|
|
|
|
ওস্তাদের মার ‘কোলাসো’ রাতে |
ডার্বি জিতে সর্ষে-ইলিশ খেতে চাইলেন আর্মান্দো
দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় • কলকাতা |
ফুটবলের মক্কায় অভিষেক ম্যাচে ডার্বি জিতেই আর্মান্দো কোলাসো কি নিখাদ বাঙাল বনে গেলেন? জয়ের পর ড্রেসিংরুমে তো সে রকমই ছবি!
পর্ক ভিন্দালু, ফ্রায়েড পমফ্রেট, চিকেন জাকুতি, প্রন বালচাও-এর মতো নিখাদ ‘কোঙ্কনি অশন’ নয়। মোহনবাগানকে হারিয়ে আর্মান্দো খেতে চাইলেন খাঁটি ‘বাঙাল হেঁসেল’-এর রেসিপি। সর্ষে ইলিশ!
ড্রেসিংরুম থেকে তখন একে একে বেরিয়ে যাচ্ছেন লালরিন্দিকা, অর্ণব, সুয়োকারা। ঠিক তখনই ইস্টবেঙ্গলের গোয়ান কোচ চোখ টিপলেন পাশে দাঁড়ানো অ্যালভিটো ডি’কুনহার দিকে। রাজ্যোয়ালি অ্যালভিটোকে বললেন, “টেনশনে গত চার দিন ভাল করে কিছু খাইনি। আজ কিন্তু পেট পুরে সর্ষে-ইলিশ খাব। টোট্যাল ইস্টবেঙ্গল-ডেলিকেসি। অ্যালভি, তুই জোয়াকিম, লোবোদের বলে দে একটা রান্নার লোক ধরে আনতে।” কোচের আবদার শুনেই এগিয়ে এলেন লাল-হলুদের অন্যতম শীর্ষ কর্তা দেবব্রত সরকার। তখনই ক্লাব কর্মীদের এক জনকে পাঠিয়ে দিলেন বাজারে ইলিশ কিনতে।
কথা বলার ফাঁকেই গোয়া থেকে এল স্ত্রী জুলিয়ানা এবং মেয়ে জেনেভিভের ফোন। আর্মান্দোর গ্রাম আগোসেইম থেকে ফোন করছেন একের পর এক শুভানুধ্যায়ীরা। আর্মান্দোকে দেখে তখন কে বলবে মাঠের মধ্যে এই লোকের দাপটেই কাঁপে ফুটবলাররা। ময়দানের প্রথম গোয়ান কোচ তখন একইসঙ্গে রোম্যান্টিক স্বামী, স্নেহশীল পিতা, পাড়ার আড্ডাবাজ। ফোনে কোঙ্কনি ভাষায় স্ত্রী-মেয়ের সঙ্গে কথা বললেন পাক্কা দশ মিনিট। তার পর এই প্রতিবেদকের দিকে ফিরে বলতে শুরু করলেন, “আজ রাতে ঘুমবো না। এখন তাড়াতাড়ি লাইন ছেড়ে দিলাম। বাড়ির সবাইকে বলেছি রাতে ফোন করতে।” |
|
ছবি: উৎপল সরকার। |
এখানেই না থেমে ‘রোম্যান্টিক’ আর্মান্দো আরও বললেন, “জুলিয়ানার খুব চিন্তা ছিল। কলকাতায় আসার আগে বলেছিল, পারবে তো? তো এখন ওকে বললাম, তোমার আর্মান্দো পেরেছে। আর্মান্দো ইজ আর্মান্দো ইন কলকাতা।” পরক্ষণেই সেলিব্রেশন মুড হাজির। বললেন, “রাতে ডিভিডি-তে ভাল একটা সিনেমাও দেখব রিল্যাক্স করতে।” কার ছবি? “আরে ভারতে তো আমার একটাই অভিনেতা। অমিতাভ। আর অভিনেত্রী আপনাদের জয়া ভাদুড়ি। ‘জঞ্জির’ বা ‘সিলসিলা’ দেখব রাতে।”
ডার্বির রেশ তখনও যায়নি চোখমুখ থেকে। রেফারি প্রতাপ সিংহ খেলা শেষের বাঁশি বাজাতেই দু’হাত তুলে হাঁটু গেড়ে মাঠে বসে পড়েছিলেন। তার পরেই জড়িয়ে ধরেন সহকারী কোচ রঞ্জন চৌধুরীকে। শুভেচ্ছা জানিয়ে সোজা ছুট। চিডি-ডিকা-ওপারাদের উষ্ণ আলিঙ্গন। এ বার লাল-হলুদ গ্যালারির দিকে হাত তুলে অভিনন্দন কুড়োনোর পালা। সঙ্গে স্বগতোক্তি, “গড, আয়্যাম সো লাকি! হোয়াট অ্যান অ্যাম্বিয়্যান্স।”
সাংবাদিক সম্মেলন সেরে সোজা ড্রেসিংরুমে। ফুটবলারদের একে একে শুভেচ্ছা জানিয়ে বসে পড়লেন প্রার্থনায়।” দরজা বন্ধ ড্রেসিংরুমের। তবু বাইরে সমর্থকদের ‘আর্মান্দো’ ‘আর্মান্দো’ চিৎকার ঢুকে আসছিল ভেতরে।”
