রাতারাতি যেন বদলে গেল গোটা শহরটা। এত দিন যে শহর ‘কংগ্রেসের গড়’ বলে পরিচিত ছিল, এ বারের পুরভোটে সেই কৃষ্ণনগর শহর থেকে একে বারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল তারা। ২৪টি আসনের মধ্যে ২২টিতে জয়ী হয়েছে তৃণমূল। দু’টি আসনে জয়ী হয়েছেন নির্দল প্রার্থীরা। যদিও ওই দুই জয়ী নির্দল প্রার্থী গণনার পরই তৃণমূলে যোগ দেন।
প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই কৃষ্ণনগর পুরসভা ছিল কংগ্রেসের হাতে। এর মধ্যে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির নেতৃত্বে ১৯৮১ সালে কংগ্রেস পুরসভা নির্বাচন বয়কট করে। সে বার নির্দলরা পুরবোর্ড গঠন করে। পরে ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে বিপুল ভাবে জয়ী হয় কংগ্রেস। তারপর থেকে প্রতিটা পুরভোটে জয়ী হয়ে এসেছে তারা। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তৃণমূল হাওয়ার মধ্যে ২৪টি আসনের মধ্যে ১৪ টিতেই জয়ী হয় কংগ্রেস। |
প্রশ্ন উঠছে ঠিক কী কারণে শহরের মানুষ তাদের এতদিনের ভরসা কংগ্রেস দল থেকে পুরোপুরি মুখ ফিরিয়ে নিল? কংগ্রেস নেতারা অবশ্য এই ফলের কারণ হিসাবে নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতাকেই দায়ী করেছেন। জেলা কংগ্রেসের সভাপতি শঙ্কর সিংহ বলেন, “যে মুখগুলো এতদিন কৃষ্ণনগর শহরে কংগ্রেসের নেতৃত্ব দিত ভোটের মাত্র কয়েকদিন আগে তাঁরা দল বদল করায় হঠাৎ করে একটা শূন্যস্থান তৈরি হয়। সামান্য সময়ের মধ্যে সেই সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা যায়নি। আর সেটা সম্ভবও নয়।”
নদিয়ারই বীরনগর, কুপার্স ক্যাম্পের পর পুরভোটের মাত্র কয়েক দিন আগে কৃষ্ণনগরও দখল করে তৃণমূল। পুরসভার ১৪ জন কংগ্রেস কাউন্সলর-সহ শহরের অন্য নেতারা কলকাতায় গিয়ে তৃণমূলে যোগ দেন। আর তাতে রীতিমতো অস্তিত্বের সঙ্কটে পরে যায় কংগ্রেস। এমনকী তারা আদৌ কোনও প্রার্থী দিতে পারবে কি না, তা নিয়েও জল্পনা শুরু হয়। কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত ১৭টি ওয়ার্ডে প্রার্থী দিতে সক্ষম হয়। শহরের মানুষের দাবি, কংগ্রেস শেষপর্যন্ত যে প্রার্থীদের দাঁড় করিয়েছিল, তাঁদের বেশিরভাগেরই তেমন পরিচতি ছিল না। ফলে তাঁদের উপরে ভরসা রাখতে না পেরেই সদ্য তৃণমূলে যোগ দেওয়া পুরনো মুখগুলির উপরেই ভরসা করেছেন মানুষ।
১৯ নম্বর ওয়ার্ডের এক বাসিন্দা বলেন, “আমরা এতদিন কংগ্রেসকেই ভোট দিয়ে এসেছি। কিন্তু এবার তৃণমূলকেই ভোটটা দিলাম।” কিন্তু কেন? তাঁর কথায়,“শুধু আমাদের ওয়ার্ডেই নয়, অন্য ওয়ার্ডেও একই সমস্যা হয়েছে। আমরা কংগ্রেস করলেও ভোট দেব কাকে?” সদ্য কংগ্রেস ত্যাগ করে তৃণমূলে যোগ দেওয়া বিদায়ী পুরপ্রধান অসীম সাহা বলেন, “যারা এই শহরের বুকে দাঁড়িয়ে আমাদের বিশ্বাসঘাতক বলে গালি দিয়েছিল, আমাদের হয়ে শহরের মানুষ তাদের জবাব দিয়ে দিলেন।” |
