বেঙ্গালুরুর এটিএমে এক মহিলার উপরে দুষ্কৃতী হামলার ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে কর্নাটক সরকার। নির্দেশ জারি হয়েছে, নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন করতে না-পারলে এটিএম বন্ধ করে দিতে হবে। ঘটনা হল, পশ্চিমবঙ্গেও অধিকাংশ এটিএম চলে নিরাপত্তারক্ষী ছাড়াই। গ্রাহকদের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের বিশেষ হেলদোল নেই বলেই অভিযোগ গ্রাহকদের একটি বড় অংশের।
যদিও বেঙ্গালুরুর মতো ঘটনা এ রাজ্যেও যে কোনও সময় ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছে পুলিশই। বস্তুত, এটিএম লুটপাটের ঘটনা এখানে আগেও একাধিক বার ঘটেছে। কলকাতা ও রাজ্য পুলিশের কর্তাদের দাবি, এটিএমে নিরাপত্তা বাড়ানোর কথা বারবার বিভিন্ন ব্যাঙ্কের কর্তাদের বলেও কোনও লাভ হয়নি।
পুলিশের হিসেবে শুধু কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায় রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাঙ্ক মিলিয়ে হাজার চারেক এটিএম রয়েছে। গোটা রাজ্যের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি। পুলিশ-কর্তাদের অভিযোগ, হাতেগোনা কয়েকটি বেসরকারি ব্যাঙ্ক ছাড়া বেশির ভাগ ব্যাঙ্কের এটিএম কাউন্টার কার্যত অরক্ষিত। তাঁরা জানান, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এটিএমগুলিতেই নিরাপত্তার সমস্যা সব চেয়ে বেশি। কয়েকটি ব্যাঙ্কের এটিএম-এ ঢোকার সময়ে কার্ড পাঞ্চ করার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। কার্ড পাঞ্চ করে ভিতরে ঢুকে এটিএমের দরজা বন্ধ করে দেওয়া যেত। তখন বাইরে থেকে আর কেউ ঢুকতে পারতেন না। কিন্তু সেগুলির বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ।
পুলিশের একাংশ এবং গ্রাহকদের বড় অংশের মতে গ্রাহকের সুরক্ষা নয়, ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ এটিএম যন্ত্র এবং টাকার নিরাপত্তা নিয়েই বেশি চিন্তিত। তাই এটিএম নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনার সময় এটিএম মেশিনের ভল্টে রাখা টাকার বিমা করানো রয়েছে বলে দাবি করেই ব্যাঙ্ক-কর্তারা হাত ধুয়ে ফেলেন। পুলিশ জানায়, এটিএম কাউন্টার থেকে জালিয়াতি, চুরি, কেপমারি কিংবা ডাকাতি হলে ব্যাঙ্ক তার কোনও দায়ও নিতে চায় না। পুলিশের বক্তব্য, এ রাজ্যের বেশির ভাগ এটিএমেই নিরাপত্তারক্ষী থাকেন না। ফলে রাতে কিংবা ভোরের ফাঁকা সময়ে টাকা তুলতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের শিকার হতেই পারেন গ্রাহকেরা।
ব্যাঙ্ক-কর্তারাও অবশ্য নিরাপত্তারক্ষী না থাকার বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেননি। স্টেট ব্যাঙ্কের কর্তারা জানান, বেঙ্গল সার্কেলে তাঁদের ২৩০০ এটিএম রয়েছে। এর মধ্যে ৯০০টি এটিএম কাউন্টারে রক্ষী রয়েছে। বাকিগুলিতেও রক্ষী নিয়োগ করা হচ্ছে বলে তাঁদের দাবি। ইলাহাবাদ ও ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কর্তাদের দাবি, তাঁদের সব এটিএমেই নিরাপত্তারক্ষী রয়েছে। যদিও গ্রাহকদের বক্তব্য, বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে তা মিলছে না।
শুধু রক্ষী নয়, এ রাজ্যে এটিএমের নিরাপত্তায় অন্য অভাবও প্রকট। কলকাতা পুলিশের এক কর্তার বক্তব্য, বেঙ্গালুরুর ঘটনায় সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ খুবই স্পষ্ট। ফলে দুষ্কৃতীকে শনাক্ত করতে অসুবিধা হবে না সেই শহরের পুলিশের। কিন্তু এ শহরে এমন ঘটনা হলে, তার তদন্তে কালঘাম ছুটে যেতে পারে। কেন?