আনন্দবাজারের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই কপট রাগ। বললেন, “কলকাতার কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধু তো বলেছিলেন আমি রোজ সন্ধেয় তিন ঘণ্টা ঘুমোই। এখন তো সন্ধে। ঘুমে ঢলে পড়েছি কি? যারা পিছনে বলার তারা বলবেই। আমি নিজের কাজ করে যাব।” এর পরেই প্রত্যাহার করলেন কলকাতার ডার্বি নিয়ে তাঁর অতীত মন্তব্য। বললেন, “পাঁচ বার আই লিগ জিতেছি। ওটা আলাদা মুহূর্ত। কিন্তু কলকাতার ডার্বি! উরিব্বাস! এত লোক। লাল-হলুদ সমর্থকদের আবেগ সব ভুলিয়ে দিল। সত্যিই এটা একটা অন্য ম্যাচ। আর চার-পাঁচটা ম্যাচের মতো নয়। ভুল বলেছিলাম।” |
|
এ দিন ম্যাচের আগে ড্রেসিংরুমে ঢুকে ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে রেখেছিলেন, “বিলিভ ইন ইয়োরসেলফ। গো অ্যান্ড উইন দ্য ম্যাচ।” আর চিডি-মোগা-ডিকাদের বলেছিলেন, “কলকাতায় আমার প্রথম ম্যাচ। আমাদের সকলের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। আমাকে একটা জয় গিফট করবে কি?” ম্যান ম্যানেজমেন্টে তুখোড় কোচ মানছেন এই কথাটার মর্যাদা রেখেছেন তাঁর ছেলেরা। বললেন, “স্ট্র্যাটেজি ছিল চারটে। ওডাফার জন্য ডাবল কভারিং। ডেনসনের বল বাড়ানো বন্ধ করতে লাগিয়েছিলাম লোবোকে। বাঁ দিকে ডিকা আর সৌমিককে বলেছিলাম পালা করে আক্রমণে যেতে। আর কাতসুমির জন্য ছিল খাবরা।”
তার পর হেসে বললেন, “ডিকার গোলটা অনবদ্য। ওটাই ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট। তবে আমাকে আজ বাঁচিয়ে দিল আমার ওই ‘বুড়ো ছেলে’ অভিজিৎ।”
আর এই স্মরণীয় জয়? এখানেও বুঝিয়ে দিলেন কেন তিনি বর্তমান ভারতীয় ফুটবলে ম্যান ম্যানেজমেন্টে এক নম্বর। বলে দিলেন, “কৃতিত্বটা আমার নয়। আমার ছেলেদের। আর এই জয়টা উৎসর্গ করলাম আমাদের আগের কোচ ফালোপাকে।” আর মর্গ্যান? যিনি ফিরে এলে আর লাল-হলুদ ‘হটসিটে’ বসাই হত না আর্মান্দোর। এ বারও পেশাদার ঢংয়ে বললেন, “ডিকার গোলটা উৎসর্গ করছি মর্গ্যানকে। আমি গোয়ায় যা করতাম উনি ইস্টবেঙ্গলে সেটাই করার চেষ্টা করতেন।”
তাল কাটল এর পরে। যখন প্রশ্ন করা হল সুয়োকাকে এ দিনও তুলে নেওয়ার সময় জাপানি ফুটবলার যে খেলোয়াড়োচিত আচরণ করলেন না! শান্ত গলায় আর্মান্দো বললেন, “ও মাঝেসাঝে একটু রেগে যায়। আজও গিয়েছে। আমার কিন্তু বেশ লাগে। গায়ে মাখি না।” আর করিম? সম্মুখ সমরে আপনার জেতার রেকর্ড তো বেড়েই চলেছে। এ বার জবাব; “অন্য প্রশ্ন করুন। পরের ম্যাচ নিয়ে ভাবতে দিন। প্রথম লক্ষ পেরোলাম। এ বার আই লিগটা দিতে হবে ইস্টবেঙ্গলকে।
হঠাৎ যেমন বদলে গিয়েছে ইস্টবেঙ্গল দলের চালচলন। তেমনই ডেম্পোর মেজাজি আর্মান্দোর সঙ্গে মেলানো মুশকিল এই লাল-হলুদের আর্মান্দোকে! |
পুরনো খবর: প্রার্থনা আর টিমগেম অস্ত্র আর্মান্দোর |
|
|
|
|
|