নিরাপত্তা সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশ না-মানায় সোমবার বেঙ্গালুরুতে হাজারের বেশি এটিএম কাউন্টার বন্ধ করে দিল সেখানকার পুলিশ। কলকাতাতেও এ দিন এটিএম-নিরাপত্তা নিয়ে ব্যাঙ্ক-কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে কড়া মনোভাব প্রকাশ করেছে লালবাজার।
২০ নভেম্বর বেঙ্গালুরুতে ব্যাঙ্ক ম্যানেজার এক মহিলাকে এটিএম কাউন্টারের ভিতরেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তাঁর টাকা লুঠ করেছিল এক দুষ্কৃতী। ওই ঘটনায় কলকাতা পুলিশও নড়েচড়ে বসেছে। এটিএম কাউন্টারে নজরদারি বাড়ানোর জন্য গত বৃহস্পতিবার সব থানায় নির্দেশ গিয়েছে। তার পরে এ দিন এটিএম-সুরক্ষা নিয়ে লালবাজারে ব্যাঙ্ক-কর্তাদের জরুরি বৈঠকে ডেকেছিলেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ। পুলিশ-সূত্রের দাবি, এটিএম-সুরক্ষায় কোনও ঢিলেমি বা আপস যে পুলিশ বরদাস্ত করবে না, বৈঠকে উপস্থিত রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাঙ্কের অফিসারদের তা স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য অরক্ষিত সমস্ত এটিএমে অবিলম্বে রক্ষী নিয়োগ, নজরদারি-ক্যামেরার সংখ্যা ও গুণমান বৃদ্ধি ও বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ক্যামেরা বসানো-সহ এক গুচ্ছ প্রস্তাব ব্যাঙ্কগুলোকে দিয়েছে লালবাজার। |
লালবাজারের হিসেবে, কলকাতা শহরে হাজারের বেশি এটিএম কাউন্টার রয়েছে, যার অন্তত ৬০% রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন ব্যাঙ্কের। তার বেশির ভাগই রক্ষীবিহীন। বেঙ্গালুরু-কাণ্ডের প্রেক্ষাপটে দ্রুত সেগুলোয় প্রহরী মোতায়েনে জোর দিয়েছেন কলকাতা পুলিশের কর্তারা। সূত্রের খবর, বৈঠকে কয়েকটি ব্যাঙ্কের কর্তারা বলেছিলেন, সব এটিএমে রক্ষী নিয়োগ করতে হলে আর্থিক সমস্যায় পড়তে হবে। কিন্তু লালবাজারের কর্তারা তাঁদের পরিষ্কার জানিয়ে দেন, তাঁরা মানুষের নিরাপত্তার প্রশ্নকে সবার আগে রাখেন। এবং বেঙ্গালুরুর ঘটনা এটিএম ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা সম্পর্কে পুলিশকে উদ্বেগে ফেলেছে।
এমতাবস্থায় ব্যাঙ্ক-কর্তাদের পুলিশ বলেছে, অবিলম্বে সব প্রহরাহীন এটিএম কাউন্টারের তালিকা সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দিতে হবে। ব্যাঙ্ক-কর্তাদের কাছে পুলিশের এ-ও অভিযোগ, বহু এটিএম কাউন্টারে বসানো ক্যামেরা অত্যন্ত নিম্নমানের। ছবি ভাল ভাবে বোঝা যায় না। নিম্নমানের ওই সব ক্যামেরা (ভিজিএ) সরিয়ে উন্নত মানের (মেগাপিক্সেল) ক্যামেরা আনা জরুরি। আবার অনেক জায়গায় পিন-হোল ক্যামেরার লেন্সের উপরে আলো পড়ায় ছবি কালো হয়ে যাচ্ছে। সমস্যা সুরাহায় এটিএম কাউন্টারের ভিতরে-বাইরে পর্যাপ্ত ক্যামেরা বসানোর প্রস্তাব দিয়েছে লালবাজার। বেঙ্গালুরুর হামলাকারী এটিএমে ঢুকে কাউন্টারের শাটার নামিয়ে দিয়েছিল। তথ্যটি মাথায় রেখে কলকাতা পুলিশের প্রস্তাব, এটিএম কাউন্টারের শাটার তুলে দেওয়ার পরে তা ‘লক’ করা হোক, যাতে অন্য কেউ এসে নামাতে না-পারে।
