|
|
|
|
হাওড়া-সল্টলেক উত্তপ্ত, পুরভোট অন্যত্র শান্তিতেই
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
বুথের সামনে দীর্ঘ লাইন। বিক্ষিপ্ত গোলমাল, উত্তেজনা। পুলিশের তাড়া। অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ। এটুকু বাদ দিলে মোটামুটি শান্তিতেই শেষ হল শুক্রবার রাজ্যের পাঁচটি পুরসভার ভোটপর্ব। সেই সঙ্গে মিটল ২৩টি পুরসভার ২৯টি ওয়ার্ডের উপনির্বাচন-ও। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের হিসেবে, পাঁচটি পুরসভায় গড় ভোট পড়েছে ৭৯.৪৫ শতাংশ। আগামী ২৫ নভেম্বর, সোমবার ফল ঘোষণা হবে।
শুক্রবারের পুরভোট নিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ যথেষ্টই ছিল। লোকসভা নির্বাচনের আগে এটাই ছিল এ রাজ্যের শেষ নির্বাচন। এর মধ্যে রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম পুরসভা হাওড়া এবং অধীর চৌধুরীর খাসতালুক বহরমপুরের ভোট নিয়ে সাধারণ মানুষের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। এই দু’টি পুরসভা হাতে পাওয়ার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে ময়দানে নেমেছিল তৃণমূল। মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম এবং কৃষ্ণনগর পুরসভার ভোটেও জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে ঝাঁপিয়েছিল শাসক দল। এমনকী এ দিন ২৩টি পুরসভার যে ২৯টি ওয়ার্ডে উপনির্বাচন হয়েছে, যার ফলাফলে পুরবোর্ড উল্টে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই, সেখানেও তৃণমূল নেতা-কর্মীদের তৎপরতা ছিল তুঙ্গে।
|
|
ভোটের হামলায় জখম। শুক্রবার সল্টলেকের এফই ব্লকে সুদীপ্ত ভৌমিকের তোলা ছবি। |
শাসক দলের এই ভূমিকা নিয়েই এ দিন সরব হন বিরোধীরা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক তথা বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু এ দিন বিকেলে বসিরহাটে বলেন, “প্রশাসনের মদতে নিয়ন্ত্রণহীন তৃণমূলের উচ্ছৃঙ্খলবাহিনী হাওড়া কর্পোরেশনের মেয়রকে লক্ষ করে বোমা ছুড়েছে। মমতা জায়সবালকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছে।
ভোটারদের আঙুলে কালি লাগিয়ে বলেছে, আপনারা বাড়ি চলে যান, আমরা ভোট দিয়ে দেব! এ ভাবে ওরা হাওড়া কর্পোরেশন-সহ যে সব জায়গায় নির্বাচন হয়েছে, তাকে প্রহসনে পরিণত করেছে।” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের অভিযোগ, উত্তর হাওড়া এবং কৃষ্ণনগরে কংগ্রেস কর্মীদের উপরে হামলা হয়েছে।
বিরোধীদের অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, পুরভোট শান্তিপূর্ণই হয়েছে। হাওড়ার মেয়রের উপরে হামলার অভিযোগকে গুরুত্ব না-দিয়ে তাঁর মন্তব্য, “কোথাও একটা বোমা পড়েছে হয়তো! কিন্তু সারা দিন ধরে এত ক্যামেরা ঘুরেছে, বুথজ্যাম, রিগিংয়ের ক’টা ঘটনা দেখাতে পেরেছে! খুব জোর ৬টা! শতাংশের হিসেবেও আসে না!” প্রদীপবাবুর পাল্টা জবাব, “৩৪ বছর ধরে বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যেরাও বলতেন, ভোট শান্তিপূর্ণ হয়েছে। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বলতেন রিগিং হয়েছে! এখন তৃণমূল ক্ষমতায় এসে সিপিএমের মতোই বলছে, ভোট শান্তিপূর্ণ হয়েছে! আর সিপিএম অভিযোগ করছে রিগিংয়ের!” |