গোয়েন্দা-কর্তারা বলছেন, এ শহরের অধিকাংশ এটিএম কাউন্টারে নিরাপত্তারক্ষী তো থাকেই না। তার উপরে ভিতরে এমন নিম্নমানের ক্যামেরা (ভিজিএ) বসানো থাকে যে, তার ফুটেজ থেকে দুষ্কৃতীকে চেনাই দায় হয়ে ওঠে। তার উপরে ক্যামেরার উল্টো দিকে আলো লাগানোর ফলে কালো, অস্পষ্ট ছবি ওঠে। তা ছাড়া, মেশিনের উপরে লাগানো ক্যামেরা সহজে নষ্ট করা সম্ভব বলেও পুলিশের দাবি। পুলিশের বক্তব্য, এটিএমের নিরাপত্তার জন্য কাউন্টারের ভিতরে উন্নত প্রযুক্তির (মেগাপিক্সেল) ‘ডোম ক্যামেরা’ (যাতে ভিতরের পুরোটাই দেখা যাবে) বসানোর কথা। কিন্তু এটিএম পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থার এক কর্তা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে ডোম ক্যামেরা লাগানো হলেও তা কাজ করে না।
সমস্যা আরও। বেঙ্গালুরুতে এটিএম কাউন্টারের শাটার নামিয়ে ওই মহিলার উপরে হামলা চালিয়েছে দুষ্কৃতীটি। চলে যাওয়ার সময় ফের শাটার নামিয়ে দিয়ে গিয়েছে। ফলে প্রায় ঘণ্টা তিনেক রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলেন ওই মহিলা। পুলিশ সূত্রের বক্তব্য, এটিএম কাউন্টারের শাটার তুলে দেওয়ার পরে সেটা তালা দিয়ে আটকে দেওয়ার কথা। যাতে যে কেউ ইচ্ছামতো তা বন্ধ করে দিতে না-পারে। কিন্তু বেঙ্গালুরুর মতো এ রাজ্যেও এটিএমগুলির শাটার খোলার পরে ঠিক মতো তালা লাগানো হয় কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয় পুলিশ। এটিএম পরিষেবা-প্রদানকারী একটি সংস্থা সূত্রের খবর, শাটারের চাবি নিরাপত্তারক্ষী কিংবা এটিএম কাউন্টারের হেফাজতকারী সংস্থার কাছে থাকে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, শাটারটিতে চাবি লাগানো হয় না।
তবে এটিএমের গ্রাহকদের নিরাপত্তা দিতে শুধু ক্যামেরা বা অন্য যন্ত্রপাতি নয়, নিরাপত্তারক্ষী রাখাটা যে অত্যন্ত জরুরি সে ব্যাপারে পুলিশ এবং পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলির কর্তারা মোটামুটি একমত। যদিও বেঙ্গালুরুর মতো রক্ষীবিহীন এটিএম বন্ধ করে দেওয়ার কোনও নির্দেশ এ রাজ্যে এখনও পর্যন্ত আসেনি।
রাজ্য গোয়েন্দা-পুলিশ, সিআইডির ডিআইজি (স্পেশ্যাল) শঙ্কর চক্রবর্তী বলেন, “গ্রাহকদের নিরাপত্তার কথা আমাদের মাথায় রয়েছে। ব্যাঙ্কগুলির সঙ্গে কথা বলে নিরাপত্তার বিষয়টি ফের খতিয়ে দেখা হবে। গ্রাহকেরা যাতে নিরাপদে টাকা তুলতে পারেন, তা নিশ্চিত করার জন্য ব্যাঙ্ক-কর্তাদের কয়েকটি সুপারিশ করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।” |
কোথায় গলদ |
• বেশির ভাগ জায়গায় নিরাপত্তারক্ষী নেই
• পুরো কাউন্টারে নজরদারির ক্যামেরা নেই
• নিম্ন মানের ক্যামেরা। ফলে ছবি অস্পষ্ট
• তার উপরে বহু ক্ষেত্রে আলো ক্যামেরার উল্টো দিকে
• কার্ড পাঞ্চ করে গেট খোলার ব্যবস্থা নেই। থাকলেও বিকল
• শাটার তোলার পরে তা আটকানোর জন্য তালা নেই |
|