|
|
|
|
জমির ঊর্ধ্বসীমা নিয়ে দ্বন্দ্বে সরকার-রাজমাতা |
আশিস বসু • আগরতলা |
উন্নয়নের স্বার্থে সারা দেশে যখন জমির ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়া হয়েছে, তখন উল্টো-পথেই হাঁটার সিদ্ধান্ত নিল ত্রিপুরার বামফ্রন্ট সরকার।
মাঝখানে পাঁচ বছরের কংগ্রেস শাসন বাদ দিলে তিন দশকেরও বেশি সময় সরকারে থাকার পরে এ বার রাজ্যে ভূমি সংস্কারকে আর এক
ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মানিক সরকারের নেতৃত্বাধীন ত্রিপুরা সরকার তথা দেশের একমাত্র বাম-শাসিত সরকার। ত্রিপুরার
পাহাড়ি এলাকায় টিলা জমির ঊর্ধ্বসীমার ক্ষেত্রে যে বিশেষ ছাড় ছিল, তা তুলে দিয়ে সমতলের জমি (রাজ্যের চলতি ভাষায় ‘লুঙ্গা জমি’) ও টিলা জমির ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বসীমায় একই হার চালুর জন্য রাজ্যের চলতি
আইনে পরিবর্তন চেয়ে একটি সংশোধনী বিল বিধানসভায় পেশ করেছে রাজ্য সরকার।
এই সংশোধনী পেশের সঙ্গে সঙ্গেই রাজ্যে শাসক বামফ্রন্ট বনাম বিরোধী কংগ্রেসের, বিশেষ করে প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ তথা রাজমাতা বিভু দেবীর বিরোধ প্রকাশ্যে চলে এসেছে। সিপিএমের অভিযোগ, বিভু দেবী সরব হয়েছেন, কারণ এই সংশোধনীটি বিধানসভায় অনুমোদিত হয়ে গেলে হাত পড়বে ত্রিপুরার রাজপরিবারের হাতে থাকা প্রচুর টিলা জমির উপরে। সেগুলি খাস হয়ে যাবে। বিধানসভায় কংগ্রেস এবং উপজাতি নেতাদের তীব্র আপত্তিতে সংশোধনী বিলটিকে ভূমি-বিষয়ক সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হয়েছে।
রাজ্যে এই মুহূর্তে সমতলের জমির ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বসীমা ৭.২ হেক্টর অর্থাৎ ১৭.৮ একর। বিঘার হিসেবে ৫৩ বিঘা সমতল জমি কোনও ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান রাখতে পারে। টিলা জমির ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বসীমার পরিমাণ এর তিনগুণ, অর্থাৎ ২১.৬ হেক্টর। একরের হিসেবে এই জমির পরিমাণ ৫৩ একর, অর্থাৎ ১৫৯ বিঘা। সরকারের আনা সংশোধনী অনুযায়ী, সমতল হোক বা টিলা জমি, ৭.২ হেক্টরের বেশি কেউই রাখতে পারবে না। ঊর্ধ্বসীমা বহির্ভূত জমি আইন মোতাবেক খাস হয়ে যাবে। তার মালিকানা পাবে সরকার। তবে চা, কফি বাগান বা অন্যান্য শিল্প-কারখানার ক্ষেত্রে সরকার ‘কেস-টু-কেস’ ভিত্তিতে ঊর্ধ্বসীমায় প্রয়োজনীয় ছাড় দেবে বলে সরকারি এক সূত্রে জানা গিয়েছে।
ইতিমধ্যেই এই সংশোধনীতে আপত্তি জানিয়ে সিলেক্ট কমিটির কাছে বিভু দেবী-সহ ১১৫৪ জন তাঁদের মতামত পাঠিয়েছেন। এঁদের সিংহভাগই উপজাতি শ্রেণিভুক্ত মানুষ। চা, রাবার বাগান কর্তৃপক্ষ-সহ ৪০টি সংস্থা আপত্তি তুলেছে সরকারি প্রস্তাব নিয়ে। সরকারি সূত্রের খবর, আপত্তি এসেছিল আরও প্রায় তিন হাজার। আপত্তি জানাবার সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ায় সেগুলি গ্রহণ করা যায়নি।
রাজমাতা বিভু দেবীর বক্তব্য, ‘‘ত্রিপুরাবাসী, বিশেষ করে উপজাতি মানুষদের স্বার্থেই সংশোধনীতে আপত্তি জানিয়েছি। এটি অনুমোদিত হলে উপজাতিদের জমিতেই টান পড়বে। কারণ টিলা অঞ্চলে উপজাতিদেরই বাস। এই জমি থেকেই তাঁরা জীবিকা নির্বাহ করেন। এই সংশোধনী গরিব উপজাতিদের ভাতে মারবে।” তাঁর বক্তব্য, এর ফলে উপজাতি ও অ-উপজাতিদের সম্পর্ক আরও খারাপ হবে। তাঁর হুঁশিয়ারি, “সেই রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য কিন্তু দায়ী থাকবে বামফ্রন্টই।” আইএনপিটি-র সভাপতি তথা উপজাতি নেতা বিজয় রাংখলও বলেন, ‘‘প্রস্তাবিত জমি আইন উপজাতি মানুষের চরম আর্থিক ক্ষতি করবে।’’
