রাজ্যের আর্থিক সঙ্কট নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সরব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু গত আড়াই বছরে কেন্দ্রের কাছে বহু বার দরবার করেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এ বার রাজ্যের হাতে আরও আর্থিক ক্ষমতার দাবিতে দিল্লির বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে নামছে তৃণমূল। প্রথম ধাপে বিদ্বজ্জনদের নিয়ে কলকাতায় শীঘ্রই নাগরিক কনভেনশন ডাকা হবে। তার পর সমমনোভাবাপন্ন দলগুলিকে নিয়ে কেন্দ্র বিরোধী ধারাবাহিক কর্মসূচি নেওয়া হতে পারে।
তিন দশক আগে সরকারে এসে রাজ্যের হাতে অধিক আর্থিক ক্ষমতার দাবিতে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট। অ-কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে দিল্লির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন জ্যোতি বসু। ৩৪ বছরের বাম জমানার অবসান ঘটিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হওয়া মমতাও সেই পথেই হাঁটতে চাইছেন বলে অনেকের মত।
কেন্দ্রের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে মমতার অভিযোগ, “এ রাজ্য থেকে কেন্দ্র প্রতি বছর ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি কর বাবদ তুলে নিয়ে যায়। অথচ কেন্দ্রীয় করের অংশ হিসেবে আমরা পাই মাত্র ৮-১০ হাজার কোটি টাকা।” রাজ্যগুলি থেকে কেন্দ্র যে পরিমাণ কর আদায় করে তার অন্তত ৭০ ভাগ ফিরিয়ে দেওয়া উচিত বলে মত মুখ্যমন্ত্রীর।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বিভিন্ন আর্থিক দাবিদাওয়া নিয়ে বার বার কেন্দ্রের কাছে ছুটে গিয়েছেন মমতা। কখনও ঋণের সুদ-আসল শোধ করবার উপর তিন বছরের স্থগিতাদেশ চেয়ে, আবার কখনও বা বিশেষ আর্থিক অনুদানের অনুরোধ নিয়ে। তাঁর আক্ষেপ, “গত বিধানসভা ভোটের প্রচারে এসে প্রধানমন্ত্রী দমদমের জনসভায় জানিয়ে গিয়েছিলেন, তৃণমূল ক্ষমতায় এলে রাজ্যের ভেঙে পড়া আর্থিক অবস্থা ফেরাতে কেন্দ্র উদ্যোগী হবে। কিন্তু সে সব কিছুই হয়নি।” তাই এ বার কেন্দ্র-বিরোধী জেহাদের পথে হাঁটতে চলেছেন মমতা। তাঁর দাবি, “আমরা তো টাকা ছাপতে পারি না। তা হলে আমাদের ব্যাঙ্ক খোলার অনুমতি দেওয়া হোক।”
অনেকে অবশ্য মমতার এই উদ্যোগের পিছনে এক ঢিলে দুই পাখি মারার প্রয়াস দেখছেন। তাঁদের মতে, অ-কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীরা আর্থিক দাবিদাওয়ার প্রশ্নে সহজেই সহমত হতে পারবেন। দিল্লিতে সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী সমাবেশ করে সিপিএম ইতিমধ্যেই বেশ কিছু দলকে এক
মঞ্চে হাজির করেছে। মমতা পাল্টা হিসেবে আর্থিক বিষয়টিকেই সামনে আনতে চলেছেন। এতে এক দিকে যেমন কেন্দ্রের উপর চাপ বাড়ানো যাবে, তেমনই কংগ্রেস এবং বিজেপি-র থেকে দূরত্ব বজায় রেখে একটি বিকল্প আঞ্চলিক দলের ব্লক তৈরি করা যাবে এমনটাই মত মমতা-ঘনিষ্ঠদের।
তবে শুধু রাজনৈতিক নয়, মমতার পদক্ষেপের পিছনে প্রশাসনিক কৌশলও রয়েছে বলে অনেকের মত। রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তাদের একাংশের মতে, কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের মহার্ঘ ভাতার ফারাক ক্রমেই বাড়ছে। তার উপর কেন্দ্র ইতিমধ্যেই নতুন বেতন কমিশন গঠনের কথা ঘোষণা করেছে। ফলে বেতন কমিশন গড়ার জন্য চাপ তৈরি হচ্ছে রাজ্যের উপরেও। বকেয়া ডিএ এবং সম্ভাব্য বর্ধিত বেতন বাবদ রাজ্যের ঘাড়ে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত বোঝা চাপতে চলেছে। যা রাজ্যের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। কারণ, চলতি আর্থিক বছরের শেষে রাজ্যের ঋণের বোঝা হবে আড়াই লক্ষ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে এই সরকারের শেষ লগ্নে যা তিন লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে অর্থ দফতর সূত্রের ইঙ্গিত। এমন অবস্থায় মমতা যাবতীয় দায় কেন্দ্রের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার পন্থাই অবলম্বন করছেন বলে ওই কর্তাদের মত।