|
|
হাসি ঠাট্টায় মজলেন অধীর চৌধুরী। |
সেচ দফতরের অতিথি আবাসে হুমায়ুন কবীর। |
|
এই চাপানউতোরের মধ্যেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রাজারহাট-গোপালপুর পুরসভার একটি ওয়ার্ডের উপনির্বাচনে দু’টি বুথে ভোটারের চেয়েও বেশি ভোট পড়ছে! ওই পুরসভার ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের ৬৪ নম্বর বুথে মোট ভোটার ৪৪২ জন। কিন্তু ভোট পড়েছে ৫৮২টি! পাশের ৬৫ নম্বর বুথেও ভোটারের চেয়ে বেশি ভোট পড়েছে। ওই দুই বুথে রবিবার ফের ভোটগ্রহণ হবে। কৃষ্ণনগর পুরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ১৭ নম্বর বুথে টেন্ডার ভোট পড়েছে অনেক বেশি। (অর্থাৎ কোনও এক ভোটার দাবি করেছেন, তিনি ভোট দেননি। অথচ বুথের হিসেব বলছে, তাঁর ভোট হয়ে গিয়েছে। তাই বিশেষ ব্যবস্থায় তাঁর ভোট নেওয়া হয়েছে।) সাধারণ ভাবে কোনও বুথে ১০টি-র বেশি টেন্ডার ভোট পড়লে সেই বুথের সার্বিক রিপোর্ট খতিয়ে দেখা হয়। হাওড়ার ৪৪ নম্বর বুথেও গণ্ডগোলের খবর এসেছে। কমিশনের সচিব তাপস রায় বলেন, “আপাতত এই চারটি বুথে আবার ভোটগ্রহণের সম্ভাবনা দেখা গিয়েছে। তবে ওই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।”
বিক্ষিপ্ত গোলমাল হলেও বেশি ভাগ জায়গাতেই দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়েছেন বহু মানুষ। কলকাতা পুরসভার ১ এবং ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে ভোটের লম্বা লাইন দেখা গিয়েছে। আবার ছাপ্পা ভোটের প্রতিবাদে সদলে ভোট না দিয়েই বেরিয়ে গিয়েছেন অনেকে। যেমন, ভাটপাড়া পুরসভার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের উদয়ন প্রাথমিক স্কুলের বুথে সকাল থেকে লাইন এগোচ্ছিলই না। বুথের ভিতরে এক দল অচেনা লোকের ভিড়। বাইরে পুলিশ দর্শক। ভিতরে ঢুকে ভোটদাতারা দেখেন, ইভিএম ঘিরে দাঁড়িয়ে-থাকা কয়েক জন তাঁদের দেখিয়ে ভোট দিতে বলছেন! কয়েক জন মহিলাকে হাত ধরে ভোট দিইয়ে দেওয়ার অভিযোগও ওঠে। এক সময় প্রতিবাদ করেন এক বৃদ্ধা। |
|
গোলাবাড়িতে রাস্তায় পড়ে মমতা জায়সবাল। |
জবরদস্তিকারীদের তিনি বলেন, “তোমাদের দলকেই ভোট দিতাম। কিন্তু জোর করছো যখন, ভোটই দেব না!” তাঁর দেখাদেখি লাইন থেকে বেরিয়ে যান আরও অনেকে।
পুরভোট ঘিরে এ দিন তুমুল উত্তেজনা ছিল হাওড়ায়। সারা দিনই শহরের বিভিন্ন এলাকায় দাপিয়ে বেড়িয়েছে বাইকবাহিনী। বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ মেয়র মমতা জায়সবাল গিয়েছিলেন নিজের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের একটি বুথে। সিপিএমের অভিযোগ, তাঁকে লক্ষ করে বোমা ছোড়া হয়। এর পরে অন্য একটি বুথে ঢুকতে গেলে তাঁকে লাথি, চড় মেরে নর্দমার পাশে ফেলে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে হাওড়া জেলা হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। ওই ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী মাধবী মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে বোমা ছোড়া হয় বলেও অভিযোগ। ওই ওয়ার্ডেরই আরও একটি বুথে ভোট শেষ হওয়ার পরে বোমা ছোড়া হয়। ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের বুথের সামনে বোমা পড়ে। এতে আহত হন এক সিপিএম কর্মী। জগাছা থেকে ১৮টি তাজা বোমা-সহ তিন জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। হাওড়ার ১৩টি ওয়ার্ডে পুননির্বাচনের দাবি জানিয়েছে সিপিএম।