শহরের মানুষ কংগ্রেসকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে উন্নয়নের জোয়ারের পক্ষেই রায় দিয়েছেন জনতা।
গৌরীশঙ্কর দত্ত,
তৃণমূলের জেলা সভাপতি |
যাঁরা এই শহরে কংগ্রেসকে নেতৃত্ব দিতেন, ভোটের মুখে তাঁরা দলবদল করায় সেই শূন্যস্থান পূরণ সম্ভব হয়নি।
শঙ্কর সিংহ,
জেলা কংগ্রেস সভাপতি |
এই শহরে আমাদের ফল ভাল হয় না। বুথ ভিত্তিক ফল পর্যালোচনার পরই এবারের ফলের কারণ জানা যাবে।
সুমিত দে,
সিপিএমের জেলা সম্পাদক |
ফলাফল এক নজরে
সবিস্তার... |
|
এবার তৃণমূল যে বোর্ড গঠন করবে, তা যেন এক প্রকার ঠিক হয়েই ছিল। কিন্তু শহরের মানুষের মনে একটাই কৌতূহল ছিল, শেষপর্যন্ত কংগ্রেস সহ বিরোধীরা ক’টি আসন পাবে? সোমবার সকালেই কৃষ্ণনগর শহর বুঝতে পেরে যায়, কী হতে চলেছে। তৃণমূল ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলের কর্মী, সমর্থকদের গণনা কেন্দ্রের সামনে বিশেষ দেখা যায়নি। সকাল থেকেই ছিল তৃণমুল সমর্থকদের উপচে পড়া ভিড়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই ভিড় বেড়েছে। সবুজ আবিরে ঢেকে যায় গোটা এলাকা। গণনাকেন্দ্রের ভিতরে একে একে ঢুকতে থাকেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত থেকে শুরু করে রাজ্যের কারিগরী শিক্ষা মন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস। এরই মধ্যে ৫ নম্বর ওয়ার্ডের জয়ী নির্দল পার্থী অর্পিতা চক্রবর্তী এসে প্রণাম করলেন গৌরীশঙ্কর দত্তকে। সেখানেই ঠিক হয়ে যায় যে, অর্পিতাদেবী তৃণমূলে যোগ দেবেন। গণনাকেন্দ্রে ভিতরেরই অর্পিতা দেবীর পাশাপাশি ৯ নম্বর ওয়ার্ডের জয়ী নির্দল প্রার্থী রীতা দাসও তৃণমূলে যোগ দেন। দু’জনেই দাবি করেন, “তৃণমূলের প্রার্থীদের এলাকার মানুষ মেনে নিতে পারেননি বলেই আমাদের এক প্রকার জোর করে দাঁড় করিয়েছে। ফল প্রকাশের পর দেখছি গোটা শহরই তৃণমুলকেই চেয়েছে। শহরের মানুষের এই চাহিদার কথা মাথায় রেখেই আমরা তৃণমূলে যোগ দিলাম।” অর্পিতাদেবী এ বারই প্রথম ভোটে দাঁড়ালেও রীতাদেবী ৯ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ১৯৯৮ ও ২০০৩ সালে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে থেকে জয়ী হয়েছিলেন। ২০০৮ সালে তিনি মাত্র ৫৬ ভোটের ব্যবধানে তৃণমূলের কাছে পরাজিত হন। চারদিকে সবুজ আবিরের মধ্যে ওই দুই নির্দল প্রার্থী ও তাঁদের গুটিকয়েক সমর্থকদের মাথায় হলুদ আবির তাদের আলাদা করেই রেখেছিল। তবে গণনাকেন্দ্রের বাইরে বের হতেই ওই দুই নির্দল প্রার্থীদের নিয়েই উল্লাসে ফেটে পড়েন তৃণমুল কর্মী সমর্থকরা। |