সল্টলেকের সেক্টর ফাইভের ভেড়িতে রবিবার সন্ধ্যায় যে মা ও ছেলের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে, তাঁরা মানসিক অবসাদে আত্মহত্যা করেছেন বলে দাবি করেছে পরিবার। মৃতার স্বামী ডিভিসি-র অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার শ্যামল ভট্টাচার্য সোমবার দাবি করেছেন, তাঁর স্ত্রী তন্দ্রা (৬৭) এবং ছেলে সৌম্য (৪০) দু’জনেই মানসিক অবসাদ থেকে আত্মহত্যা করেছেন। পুলিশ অবশ্য এখনই এ ব্যাপারে তাদের চূড়ান্ত মতামত দিচ্ছে না। মা ও ছেলের ময়না-তদন্তের রিপোর্ট এবং আরও জিজ্ঞাসাবাদের পরেই তাঁরা এ ব্যাপারে মন্তব্য করবেন বলে তদন্তকারী অফিসার জানান। মনোবিদদের সঙ্গেও কথা বলবেন তদন্তকারীরা।
কী কী কারণে তাঁর স্ত্রী এবং ছেলে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন, তার পাঁচটি কারণও পুলিশকে জানিয়েছেন শ্যামলবাবু। পুলিশ সূত্রে খবর, সেই পাঁচটি সম্ভাব্য কারণ হল, (ক) স্বামী বিদেশ যেতে না চাওয়ায় আমেরিকার চাকরি ছেড়ে তাঁর মেয়ের দেশে ফিরে আসা, (খ) মাস কয়েক আগে মেয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু (আত্মহত্যা), (গ) ছেলে সৌম্যর বিবাহ বিচ্ছেদ, (ঘ) শ্বশুরবাড়ির সকলের বিরুদ্ধে সৌম্যর স্ত্রীর বধূ-নির্যাতনের মামলা করা (এখনও চলছে), (ঘ) মেয়ের মৃত্যুর পরে সৌম্যকে বিদেশ না যেতে না দেওয়া ও (ঙ) শেষে বহুজাতিক সংস্থা থেকে সৌম্যর চাকরি চলে যাওয়া।
রবিবার সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ সল্টলেক সেক্টর ফাইভের মুন্সির ভেড়ি থেকে মা ও ছেলের দেহ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। পাতলা দড়ি দিয়ে একে অন্যের সঙ্গে হাতে-হাত ও পায়ের সঙ্গে পা বাঁধা ছিল। সৌম্যের পিঠে ইট ভর্তি ব্যাগ মিলেছিল। সৌম্যর ব্যাগে তল্লাশি চালিয়ে তাঁর মোবাইল ফোনটি মেলে। পুলিশের বক্তব্য, ফোনটি চালু ছিল। এর মধ্যেই সৌম্যর মোবাইলে একটি ফোনও আসে। পুলিশই তা ধরে। পুলিশ জানিয়েছে, ফোনটি করেছিলেন সৌম্যর বাবা শ্যামলবাবু। তাঁর সঙ্গেই কথা বলে জানা যায়, মা তন্দ্রাদেবীর সঙ্গে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন সৌম্য।
সোমবার সল্টলেকের বি জে ব্লকের ২৩ নম্বর দোতলা বাড়িতে নির্বাক হয়ে বসেছিলেন বছর সত্তরের শ্যামল ভট্টাচার্য। ঝাঁ চকচকে বাড়িটিতে সচ্ছলতার ছাপ স্পষ্ট। সদ্য রঙের পোঁচ পড়েছে দেওয়ালে। বাড়ির এক ছেলে ও এক মেয়ে দু’জনেই কৃতী। কিন্তু তা হলে সমস্যাটা ঠিক কোথায়? গৃহকর্তা বলেন, মেয়ে শর্মিষ্ঠা আমেরিকায় ‘অ্যাপল’ সংস্থায় চাকরি করতেন। বছর সাতেক আগে হাওড়ার বাসিন্দা এক যুবক সঙ্গে বিয়েও হয়েছিল। কিন্তু তাঁর স্বামী অসুস্থ মাকে ছেড়ে স্ত্রীয়ের সঙ্গে আমেরিকায় যেতে পারেননি। সাংসারিক টানাপোড়েনেই বছর দু’য়েক আগে দেশে ফিরে আসেন শর্মিষ্ঠা। কিন্তু এ দেশে তিনি মানিয়ে নিতে পারেননি বলে শ্যামলবাবু জানান। তিনি বলেন, “আমেরিকায় ফিরে যেতে চেয়েছিল মেয়ে। কিন্তু অসুস্থ মাকে ছেড়ে জামাই যেতে পারেনি। ফলে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে শর্মিষ্ঠা।”
