তৃণমূল পাঁচে চার, বাম-ক্ষরণ অব্যাহত
পুরভোটেও বদলাল না রাজ্যের রাজনৈতিক ছবি।
তৃণমূলের জয়ের ধারা অব্যাহত। অব্যাহত বামেদের রক্তক্ষরণও। আর ক’মাস পরের লোকসভা ভোটের নিরিখে এই পুরভোটের তাৎপর্য এটাই যে, আরও দৃঢ় হল শাসক দলের একলা চলার প্রত্যয়। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের কথায়, “লোকসভা ভোটের আগে এটাই ছিল শেষ নির্বাচন। সারা বাংলা জুড়েই এই ভোট হয়েছে। ফল ভাল হয়েছে। ফলে, তৃণমূল একক ভাবে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত।”
পঞ্চায়েত এবং দু’মাস আগে ১২টি পুরসভার ভোটে জনমতের যে প্রবণতা ছিল, তা-ই বজায় রেখে পাঁচটির মধ্যে চারটি পুরসভা গেল তৃণমূলের ঝুলিতে। যে পুরসভা তাদের হাতে এল না, সেই বহরমপুরেও দু’টি ওয়ার্ড জিতে খাতা খুলে ফেলল তারা! পনেরো বছর পরে আর বিরোধী-শূন্য রইল না অধীর চৌধুরীর গড়।
হাওড়া ও ঝাড়গ্রাম পুরসভা গত তিন দশক ধরে ছিল বামেদের দখলে। দুই পুরসভাতেই এ বার পরিবর্তনের বৃত্ত সম্পূর্ণ। মেদিনীপুর ও কৃষ্ণনগরে একক ভাবে বোর্ড পেয়েছে তৃণমূল। কৃষ্ণনগরের যে বোর্ড ভোটের কয়েক দিন আগেই দল বদলেছিল, তারাই এ বার তৃণমূলের হয়ে জিতে এসেছে! সেখানেই শেষ নয়। রাজ্যের ২৩টি পুরসভার ২৯টি ওয়ার্ডে যে উপনির্বাচন হয়েছে, তার মধ্যেও ২৩টিতে জয়ী তৃণমূলই। বামেরা পেয়েছে চারটি এবং কংগ্রেস দু’টি। কলকাতার দু’টি ওয়ার্ড দখলে রেখেছে তৃণমূল। তার মধ্যে ১ নম্বর ওয়ার্ডে জয়ের ব্যবধান ১০ হাজারেরও বেশি! আবার সল্টলেক ও রাজারহাট-গোপালপুরের একটি করে ওয়ার্ডে সামান্য ভোটে হলেও বিজয়ী তৃণমূলই। কলকাতার আশেপাশে শহরতলির উপনির্বাচনেও শাসক দলেরই প্রাধান্য।
জয়ের রং

হাওড়ায় পুরভোটের ফল প্রকাশের পর সুমন বল্লভের তোলা ছবি।
তৃণমূলের এই ঊর্ধ্বমুখী রেখচিত্রের বিপরীতে বাম শিবিরের ছবি একেবারে অন্ধকার! ভোটের আগেই কার্যত ময়দান ছেড়ে যাওয়া বামেদের হাতছাড়া হয়েছে দু’টি পুরসভা। উপনির্বাচনেও বিশেষ কিছু প্রাপ্তি নেই। একটা করে ভোট যায়, আর বামেদের রক্তক্ষরণ চলতে থাকে এই চেনা ছবির এ বারও কোনও বদল হয়নি। আর বাম ভোটের সেই ভাঙনে লাভবান হয়েছে তৃণমূল। যেমন বহরমপুরে বামেদের ভোট ২৯ শতাংশ থেকে কমে ১০ শতাংশের কাছাকাছি চলে আসায় অধীরের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঠে এসেছে তৃণমূল। বাম ভোট দখল করেই সেখানে দু’টি ওয়ার্ডে জিতেছে তারা। সব পুরসভার হিসেব এখনও না-মিললেও প্রায় সর্বত্রই বামেদের ভোট কমেছে এবং তাঁদের ভোট বেড়েছে বলে দাবি তৃণমূল নেতাদের।
এই পরিস্থিতি লোকসভা ভোটের আগে বাম নেতৃত্বের উদ্বেগ বাড়িয়েছে। যদিও প্রকাশ্যে এই ভোটকে সন্ত্রাস-কবলিত আখ্যা দিয়ে এই ফল থেকে বিশেষ কোনও অর্থ খুঁজতে চাইছেন না তাঁরা। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য তথা বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের বক্তব্য, “শাসক দলের নেতারা কী ভাবে ঝাঁপিয়েছিলেন, তা তো সকলে দেখতেই পেলেন! পঞ্চায়েত ও অন্যান্য ভোটে যা হয়েছে, সে সব আমরা এখানেও দেখতে পেয়েছি।”
বহরমপুর বাদে অন্যত্র কংগ্রেসের হালও প্রায় একই। প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া দাবি করেছেন, “তৃণমূল আগ্রাসী হয়ে যা কাজকর্ম করেছে, প্রশাসন নিরাপত্তা দিতে পারেনি এবং নির্বাচন কমিশনে যে ভাবে অসহায় হয়ে থেকেছে, তার মধ্যেও কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকেরা লড়াই করেছেন!” তৃণমূলের সঙ্গে টক্কর দিয়েই মেদিনীপুরে তাদের আসন থেকে চার থেকে ছয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে কংগ্রেস। বহরমপুরে দু’টি ওয়ার্ড হারানো যদি ‘মাইনাস’ হয়, মেদিনীপুরের দু’টিকে ‘প্লাস’ ধরতে হবে মনে করছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। বামেদের মতো কংগ্রেসও পুরভোটে তৃণমূলের এই জয়কে খুব স্বাভাবিক বলে মানতে রাজি নয়। পুরভোটের ফলকে তৃণমূল ও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ‘যুগ্ম জয়’ বলেই কটাক্ষ করেছেন কংগ্রেস নেতা নির্বেদ রায়। তাঁর কথায়, “বিরোধীদের আক্রমণ করা, হুমকি দেওয়ার অভিযোগ পেয়েও মূক ও বধির থেকেছে নির্বাচন কমিশন!”
আর এই তিন প্রতিষ্ঠিত শক্তির আড়ালে সন্তর্পণে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে বিজেপি। হাওড়ায় এক থেকে বেড়ে এ বার দুই হয়েছে তারা। বিদায়ী মেয়র মমতা জায়সবালকে হারিয়েছেন বিজেপি-রই প্রার্থী গীতা রাই। সল্টলেকের একটি-সহ আরও কিছু পুরসভার ওয়ার্ডে তৃতীয় স্থানে শেষ করতে পেরেছে বিজেপি। নরেন্দ্র মোদী রাজ্য সফরে এলে সেই হাওয়া কাজে লাগিয়ে লোকসভা ভোটে তাঁরা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেন বলে বিজেপি নেতৃত্বের আশা। তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য হাওড়ায় বিজেপি-র সাফল্যকে বিশেষ গুরুত্ব দেননি। মুকুলবাবুর মতে, “আগের পুরভোটেও হাওড়ায় বিজেপি জয়ী হয়েছে। এটা তাৎপর্যপূর্ণ নয়। হাওড়ায় সিপিএম-বিজেপি কী ভাবে একসঙ্গে চলে, তা লোকসভার উপনির্বাচনে আমরা দেখিয়েছিলাম!”
পুরভোট ২০১৩

