দু’মাসের মাথায় দ্বিতীয় বার। লোকসভা ভোটের আগে আজ, শুক্রবার আরও এক বার শাসক ও বিরোধীদের সামনে শহর ও মফস্সলের জনমত যাচাইয়ের সুযোগ।
পাঁচটি পুরসভায় ভোট আজ। এই তালিকায় যেমন রয়েছে কলকাতার উল্টো পারের (এবং সদ্য নবান্ন-এর জন্য রাজ্য প্রশাসনের কেন্দ্র হয়ে ওঠা) হাওড়া, তেমনই রয়েছে অধীর চৌধুরীর খাসতালুক মুর্শিদাবাদের বহরমপুর। আছে নদিয়ার কৃষ্ণনগর, যেখানে সম্প্রতি কংগ্রেসকে উজাড় করে কাউন্সিলররা তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন, ফলে ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল। আছে দীর্ঘদিন বামেদের হাতে থাকা পশ্চিম মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রাম এবং ওই জেলারই কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের মেদিনীপুর পুরসভা। এর সঙ্গে বিভিন্ন জেলায় আরও নানা পুরসভা মিলিয়ে মোট ২৯টি ওয়ার্ডে উপনির্বাচনও হবে আজ। যার মধ্যে আছে কলকাতা পুরসভার দু’টি ওয়ার্ডও (১ এবং ২৪ নম্বর)।
শাসকদল তৃণমূলের লক্ষ্য, গত পঞ্চায়েত ভোট এবং তার পরে সেপ্টেম্বরের পুরভোটে তারা যে জয় পেয়েছিল, সেই ধারা অব্যাহত রাখা। যাতে লোকসভা ভোটের প্রস্তুতিতে কোনও রকম আঁচড় না পড়ে। পক্ষান্তরে, বিরোধীরা তাকিয়ে রয়েছেন শাসক-বিরোধী হাওয়ার দিকে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বক্তব্য, কংগ্রেস শুধু বহরমপুর পুরসভা রক্ষা করার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। বামফ্রন্টের অবস্থা আরও শোচনীয়! এই পাঁচ পুরসভার মধ্যে কোনও একটিতে তাঁরা বোর্ড জিতবেন জোর গলায় এমন দাবি করার জায়গায় নেই বাম নেতারা! ভোটের ময়দান থেকে সরে না গিয়ে কর্মী-সমর্থকেরা লড়াই দিতে পারলেই লোকসভা ভোটের আগে আশ্বস্ত হবেন তাঁরা।
পাঁচটির মধ্যে রাজনৈতিক গুরুত্বের বিচারে এক নম্বরে অবশ্যই হাওড়া। একে পুর নিগম, তায় কলকাতার গায়ে গায়ে। গত জুনে হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে জিতেছে তৃণমূল। তখন থেকেই হাওড়া পুরসভা তাদের পাখির চোখ। লোকসভা উপনির্বাচনের প্রচারে গিয়েই সে কথা বারবার বলেছিলেন তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পরে রাজ্য প্রশাসনের সদর দফতরই নিয়ে চলে গিয়েছেন হাওড়ার নবান্ন ভবনে। কলকাতার কাছে প্রাচীন শহর হয়েও গুরুত্বে তারা অনেক পিছিয়ে হাওড়াবাসীর এমন অভিমান দীর্ঘদিনের। প্রশাসনের সদর দফতর হাওড়ায় নিয়ে গিয়ে ওই শহরকেই প্রায় রাজধানীর মর্যাদা দিতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বোঝাতে চেয়েছেন, পুরসভার ক্ষমতা পেলে পরিষেবা সংক্রান্ত ক্ষোভেরও সুরাহা হবে। আর এই পরিষেবার (নিকাশি, পানীয় জল) জায়গাতেই অভিযোগের তির হাওড়ার ক্ষমতাসীন বাম বোর্ডের দিকে।
এর পরেই আকর্ষণের কেন্দ্র অধীরের বহরমপুর। কয়েক বছর ধরেই সেখানে বিরোধীশূন্য পুরসভা চালাচ্ছে কংগ্রেস। কংগ্রেসের জমি ভাঙিয়ে এ বার কিছুটা মাথাচাড়া দিয়েছে তৃণমূল। |
পাঁচ পরীক্ষা |
হাওড়া |
আসন: ৫০
বামফ্রন্ট ৩৩, তৃণমূল ১২, কংগ্রেস ৪, বিজেপি ১
ক্ষমতায় বামফ্রন্ট |
কৃষ্ণনগর |
আসন: ২৪
কংগ্রেস ১৪, তৃণমূল ৮, সপা ২। সম্প্রতি কংগ্রেস ও
সপা সদস্যরা তৃণমূলে। ফলে একক ভাবে ক্ষমতায় তৃণমূল। |
ঝাড়গ্রাম |
আসন: ১৮
ক্ষমতায় বামফ্রন্ট | বাম ১৩, বিরোধীরা ৪ |
বহরমপুর |
আসন: ২৮
ক্ষমতায় কংগ্রেস। বোর্ড বিরোধী শূন্য |
মেদিনীপুর |
আসন: ২৫ | ক্ষমতায় কংগ্রেস-তৃণমূল জোট
তৃণমূল ১০, কংগ্রেস ৪, বামফ্রন্ট ৮, নির্দল ২ |
|
আবার তৃণমূল কর্মী খুন, জেলাশাসকের বাংলো ভাঙচুরের ঘটনায় অভিযুক্ত হয়েছেন অধীর। কংগ্রেসের অভিযোগ, পুরভোটের আগে মামলায় ফাঁসিয়ে কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীকে হয়রান করতে চেয়েছে রাজ্যের শাসকদল। প্রচারের ফাঁকেও জামিনের জন্য আদালতে দৌড়তে হয়েছে অধীরবাবুকে। তিনি যেমন চাইবেন তৃণমূলের চেষ্টা ব্যর্থ করে বহরমপুরকে বিরোধীশূন্যই রাখতে, তেমনই তৃণমূলের লক্ষ্য থাকবে একটা-দু’টো ওয়ার্ড জিতেও অধীরের গর্বে আঘাত হানা! অধীর-ঘনিষ্ঠ এক কংগ্রেস বিধায়ক অবশ্য বলছেন, “তৃণমূলের স্বপ্ন স্বপ্নই থাকবে! বহরমপুরে ও সব হবে না!”
