|
|
|
|
পতাকা বদলেও পুরভোটে জয়ী দলবদলের খেলা
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
দল থেকে সাসপেন্ড হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সদলবদল তৃণমূলে যোগ দিলেন শান্তিপুরের কংগ্রেস বিধায়ক অজয় দে। আবার সেই দিনই পুরভোটের ফলাফলে দেখা গেল, দল বদলেও জিতে এলেন সদ্য তৃণমূলে যাওয়া কাউন্সিলরেরা! কৃষ্ণনগর পুরসভার প্রায় গোটা বোর্ডই ভোটের কয়েক দিন আগে দল বদল করেছিল। কিছু দিন আগেও যে কাউন্সিলরেরা ছিলেন কংগ্রেসের, সোমবার ভোটবাক্স খুলতে তাঁরাই হয়ে গেলেন তৃণমূলের হয়ে নির্বাচিত! বহরমপুরে তৃণমূলের হয়ে খাতা খুললেন যাঁরা, তাঁরাও কিছু দিন আগে ছিলেন অধীর চৌধুরীর অনুগামী।
আপাতত রাজ্য রাজনীতিতে জাঁকিয়েই থাকল দল বদলের খেলা!
তৃণমূল ভবনে এ দিন শাসক দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের উপস্থিতিতে অজয়বাবুদের হাতে তৃণমূলের পতাকা তুলে দিয়ে দলে স্বাগত জানান রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। শান্তিপুর থেকে এ দিন প্রচুর বাস, গাড়ি বোঝাই হয়ে শ’য়ে শ’য়ে অজয়-অনুগামী তৃণমূল ভবনে এসেছিলেন। তৃণমূল ভবনে উপচে পড়া ভিড়ের মধ্যে মুকুলবাবু বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্যে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে সামিল হতেই অজয়বাবুরা তৃণমূলে যোগ দিলেন।” নদিয়া জেলারই কৃষ্ণনগরে ২৪টি আসনের মধ্যে তৃণমূল প্রার্থীরা যে ২২টিতেই সরাসরি জয়ী হয়েছেন, তাতে প্রত্যাশিত ভাবেই খুশি মুকুলবাবুরা। এমনকী, যে দু’জন নির্দল হিসাবে জিতেছেন, এ দিন ফল বেরোনোর পরে তাঁরাও তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন!
কিন্তু কৃষ্ণনগরে যাঁরা এই সে দিনও কংগ্রেসের প্রতীকে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁরা তৃণমূলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনমতও ঘুরে গেল এই ঘটনা রাজনৈতিক শিবিরে যথেষ্ট বিস্ময় তৈরি করেছে। বিশেষত, যাঁরা মনে করেছিলেন, নেতা বা কর্মীরা দল বদলালেও মানুষের মনকে ওই ভাবে বদলানো যায় না। |

তৃণমূলে যোগ দেওয়ার দিন অজয় দে। সোমবার তৃণমূল ভবনে।
রয়েছেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমও। রাজীব বসুর তোলা ছবি। |
নদিয়া জেলা কংগ্রেস সভাপতি শঙ্কর সিংহের ব্যাখ্যা, “যে মুখগুলো এত দিন কৃষ্ণনগর শহরে কংগ্রেসের নেতৃত্ব দিত, ভোটের মাত্র কয়েক দিন আগে তাঁরা দল বদল করায় হঠাৎ করে একটা শূন্যস্থান তৈরি হয়। সামান্য সময়ের মধ্যে সেই সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা যায়নি। আর সেটা সম্ভবও নয়।” আবার ভোটের আগেই সদ্য কংগ্রেস ত্যাগ করে তৃণমূলে যোগ দেওয়া বিদায়ী পুরপ্রধান অসীম সাহার দাবি, “মানুষ এ বার উন্নয়ন দেখে ভোট দিয়েছে।” তাঁর আরও বক্তব্য, “যারা এই শহরের বুকে দাঁড়িয়ে আমাদের বিশ্বাসঘাতক বলে গালি দিয়েছিল, আমাদের হয়ে শহরের মানুষ তাদের জবাব দিয়ে দিলেন! এই শহর জানে কোনও দল নয়, আমরাই এত দিন এই শহরের উন্নয়নের কাজ করে এসেছি।”