মোট আসন
তৃণমূল

কংগ্রেস

বামফ্রন্ট

বিজেপি
নির্দল
হাওড়া ৫০ ৪১ -
বহরমপুর ২৮ ২৬ - - -
কৃষ্ণনগর ২৪ ২২ - - - ২*
মেদিনীপুর ২৫ ১৩ -
ঝাড়গ্রাম ১৮** ১৬ - - -
উপনির্বাচন ২৯*** ২৩ - -
* নির্দল দু’জন পরে তৃণমূলে যোগ দেন।
** একটি আসনে ভোটগ্রহণ হয়নি।
*** উপনির্বাচন মোট ২৩টি পুরসভায়।
হাওড়ার জয়ে উচ্ছ্বাসকে ছাপিয়ে তৃণমূল অবশ্য বহরমপুরে অধীর-দুর্গে ফাটল ধরানো নিয়েই বেশি উৎসাহিত। মুকুলবাবুর কথায়, “বহরমপুর পুরসভার ২৮ ওয়ার্ডের ২৪টিতে তৃণমূল দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। ২০০৮ সালে বহরমপুরে পুরভোটে তৃণমূল পেয়েছিল মাত্র ২.৮% ভোট। এ বার তা বেড়ে হয়েছে ২৯%।” মুকুলবাবুর আশা, “আগামী দিনে মুর্শিদাবাদে আরও ভাল ফল করবে তৃণমূল। লোকসভা ভোটে কংগ্রেস বহরমপুরে হারবেই!”
অধীর অবশ্য এত আশঙ্কার কারণ দেখছেন না। তাঁর ব্যাখ্যা, “বহরমপুরে তৃণমূলের কোনও সংগঠন নেই। ওই দু’জন প্রার্থী ব্যক্তিগত ক্যারিশমায় জয়ী হয়েছেন।” একই সঙ্গে মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেস সভাপতি অধীরের মতে, বহরমপুরে কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার ফায়দা তৃণমূল তুলতে পেরেছে। তাঁর কথায়, “দীর্ঘ দিন ধরে পুরবোর্ড কংগ্রেসের দখলে থাকায় অনেকেই অনেক কিছু আশা করেছিলেন। হয়তো তাঁদের সেই সমস্ত ইচ্ছে পূরণ না-হওয়ায় কিছু ভোট কংগ্রেসের বিরুদ্ধে গিয়েছে।”
ভোটের আগে বহরমপুরে তৃণমূলকে আমল না-দিলেও এ দিন ফলপ্রকাশের পরে অধীর থেকে শুরু করে মানসবাবুরা দাবি করেছেন, “এই ঘটনা সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে ভাল লক্ষণ!”
পক্ষান্তরে, সামগ্রিক ভাবে মুকুলবাবুর মত, “পঞ্চায়েত ভোট, এর আগে ১২ পুরসভার ভোটে এবং লোকসভার উপনির্বাচনে আমাদের দল ভাল করেছে। লোকসভা ভোটের আগে এ বারে পাঁচ পুরসভার ভোটেও মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করেছে এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের জনহিতকর ও উন্নয়নমূলক কাজকেই সমর্থন করেছে।” লাগাতার জয়ের ‘বিজয় উৎসব’ আগামী ৩০ জানুয়ারি ব্রিগেডের সমাবেশেই পালন করা হবে বলে মুকুলবাবু এ দিন জানিয়েছেন। ওই সমাবেশ থেকেই লোকসভা ভোটের লড়াইয়ের ডাক দেবেন তৃণমূল নেত্রী।
প্রসঙ্গত, হাওড়ার ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের দু’নম্বর বুথে মোট স্বাক্ষরকারী ভোটারের চেয়ে বেশি ভোট পড়ায় গণনা স্থগিত রেখেছে কমিশন। ওই বুথে কাল, বুধবার পুনর্নির্বাচন। এই নিয়ে মোট পাঁচটি বুথে ভোটারের চেয়ে বেশি ভোট পড়ার অভিযোগ পাওয়া গেল।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.