এ দিন নজর ছিল বহরমপুরেও। তবে বিক্ষিপ্ত বুথ-জ্যাম এবং শাসক দলের ছাপ্পা ভোটের অভিযোগ ছাড়া বিশেষ কোনও গণ্ডগোলের খবর নেই। ভোট শেষে মুর্শিদাবাদের জেলা কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, “প্রশাসন তার কাজে নিরপেক্ষতা দেখিয়েছে। পুলিশের ভূমিকাও ভাল। বড় কিছু না ঘটলেও কিছু বুথে তৃণমূলের লোকজন ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। বুথ জ্যামেরও চেষ্টা ছিল তাদের।” তৃণমূল অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। |
|
|
বোমায় জখম। সল্টলেকের এফই ব্লকে। |
হাওড়ার পিলখানায় ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে মুসলিম মহিলারা। |
|
উপনির্বাচন ঘিরে অশান্তি হয় সল্টলেকের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে। এ দিন দুপুরে এফসি কমিউনিটি হলের বুথে গোলমাল শুরু হয়। দুপুর পৌনে দু’টো নাগাদ দেখা যায়, এক দল পুরুষ ও মহিলা পাঁচিল টপকে বুথের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করেছেন। পুলিশ লাঠি চার্জ করে বুথের সামনে জড়ো হওয়া লোকজনকে তাড়াতে শুরু করে। কয়েক জনকে পেটাতে পেটাতে গাড়িতেও তুলতে দেখা যায়। এর পরেই গোলমাল ছড়িয়ে পড়ে। শাসক দলের কর্মীদের গায়ে হাত দেওয়ার অভিযোগে পুলিশ কর্তাদের গাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন তৃণমূল নেতানেত্রীরা। আক্রোশের মুখে পুলিশ কোনও মতে গাড়ি নিয়ে এলাকা ছেড়ে পালায়। পরে বিশাল বাহিনী ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়। দুপুর একটা থেকে তিনটে পর্যন্ত এফসি, এফডি ও এফই ব্লকের বিভিন্ন বুথে গোলমাল হয়। এই ঘটনায় সিপিএম ও কংগ্রেসের মোট ৯ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় দুই সিপিএম কর্মীকে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এই ওয়ার্ডে ভোট পড়েছে মাত্র ৪৯.০৫ শতাংশ। এ দিন ভোটদানের হিসেবে এটিই সব থেকে কম বলে নির্বাচন কমিশন সূত্রে খবর।
নির্বিঘ্নে ভোট হয়েছে কৃষ্ণনগর, ঝাড়গ্রামেও। কৃষ্ণনগরের দু’একটি বুথে ভোটারদের অভিযোগ, সাতসকালে বুথে এসে দেখেছেন, তাঁদের ভোট পড়ে গিয়েছে! মেদিনীপুরেও কোনও গোলমালের খবর পাওয়া যায়নি। দুপুরে পোস্ট অফিস রোডের সামনে থেকে এক বামপ্রার্থীর এজেন্টকে আটক করেছিল পুলিশ। ভোট শেষ হওয়ার পরে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। |
ছবি তুলেছেন গৌতম প্রামাণিক, রণজিৎ নন্দী, সুদীপ্ত ভৌমিক ও দীপঙ্কর মজুমদার। |
ভোটচিত্র |
পুরসভা |
ভোটের হার (%) |
হাওড়া |
৬৮.৩৯ |
ঝাড়গ্রাম |
৭৯.১৫ |
কৃষ্ণনগর |
৭৯.২৯ |
মেদিনীপুর |
৭৯.৮২ |
বহরমপুর |
৭৯.৯৬ |
|
পুরনো খবর: আজ পুরভোটে অধীর-তালুক বাদে বাকি চারে চোখ তৃণমূলের |
|
|
|
|
|