই লড়াইয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার কোনও ভূমিকাই আর নেই তবে?
আছে, কিন্তু সেই ভূমিকা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে না, সে স্বভাবে পরাশ্রিত। নীতীশ কুমার দৃষ্টান্তমাত্র, গোটা দেশ জুড়ে প্রাক্নির্বাচনী বিতর্ক যে পথে চলছে, তার হাল-হকিকত দেখে মনে হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদীর বিরোধিতা করাই আজকের দিনে ধর্মনিরপেক্ষতা। একদা যেমন বাবরি মসদিজ ভাঙা বা লালকৃষ্ণ আডবাণীর রথযাত্রার বিরোধিতা ছিল এ দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা। আজকের ‘সেকুলার’ রাজনীতি যেন শুধু না-বাচক, হ্যাঁ-বাচক নয়। সে এখন রাজনীতির এজেন্ডা স্থির করে না, কেবল জবাব দেয়, প্রতিরোধ করে, কৈফিয়ত খোঁজে। সে স্বভাবত দুর্বল, কারণ তার আত্মপ্রত্যয় নেই। এই দুর্বল, পরাশ্রিত, প্রতিক্রিয়াজীবী ধর্মনিরপেক্ষতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে সঙ্ঘ পরিবার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চাইছে।
অথচ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, গণতান্ত্রিক বলেই, ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষা করবে এটাই সহজ কথা। সাতচল্লিশে স্বাধীনতার পরে, আসলে তার অনেক আগে থেকে, জওহরলাল নেহরু এটাই ভেবেছিলেন। সংখ্যাগুরুর আধিপত্য সম্পর্কে, তার বিপদ সম্পর্কে তিনি অতিমাত্রায় সচেতন ছিলেন। ১৯৩৮ সালে এক মার্কিন পত্রিকায় নেহরু লিখেছিলেন, জাতীয়তাবাদ অসহিষ্ণুতা ও নির্মম হিংসার জনক হয়ে উঠছে, যা কিছু প্রতিক্রিয়াশীল তাই জাতীয়তাবাদকে আশ্রয় করে ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, জাতিবিদ্বেষ ইত্যাদি। তিনি সচেতন ছিলেন, আধিপত্যকামী জাতীয়তাবাদ ভারতে সহজেই সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতাকে আশ্রয় করতে পারে। তাঁর উন্নয়ন-চিন্তাও এই ভাবনার সঙ্গে সমঞ্জস ছিল। তিনি যে উন্নয়নের কথা ভাবতেন, উদার ধর্মনিরপেক্ষ শাসনতন্ত্র তার পক্ষে জরুরি ছিল। অন্তত তাঁর বিচারে। এই কারণেই রাষ্ট্রের অধিনায়কত্বে বিকাশ বা উন্নয়নের ভাবনাকে তিনি সে দিন সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের থেকে বেশি জরুরি বলে মনে করেছিলেন। |
|
পরবর্তী ইতিহাস স্বাভাবিক ভাবেই নেহরুর মডেল ও তার রূপায়ণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বামপন্থীরা অনেকেই মনে করেন, ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান নেহরুবাদী আধুনিকীকরণ ও ধর্মনিরপেক্ষতা মডেলের ব্যর্থতাকেই সূচিত করে। তাঁদের মতে, ধর্মনিরপেক্ষতা আসলে প্রগতি, স্বাধীনতা এবং বৈজ্ঞানিক মানসিক বিকাশের অঙ্গ, এগুলি হলেই ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানেই নেহরু ও তাঁর উত্তরসূরিরা ব্যর্থ হয়েছেন।
অন্য দিক থেকে আর একটি প্রশ্ন উঠেছে। মৌলিক প্রশ্ন। ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটিতেই কি ফাঁক ছিল? সমাজতাত্ত্বিকদের একটি অংশ মনে করেন, সেকুলারিজ্ম-এর যে ধারণাটি প্রচলিত হয়েছে, তা পশ্চিম থেকে নেওয়া, এটি ভারতীয় মানসের সঙ্গে আসলে কোনও দিন সম্পৃক্ত হতে পারেনি। কারণ পশ্চিমে গির্জা ও রাষ্ট্র, ধর্ম ও রাজনীতি যে ভাবে পৃথক হতে পেরেছে সে ভাবে ভারতীয় সমাজে রাজনীতি ও ধর্ম পৃথক হতে পারেনি। নেহরুর মডেল ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ করতে ব্যর্থ হয়েছে, কারণ তা ভারতীয় বাস্তবের সঙ্গে সমঞ্জস নয়। এই সমাজতাত্ত্বিকেরা আরও মনে করেন, ভারতীয় ধর্ম-সম্পৃক্ত সমাজের ইতিবাচক আদর্শ ও আচরণবিধিকে সঙ্গে নিয়ে যে ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো যায়, ধর্মনিরপেক্ষতার অনেক পণ্ডিত-প্রবক্তা সেই সত্যটিকেই অবজ্ঞা করেছেন। এবং ভারতের রাজনীতিতে চর্চিত ধর্মনিরপেক্ষতার এই ধারণাটি ‘অ-ভারতীয়’ বলেই, সেই ধারণা দেশের সমাজে ধর্মবিশ্বাসের অন্তর্নিহিত সত্য ও সম্ভাবনাকে অস্বীকার করে বলেই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এতটা প্রতিপত্তি তৈরি করতে পেরেছে, সেই রাজনীতির অনুশীলনকারীরা নিজেদের ‘প্রকৃত ভারতীয়’ বলে দাবি করার জোর পেয়েছেন। যখন আবার একটি লোকসভা নির্বাচন কড়া নাড়ছে, তখন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের ধ্বজা উড়িয়ে এগিয়ে আসছে প্রতিপক্ষ।