নদিয়ারই বীরনগর, কুপার্স ক্যাম্পের পরে পুরভোটের মাত্র কয়েক দিন আগেই কৃষ্ণনগরের ১৪ জন কংগ্রেস কাউন্সিলর-সহ শহরের অন্য নেতারা তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। তাতে রীতিমতো অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছিল কংগ্রেস। এমনকী, তারা আদৌ কোনও প্রার্থী দাঁড় করাতে পারবে কি না, তা নিয়েও জল্পনা শুরু হয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস অবশ্য ১৭টি ওয়ার্ডে প্রার্থী দিতে সক্ষম হয়েছিল। শহরের মানুষের একাংশের মতে, কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত যে প্রার্থীদের দাঁড় করিয়েছিল, তাঁদের বেশির ভাগেরই তেমন পরিচতি ছিল না। ফলে, তাঁদের উপরে ভরসা রাখতে না পেরেই সদ্য তৃণমূলে যোগ দেওয়া পুরনো মুখগুলির উপরেই ভরসা করেছেন শহরের মানুষ।
নদিয়ায় কংগ্রেসের এই ভাঙনকেই এ দিন আরও ত্বরান্বিত করেছেন শান্তিপুর পুরসভার চেয়ারম্যান অজয়বাবু। তাঁর সঙ্গেই পুরসভার কংগ্রেসের ভাইস চেয়ারম্যান ও ১৮ জন কাউন্সিলর এবং নদিয়ার বিভিন্ন গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতির ৩৭ জন সদস্য তৃণমূলে চলে এসেছেন।
নদিয়া জেলা পরিষদের কংগ্রেস সদস্য নিমাই বিশ্বাসও এ দিন আনুষ্ঠানিক ভাবে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, জনপ্রতিনিধিরা ছাড়াও শ’চারেক কংগ্রেস কর্মী-সমর্থক তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। এখন থেকে শান্তিপুর পুরসভা তৃণমূলের দখলে এল বলে জানিয়েছেন মুকুলবাবু।
বিধায়ক পদে ইস্তফা দেবেন বলেই ফের জানিয়েছেন অজয়বাবু। তাঁর কথায়, “আমি নৈতিকতায় বিশ্বাসী। অন্য দলে যখন যোগ দিয়েছি, তখন পদত্যাগ করে মানুষের দরবারে যাব এবং আবার মানুষের আর্শীবাদ নিয়েই ফিরে আসব।” তাঁর বক্তব্যের সূত্র ধরেই মুকুলবাবু বলেন, “আমাদের দলও নৈতিকতায় বিশ্বাসী। তাই কোচবিহার পুরসভার চেয়ারম্যান বীরেন কুণ্ডু কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগদানের আগে পদত্যাগ করেছিলেন এবং তিনি উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে ফিরেছেন।” অজয়বাবু-সহ কংগ্রেস-ত্যাগীদের আগামী দিনে তৃণমূলের বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োগ করা হবে এ দিন মুকুলবাবু জানান। |
উপনির্বাচনের ফল একনজরে |
• কলকাতা: আসন ২, তৃণমূল ২।
• বিধাননগর: আসন ১, তৃণমূল ১।
• রাজারহাট গোপালপুর: আসন ১, তৃণমূল ১।
• মধ্যমগ্রাম: আসন ১, তৃণমূল ১।
• ব্যারাকপুর: আসন ১, বামফ্রন্ট ১।
• ভাটপাড়া: আসন ১, তৃণমূল ১।
• নৈহাটি: আসন ২, তৃণমূল
২।
• অশোকনগর-কল্যাণগড়: আসন ১, তৃণমূল
১।