রাজ্যের অর্থমন্ত্রী বাদল চৌধুরীর বক্তব্য, উপজাতি মানুষ, বিশেষ করে ভূমিহীন উপজাতিদের কথা মাথায় রেখেই সরকার এই সংশোধনীটি এনেছে। বাদলবাবুর অভিযোগ, ‘‘উপজাতি সংগঠন, বিজয় রাংখলের আইএনপিটি-র মাধ্যমে বিভু দেবী ভূমি আইনের সংশোধনী নিয়ে অহেতুক জলঘোলা করছেন। এ প্রসঙ্গে একটি প্রস্তাবও তিনি পাঠিয়েছেন রাজ্য সরকারের কাছে। আইএনপিটি-র মতো উপজাতি সংগঠনকে বিভু দেবী উস্কে দিচ্ছেন।’’
১৯৪৯-এ ত্রিপুরার ভারত-ভুক্তির পরে রাজপরিবারের জমি, সম্পত্তি কী ভাবে সরকারের কাছে আসবে, কোন সম্পত্তি রাজপরিবারের কাছে থাকবে, সে বিষয়ে পরিষ্কার উল্লেখ করা রয়েছে বলে অর্থমন্ত্রী জানান। বাদলবাবুর অভিযোগ, ‘‘এ সব জেনেশুনেও বিভু দেবী বর্তমান সচিবালয়, বিধানসভা যেখানে তৈরি হয়েছে, সেখানকার টিলা জমির উপর নিজের অধিকার কায়েম করতে হাইকার্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছেন। কিন্তু সব জায়গাতেই হেরেছেন।’’ রাজ্যের জমি আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাদলবাবু আরও বলেন, ‘‘এর ফলে যে সব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তাঁদের সংখ্যা খুবই কম।” সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিজন ধরেরও দাবি, ‘‘খুব অল্প সংখ্যক ব্যক্তি বা পরিবার এই সংশোধনীর আওতায় পড়বে।’’
সারা দেশ যখন ঊর্ধ্বসীমা তুলে দিয়ে সার্বিক উন্নয়ন ও বৃদ্ধির দিকে হাঁটছে তখন ত্রিপুরা কেন অন্য পথে? সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা মুখপাত্র গৌতম দাসের কথায়, “বামফ্রন্ট বামপন্থী নীতির ভিত্তিতেই সরকার চালায়। সেখানে গরিবের স্বার্থরক্ষাই আমাদের প্রথম লক্ষ্য। কতিপয় মুষ্টিমেয়র কথা আমাদের কাছে বড় নয়।” কিন্তু এতদিন ক্ষমতায় থাকার পর হঠাৎ কোন রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা থেকে ১৯৬০-এর আইনটি সংশোধন করা হচ্ছে? দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, গত বিধানসভা ভোটে আমাদের ভোট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৯%। ৬০টির মধ্যে ৫০টি আসনই বামেদের দখলে। কিন্তু মোট ভোটের নিরিখে এখনও আমরা সংখ্যালঘু। তাই ভোটব্যাঙ্ককে আরও প্রসারিত করার সুযোগ রয়েছে। সেটা করতে গেলে একটা আন্দোলন প্রয়োজন। দলীয় স্তরে ভূমি আন্দোলনকে আরও নিবিড় করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তা করতে গেলে রাজ্যের হাতে পাট্টা যোগ্য খাস জমি বাড়ানো প্রয়োজন।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে গৌতমবাবু বলেন, রাজ্যের মোট জমির ৬০-৭০ অংশই বনাঞ্চল। বাকি টিলা জমির পরিমাণই বেশি। সমতলে চাষযোগ্য জমি কম। জনসংখ্যা বাড়লেও চাষের জমি বাড়েনি। ত্রিপুরার প্রান্তিক গোষ্ঠী, বিশেষ করে উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত অধিকাংশ মানুষ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বাম সরকার কিছু ভূমিহীনদের জমির পাট্টা দিয়েছে। ভূমি রাজস্ব দফতর দেখেছে, এই ভূমিহীন মানুষদের দেওয়ার মতো জমি সরকারের হাতে বেশি নেই। বনাঞ্চল কেটেও তা করা যাবে না। তাই আইন সংশোধনের সিদ্ধান্ত। এতে অনেকখানি জমি সরকারের হাতে আসবে। |
|
|
|
|
|