দলের অন্দরে তৃণমূল নেতৃত্বও বহরমপুরকে বাদেই হিসেব কষছেন। শাসকদলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “বহরমপুর বলা যাচ্ছে না। বাকি কোথাও আমাদের জয় নিয়ে কোনও সংশয় নেই। সব মিলিয়ে ৬৫ থেকে ৭০% আসন আমরাই জিতব!”
বাম নেতৃত্বের নজর অবশ্য সুষ্ঠু ভোটের দিকেই। তাঁদের আশঙ্কা, সরকার-বিরোধী ক্ষোভের সুযোগে যেখানে যতটা ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা, শাসকদলের সন্ত্রাসের ঠেলায় সেটাও ইভিএম পর্যন্ত পৌঁছলে হয়! ভোটের প্রাক্কালে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু তাই আবেদন করেছেন, ‘পুর এলাকার নাগরিকদের কাছে সচেতন ভাবে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার আন্দোলনকে জোরদার করতে অকুতোভয়ে সর্বত্র বামফ্রন্ট প্রার্থীদের সমর্থনে ভোটদানের আহ্বান জানাচ্ছি’। তাঁর অভিযোগ, “রাজ্যে নতুন সরকার গড়ে উঠেছিল ‘বদলা নয় বদল চাই’ এ কথা বলে। এখন সরকার বদল হওয়ার পরে গণতন্ত্র ধ্বংস করে নৈরাজ্য সৃষ্টির লক্ষ্যে বদলার রাজনীতি চলছে!”
সচেতন ভাবেই এ বার পুরভোটে কোথাও প্রচারে যাননি রাজ্য সিপিএমের প্রথম সারির নেতারা। এমনকী, হাওড়াতেও নয়। এবং সেখানেই বামেরা সন্ত্রাসের ভয় পাচ্ছে বেশি। হাওড়ার মতোই বছরের পর বছর ক্ষমতাসীন থাকা ঝাড়গ্রামেও বাম প্রচারের ছবি টিমটিমে! পঞ্চায়েত ভোটে জঙ্গলমহলে তৃণমূলের তুঙ্গ সাফল্যের ধাক্কায় বামেরা এখনও এলোমেলো। বরং শুভেন্দু অধিকারীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তৃণমূল বলছে, এ বার ঝাড়গ্রামে ‘পরিবর্তন’ হলে বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়! ওই জেলারই মেদিনীপুর শহর আগে ছিল বাম-বিরোধীদের হাতে। এ বার ভোটের বাজারেও সেখানে বিরাট চাঞ্চল্য নেই।
কৃষ্ণনগর পুরসভায় কিছু দিন আগেই কংগ্রেসের হাত থেকে চেয়ারম্যান-সহ বোর্ড নিজেদের দখলে এনেছে তৃণমূল! পুরভোটেও সেই দাপট বজায় রাখা যাবে বলে প্রবল আত্মবিশ্বাসী তারা। আর ভাঙা দল নিয়েও কংগ্রেসের আশা, মানুষ যদি এই দল-ভাঙানোর রাজনীতির জবাব দেন! কলকাতা-সহ নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ওয়ার্ডগুলিতে উপনির্বাচন নিয়ে বামেদেরও আশা, তৃণমূলের প্রতি শহুরে মানুষের মোহভঙ্গ যদি তাদের বাক্সে কিছু প্রাপ্তির ব্যবস্থা করে! আর ভোট কাটাকাটির চেনা অঙ্ক তো আছেই!
তৃণমূলের আত্মবিশ্বাস অবশ্য দাবি করছে, আশা ছলনাই করবে! |