• মহেশতলা: আসন ১, তৃণমূল ১।
• চাঁপদানি: আসন ১, তৃণমূল ১।
• ভদ্রেশ্বর: আসন ১, তৃণমূল
১।
• এগরা: আসন ১, তৃণমূল ১।
• পুরুলিয়া: আসন ১, তৃণমূল ১।
• রঘুনাথপুর: আসন ২, তৃণমূল ১, কংগ্রেস ১।
• বাঁকুড়া: আসন ১, তৃণমূল ১।
• আসানসোল: আসন ৩, তৃণমূল ৩।
• কুলটি: আসন ১, তৃণমূল ১।
• মুর্শিদাবাদ: আসন ১, ফব ১।
• শিলিগুড়ি: আসন ২, তৃণমূল ১, বামফ্রন্ট ১।
• মালবাজার: আসন ১, তৃণমূল ১।
• জলপাইগুড়ি: আসন ১, কংগ্রেস ১।
• কোচবিহার: আসন ১, তৃণমূল ১।
• দিনহাটা: আসন ১, ফব ১। |
|
একদা সতীর্থ অজয়বাবুর দলত্যাগকে দুর্ভাগ্যজনক আখ্যা দিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেছেন, “উনি তৃণমূলে গেলেও ওঁর প্রতি শ্রদ্ধা যেমন ছিল, তেমনই থাকবে।”
একই ভাবে কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া বলেছেন, “অজয়বাবু বিচক্ষণ নেতা, ভাল প্রশাসক। শান্তিপুরের উন্নয়নে কাজ করেছেন। কংগ্রেসও ওঁকে চেয়ারম্যান, বিধায়ক, জেলা সভাপতি এবং তার পরে প্রদেশ সহ-সভাপতি করেছে। তৃণমূলের কোন উন্নয়নের টানে তিনি দল ছেড়ে দিলেন, বোধগম্য হল না!” তবে দল ভাঙানোর খেলা চালিয়ে ঘুরপথে সিপিএমকে সাহায্য করার অভিযোগ তিনি এনেছেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে।
মানসবাবুর যুক্তি, কংগ্রেসের দুই বিধায়ক কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী ও হুমায়ুন কবীরকে আগেই ভাঙিয়েছিল তৃণমূল। এ বার অজয়বাবু চলে যাওয়ায় কংগ্রেসের বিধায়ক সংখ্যা সিপিএমের সমান ৩৯ হয়ে গেল। যার ফলে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা চেয়ে কংগ্রেসের দাবিও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে। মানসবাবুর মন্তব্য, “তবে কি বিরোধী দলনেতা হিসাবে সূর্যকান্ত মিশ্রকে বেশি পছন্দ বলেই ওঁদের এই অশুভ অভিসন্ধি?” যার প্রতিক্রিয়ায় সূর্যবাবু বলেছেন, “উনি (মানস) কংগ্রেসে থাকলেই আমরা খুশি হব!”
দলবদলের স্রোত চলেছে অন্যত্রও। উত্তরবঙ্গের মাল পুরসভার দুই কংগ্রেস কাউন্সিলর সুলেখা বিশ্বাস ও উৎপল ভাদুড়িও এ দিন তৃণমূলে যোগ দেন। ফলে মাল পুরসভায় তৃণমূল একক ভাবে বোর্ড গঠন করছে। মুকুলবাবু আরও জানিয়েছেন, উত্তর ২৪ পরগনার বাদুড়িয়া পুরসভায় তাঁদের তিন কাউন্সিলরের সমর্থনে বোর্ড চালাচ্ছিল কংগ্রেস। কিন্তু এ দিন কংগ্রেসের ৭ কাউন্সিলর তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় ওখানে সেই পুরসভা কংগ্রেসের হাতছাড়া হল।
দলত্যাগের এই হিড়িকে অধীর দাবি করেছেন, “কংগ্রেসকে যে ভাবে ভাঙিয়ে তৃণমূলের নেতারা দল ভারী করছেন, পরে এই দলত্যাগীদের নিয়ে পদ দিতে গিয়ে ওঁরাই সমস্যায় পড়বেন!” মুকুলবাবুর জবাব, “যে যার দল আগে সামলাক! আমাদের নেত্রী জানেন, কী ভাবে দল চালাতে হয়। অন্যের উপদেশ না দেওয়াই ভাল!” |
পুরনো খবর: অজয়কে সাসপেন্ড, পাল্টা চাপ কংগ্রেসের |
|
|
 |
|
|