এই সাংস্কৃতিক জাতীয়তার জবাবে একটা প্রকৃত উদার, সর্বজনীন সামাজিক-অর্থনৈতিক জাতীয়তার বলিষ্ঠ মূর্তি সরবরাহ করতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা ব্যর্থ হয়েছে। তার প্রেক্ষাপটটি গুরুত্বপূর্ণ। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় আমজনতার আন্দোলন খুব প্রাচীন। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধী ভারতীয় আন্দোলনে নিম্নবর্ণের অবদান অনেক। কিন্তু আমরা অতীতের সেই জনজাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে উচ্চবর্ণ মধ্যবিত্ত আন্দোলনের সংযোগ সাধন করতে পারিনি। বস্তুত, লোকায়ত প্রতিবাদ বিক্ষোভ বিদ্রোহকে চাপা দিয়ে উচ্চবর্গ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রথের রশির দখল রেখেছিল। সেই আন্দোলনের আর্থ-সামাজিক বিচ্ছিন্নতা গোড়া থেকেই। স্বাধীনতার পর তাই নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র বিকাশের যুগ্ম মডেল যতই আন্তরিক হোক না কেন, বিসমিল্লায় গলদ থেকে গিয়েছিল। বৃহত্তর সমাজ থেকে এই বিচ্ছিন্নতা উন্নয়নের অভিজ্ঞতাতেও প্রতিফলিত হয়েছে। আমরা পুঁজিবাদী বিকাশের দিকে এগিয়েছি, অসাম্য ক্রমশ বেড়েছে, বাড়ছে।
এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দেবে, এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে। উত্তরপ্রদেশ বিহারের মতো রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘাত বাড়ছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির তাগিদে এই মেরুকরণকেই স্বাস্থ্যবান করে চলেছে। তাই শুধু বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখা অথবা ক্ষুদ্র-পরিচিতির কারবারিদের নিয়ে যেন তেন প্রকারেণ তৃতীয় ফ্রন্টকে ক্ষমতায় নিয়ে এলেই দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, এটাও অতিসরলীকরণ। নিষ্ক্রিয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হিন্দুত্ববাদের পুনরুত্থানের সুযোগ এনে দিয়েছে। গোটা দেশের মানুষের সামগ্রিক উন্নয়ন, ভারত ও ইন্ডিয়ার সংঘাত ঘোচানোটাই বরং হ্যাঁ-সূচক ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রতিষ্ঠিত করার একমাত্র পথ।
এখানেই ইউ পি এ’র একটা বড় ব্যর্থতা। প্রায় প্রতিটি সূচকেই দেশে আর্থিক ও রাজনৈতিক অসাম্য বেড়ে চলেছে। ইউপিএ-র সরকার সর্বজনীন বৃদ্ধির লক্ষ্য ঘোষণা করলেও, ‘ইনক্লুসিভ গ্রোথ’-এর সেই স্লোগান ক্রমশই স্লোগানমাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশাসনের নীতি-পঙ্গুতা, দিশাহীনতা, কংগ্রেসকে রাজনৈতিক সংকটের চোরাবালিতে নিমজ্জিত করেছে। আবার বিশ্বায়ন ও দুনিয়া জোড়া আর্থিক মন্দায় দেশের আমজনতার
বিজেপিও শুধু হিন্দুত্ব নয়, উদার অর্থনীতির পথে আর্থিক শ্রীবৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার চর্চাতেও তারা পিছিয়ে থাকতে চায় না। সঙ্ঘ পরিবারের এই বিচিত্র রাজনৈতিক প্যাকেজ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে দিয়েছে। এখন শুধু বিজেপির বিরোধিতা করলেই ধর্মনিরপেক্ষতার প্রমাণ হবে না। ইস্তেহারের ঘোষণা নয়, বাস্তবের জমিতে দাঁড়িয়ে গোটা দেশের সামগ্রিক আর্থিক বিকাশের প্রশ্নে আরও সদর্থে আক্রমণাত্মক হতে হবে। নেহরুর যে উদার বহুত্বধর্মী উন্নয়নবাদকে বাস্তবায়িত করা আজও সম্ভব হয়নি, আক্রমণাত্মক ভাবে সেই পথে এগোতেই হবে। সেটাই হবে হ্যাঁ-বাচক ধর্মনিরপেক্ষতা। সেই প্রবল, ইতিবাচক, প্রত্যয়ী ধর্মনিরপেক্ষতাই আনতে পারে গণতন্ত্রের নতুনতর আস্বাদন। |
|
|
|
|
|