সেই কারণেই রাজ্যের কমর্চারীদের বর্ধিত বেতন থেকে শুরু করে ঋণ শোধের দায় কেন্দ্রকে বহন করতে হবে বলে লিখিত ভাবে জানিয়ে দিয়েছে রাজ্য। পাশাপাশি আগামী তিন বছরের আর্থিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে মুখ্যমন্ত্রী আর্থিক ক্ষমতা বৃদ্ধির দাবিতে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরব হতে চাইছেন বলে মনে করছে তাঁর প্রশাসনের একাংশ।
যা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে তিরিশ বছর আগে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে অ-কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীদের কেন্দ্র-বিরোধী অবস্থানকেই। ১৯৮২-’৮৩ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এন টি রামরাও, কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী রামকৃষ্ণ হেগড়েরা কেন্দ্রের কংগ্রেস-বিরোধী মঞ্চ গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন। ১৯৮৩ সালে বিজয়ওয়াড়ায় দক্ষিণের রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের প্রথম সম্মেলন হয়। সেখানেই রাজ্যগুলির হাতে আরও আর্থিক ক্ষমতা দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছিল। জ্যোতিবাবু এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানান। তার পর কেন্দ্র-বিরোধী যাবতীয় কর্মকাণ্ডের মুখ হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৮৩-র অক্টোবরে শ্রীনগরে আবার অ-কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীদের কনক্লেভ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে জ্যোতি বসু ও অশোক মিত্র একটি নথি পেশ করে কেন্দ্রের ক্ষমতা কমিয়ে রাজ্যগুলির হাতে আরও ক্ষমতা দেওয়ার দাবি জানান। কোন কোন বিষয় সংবিধানের কেন্দ্রীয় তালিকায় থাকবে, এবং কোন কোন বিষয় রাজ্যের তালিকায়, তা স্পষ্ট করে দেওয়া হয় ওই নথিতে। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত এই নথিই পরে অ-কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীদের দাবিদাওয়ার প্রধান হাতিয়ার হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গত, সেই বছরই সরকার কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুর্নবিন্যাস করতে বিচারপতি আর এস সরকারিয়ার নেতৃত্বে কমিশন তৈরি করে কেন্দ্র।
পরের বছর কলকাতায় ফের কনক্লেভ বসে। সে বার অ-কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীরা ছাড়াও ১৮টি দলের প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে এই সম্মেলনের কিছু দিন পরেই কাশ্মীরে ফারুক আবদুল্লা সরকার এবং অন্ধ্রপ্রদেশে রামরাও সরকারের পতন হয়। অভিযোগ ওঠে, কেন্দ্র-বিরোধী জোট গঠন করায় অ-কংগ্রেসি সরকারগুলিকে নিশানা করছে কেন্দ্রের শাসক দল। এর পর আর কনক্লেভ হয়নি। যদিও বামফ্রন্টের কেন্দ্র বিরোধী কর্মসূচি বহাল ছিল। মমতার এই কেন্দ্র-বিরোধী পরিকল্পনা নিয়ে অবশ্য কটাক্ষ করতে ছাড়েননি সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য তথা রাজ্যের প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন। তিনি বলেন, “তিন দশক আগের সরকারিয়া কমিশন থেকে সে দিনের চতুর্দশ অর্থ কমিশন পর্যন্ত আমরা রাজ্যের হাতে আরও ক্ষমতা দেওয়ার দাবি জানিয়েছি। এটাই আমাদের ধারাবাহিকতা। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলুন, অতীতে তিনি কখনও রাজ্যের জন্য এ ভাবে সরব হয়েছেন কিনা।” নিরুপমবাবুর মতে, “আসলে এখন মুখ্যমন্ত্রীর কিছু টাকার প্রয়োজন। যা তিনি যেমন খুশি খরচ করবেন। তাই এ সব করছেন।” |