মাস কয়েক আগের এই ঘটনার পরেই তন্দ্রাদেবী মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। শ্যামলবাবু জানিয়েছেন, স্ত্রীর চিকিৎসাও শুরু হয়। দিদির এমন মৃত্যু নাড়া দিয়েছিল ভাইকেও। শ্যামলবাবু বলেন, “ছেলে শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছিল। পরে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টেও ভর্তি হয়েছিল।” সুইৎজারল্যান্ড এবং বেঙ্গালুরু থেকে চাকরি করে কলকাতায় থিতু হয়েছিলেন সৌম্য। ২০০৯ সালে বিয়েও হয়েছিল তাঁর। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তবে বিচ্ছেদের আগে সৌম্য এবং তাঁর বাবা-মা-দিদি-জামাইবাবুর নামে বধূ নির্যাতনের মামলা দায়ের হয়েছিল। তা এখনও চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
শ্যামলবাবু জানান, কলকাতায় একটি বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় চাকরি করতেন সৌম্য। সম্প্রতি তাঁরা বিদেশে পাঠাতে চেয়েছিল তাঁকে। কিন্তু মেয়ের মৃত্যুর পরে ছেলেকে আর কাছছাড়া করতে চাননি শ্যামলবাবু-তন্দ্রাদেবী। তিনি বলেন, “বাবিকে (সৌম্যের ডাকনাম) বলি, দিদি চলে গিয়েছে। তুইও বিদেশে গেলে আমরা কী নিয়ে থাকব! বেশি টাকা-পয়সা তো আমাদের দরকার নেই।” শ্যামলবাবু বলেন, বিদেশে পাঠানোর জন্য সংস্থাটি সৌম্যের ভিসা তৈরি করেছিল। কিন্তু সৌম্য যেতে না চাওয়ায়, তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এর পর থেকে বাড়িতেই থাকতেন তিনি। ধরা পড়েছিল মানসিক অবসাদও।
শ্যামলবাবুর কথায়, “বাবি বলত, দিদি চলে গিয়েছে। আমিও মরে যাব। কিন্তু মাকে কোথায় রেখে যাব! আমি মরে গেলে মা তো শোকে পাগল হয়ে যাবে। মাকে নিয়েই মরব।” শেষ পর্যন্ত সেটাই হল বলে মনে করছেন শ্যামলবাবু। ছেলে ও স্ত্রী যে এমন করতে পারেন, তা কি আগে আঁচ করেছিলেন শ্যামলবাবু?
রবিবারের ঘটনার পরে শ্যামলবাবুর ধারণা, কয়েক দিন ধরেই আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন সৌম্য। কিন্তু রবিবার পর্যন্ত বিষয়টি আঁচ করতে পারেননি তিনি। শ্যামলবাবু বলেন, “বিকেলে চা খেল। তার পরে আমিই তন্দ্রাকে বললাম, একটু হাঁটাহাটি করে আসতে।” অন্য দিন হাঁটতে গিয়ে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসতেন তন্দ্রাদেবীরা। কিন্তু রবিবার রাত ন’টা বেজে যাওয়ায় ছেলের মোবাইলে ফোন করেন শ্যামলবাবু। ফোন ধরেন এক জন পুলিশকর্মী। নিজের পরিচয় দিয়ে শ্যামলবাবুর কাছে নাম-পরিচয় বিশদে জানতে চান। তার পরে ফোন কেটে দেন। এর কিছু ক্ষণের মধ্যেই ফের ফোন করে দুঃসংবাদ দেওয়া হয়।
প্রাথমিক ভাবে তদন্তকারীরা বলছেন, ঘটনার কয়েক দিন আগে মুন্সির ভেড়ি এলাকায় ‘রেকি’ করে গিয়েছিলেন সৌম্য। তবে দু’জন কী ভাবে নিজেদের বেঁধে জলে ঝাঁপ দিলেন, সে ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত নন তদন্তকারীরা।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞেরা কী বলছেন? মনোরোগের চিকিৎসক জ্যোতির্ময় সমাজদার বলেন, “নাগরিক জীবনে এমন নজির তো সাম্প্রতিক কালের মধ্যে বেশ কয়েকটা দেখা গেল। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, অবসাদ অসুখটা কত গভীরে শিকড় গেড়েছে। এঁরা তো এক দিনে এমন সিদ্ধান্ত নেননি, দিনের পর দিন হতাশায় ভুগতে ভুগতে যখন টের পেয়েছেন সামনে তাকানোর আর কিছু নেই তখনই এই পথ বেছে নেওয়ার কথা ভেবেছেন। এঁদের সঙ্গে যাঁদের যোগাযোগ রয়েছে, তাঁরা কেউ এই হতাশা বা অবসাদের কথা টের পাননি, তা হতে পারে না। হয়তো সকলেই ‘সাময়িক মন খারাপ’ বলে বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছেন। সময়ে চিকিৎসা শুরু হলে এমন পরিণতি হয়তো এড়ানো যেত।”
মনোবিদদের মতে, এঁদের জীবনে হতাশার একাধিক কারণ রয়েছে। হয়তো সেগুলি মিলিত ভাবে এক গভীর অবসাদের জন্ম দিয়েছিল, যা থেকে তাঁদের কাছে বেঁচে থাকাটাই শেষমেশ অর্থহীন হয়ে পড়ে।
|