পাশাপাশি পুলিশ কমিশনার সম্পূর্ণ নতুন একটি ব্যবস্থা চালু করার প্রস্তাব দিয়েছেন। সেটা কী? লালবাজারের খবর: প্রতি কাউন্টারে একটা বিশেষ বোতাম বা সতর্ক-ঘণ্টি থাকুক, যে কোনও বিপদে গ্রাহক যা টিপতে পারবেন। ব্যবস্থা এমন হোক, যাতে বোতাম টিপলেই স্থানীয় থানা ও ব্যাঙ্কের দফতরে বিপদ-বার্তা পৌঁছে যাবে। বৈঠকে উপস্থিত এক শীর্ষ পুলিশ-কর্তার কথায়, “সাধারণত এটিএমে ব্যাঙ্কের নম্বর দেওয়া থাকে। কিন্তু বিপদে পড়লে ফোন করার মতো অবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই থাকে না। তা ছাড়া ফোন করলেও সাহায্য আসতে সময় লাগে।” বিপদঘণ্টি থাকলে সাহায্য অনেক তাড়াতাড়ি আসতে পারে বলে ওঁর দাবি। “শুধু ব্যাঙ্কের গ্রাহক নন, পথে বিপন্ন অন্য মানুষেরও কাজে লাগবে। রাস্তায় বিপদে পড়লে মানুষ কাছাকাছির কোনও এটিএম কাউন্টারে ঢুকে বিপদ-সঙ্কেত পাঠাতে পারবেন।” মন্তব্য তাঁর। |
বেঙ্গালুরু-কাণ্ডের পরে কর্নাটক সরকার নোটিস জারি করে বলেছিল, সব ব্যাঙ্কের সমস্ত এটিএম-কিয়স্কে রক্ষী মোতায়েন করতে হবে। রক্ষীর দায়িত্ব নিতে হবে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ককেই। কিয়স্কে সিসিটিভি, অ্যালার্ম ও ম্যাগনেটিক স্ট্রিপের (যাতে কার্ড ঢোকালে তবেই এটিএমের দরজা খুলবে) ব্যবস্থারও নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশ কার্যকর করার জন্য সরকার ২৪ নভেম্বর বিকেল চারটে পর্যন্ত সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছিল। কলকাতা পুলিশ অবশ্য সময়সীমা দেয়নি। তবে এ দিনের বৈঠকে উপস্থিত পঞ্চাশেরও বেশি ব্যাঙ্ক-কর্তাকে লালবাজারের স্পষ্ট বার্তা: যুদ্ধকালীন তৎপরতায় এটিএমে নিরাপত্তা বাড়াতে হবে।
পুলিশের হিসেব মতো, কলকাতা ও আশপাশে মোট এটিএমের সংখ্যা হাজার চারেক। উপরন্তু ইদানীং জেলায় জেলায় মহকুমা শহরে তো বটেই, এমনকী ব্লকে ব্লকেও এটিএম কাউন্টার হয়েছে। কিন্তু কলকাতা পুলিশ এ দিন ব্যাঙ্ক-কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসলেও রাজ্য পুলিশের তরফে তেমন কোনও উদ্যোগ এখনও নেই। যদিও রাজ্য পুলিশের আইজি (আইন-শৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা এ দিন আশ্বাস দিয়েছেন, “আমরাও উদ্বিগ্ন। শিগগিরই ব্যাঙ্কগুলোর সঙ্গে বসব। তাদের বলা হবে এটিএমের নিরাপত্তা বাড়াতে।” কবে সেই বৈঠক হবে, তার কোনও ইঙ্গিত অবশ্য মেলেনি।
লালবাজারে এ দিনের বৈঠক প্রসঙ্গে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার এক কর্তা বলেন, “এটিএম-নিরাপত্তা সম্পর্কে সমস্ত ব্যাঙ্ককে নিয়ে কোর কমিটি তৈরির প্রস্তাব কলকাতা পুলিশ দিয়েছে। আরও প্রস্তাব রয়েছে। আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। এ ব্যাপারে রিজার্ভ ব্যাঙ্কেরও পরামর্শ চাওয়া হবে।”
|