ঘুঁটিদের কেউ কেউ ধরা পড়েছে। কয়েক জন আবার গা ঢাকা দিয়েছে। তবে তাদেরও মোটামুটি চিহ্নিত করে ফেলা গিয়েছে। কিন্তু আড়ালে থেকে আসল চালটা দিল কে?
শর্ট স্ট্রিট-কাণ্ডের এক সপ্তাহ বাদেও মূল চক্রীর চেহারা এখনও স্পষ্ট হচ্ছে না কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাদের সামনে। বিতর্কিত জমির দখল নিতে অত টাকা কে খরচ করল, সেটা তাঁরা এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না। বুঝে ওঠার জন্য যে দু’জনকে নাগালে পাওয়া জরুরি ছিল, আপাতত তাঁরাও ফেরার। এঁদের এক জন হলেন হাওড়ার বাসিন্দা এক ব্যবসায়ী তথা জমি-সম্পত্তির কারবারি। গত মঙ্গলবার থেকে তিনি বেপাত্তা। মূল চক্রীকে চিহ্নিতকরণে বেসরকারি নিরাপত্তাসংস্থার কর্ণধার অরূপ দেবনাথের জবানবন্দিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলে গোয়েন্দাদের অনুমান। সোনারপুরের বাসিন্দা অরূপবাবুও এই মুহূর্তে ফেরার।
গত সোমবার (১১ নভেম্বর) ভোর রাতে মধ্য কলকাতায় শেক্সপিয়র সরণি থানা-এলাকার ৯এ শর্ট স্ট্রিটে ১৭ কাঠা জমি সমেত একটি বাড়ির দখল নিতে হামলা চালানো হয়। বাড়ির ভিতর থেকে গুলি চলে, তাতে প্রাণ যায় দুই বহিরাগতের, আহত হন একাধিক। এ পর্যন্ত মোট ১৫ জন গ্রেফতার হয়েছেন। ধৃতদের মধ্যে একাধিক পুরুষ-মহিলা বাউন্সার, আইনজীবী, জমি-কারবারি-সহ দখলদার বাহিনীর লোকজন যেমন আছেন, তেমন রয়েছেন ঘটনার সময় ওই বাড়িতে থাকা এক মহিলাও। মমতা অগ্রবাল নামে সেই মহিলার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সঙ্গীদের নিয়েই তিনিই গুলি চালিয়েছিলেন।
এবং খাস মহানগরের কেন্দ্রস্থলে জমি ঘিরে এ হেন প্রাণঘাতী লড়াইয়ের উৎস খুঁজতে নেমে গোয়েন্দাদের হাতে বেশ কিছু অজানা তথ্য এসেছে। মামলা-মোকদ্দমার জালে ঘেরা বিতর্কিত জমিটির বিবিধ দাবিদারের হাল-হদিস জানা গিয়েছে, একাধিক জমি-কারবারির মধ্যে অশুভ আঁতাতের গন্ধ মিলেছে। এমনকী, হানাদারির পিছনে পুলিশের একাংশের যোগসাজশের ছায়াও দেখেছে লালবাজার, যার ভিত্তিতে ইতিমধ্যে ক্লোজ করা হয়েছে শেক্সপিয়র সরণি থানার এক সাব ইন্সপেক্টর’কে। আরও কিছু পুলিশ-কর্তার ভূমিকাও যাচাই করা হচ্ছে।
এমন নানা কুশীলবের সন্ধান মিললেও ভূমিকার নিরিখে চক্রী-পিরামিডের শীর্ষে পৌঁছানো যাচ্ছে না। “হামলাকারীরা কারা, কে তাদের নিয়োগ করেছিল, হামলার ছক কে কষেছিল ইত্যাদি ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে আসছে। কিন্তু এরা সকলেই দাবার ঘুঁটি। আসল খেলুড়ে, মানে জমি খালি করানোর জন্য অত টাকা কে ঢালল, সেটা এখনও ধোঁয়াশা।” রবিবার মন্তব্য করেছেন এক গোয়েন্দা-কর্তা। গোয়েন্দা-সূত্রের দাবি: ৯এ শর্ট স্ট্রিটে ‘অভিযান’ চালানোর জন্য শক্তসমর্থ ছেলে-মেয়ে জোগাড়ের দায়িত্ব বর্তেছিল অরূপবাবুর উপরে। চক্রান্তে তাঁকে যুক্ত করেছিলেন আইনজীবী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। পার্থবাবুকে আবার কাজে লাগিয়েছিলেন জমি-কারবারি পিনাকেশ দত্ত, যিনি আগেও কিছু জমি দখলে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন বলে তদন্তকারীদের দাবি। তাঁকে নিয়োগের পিছনে শুধু জমি-কারবারি পরাগ মজমুদারের হাত ছিল, নাকি অন্য কারও, লালবাজারের সামনে এটা এখন বড় প্রশ্ন।
পার্থ, পরাগ, পিনাকেশ তিন জনই পুলিশের হেফাজতে। শনিবার পিনাকেশের ব্যাঙ্ক লকার থেকে নগদ ৮২ লক্ষ টাকা উদ্ধার করেছেন গোয়েন্দারা। তাঁরা নিশ্চিত, শর্ট স্ট্রিটের জমি দখল-চক্রান্তে সামিল বিভিন্ন পক্ষের ‘পরিষেবা ফি’ মেটাতেই পিনাকেশকে অত টাকার জোগান। এ-ও জানা গিয়েছে, নভেম্বরের গোড়ায় পিনাকেশ লকার খুলেছিলেন। গোয়েন্দাদের সন্দেহ, তখনই পিনাকেশের হাতে টাকা পৌঁছায়।
কে দিয়েছিল?
এক গোয়েন্দা-অফিসার বলেন, “পিনাকেশ জেরায় জানিয়েছেন, শর্ট স্ট্রিটের জমি দখলের উদ্দেশ্যে ওই টাকা তাঁকে দিয়েছিলেন পরাগ মজমুদার। অথচ পরাগ ক্রমাগত তা অস্বীকার করে যাচ্ছেন।”
আর এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে হাওড়ার ওই সম্পত্তি-কারবারি, যাঁকে পরাগ জমি দখলের দায়িত্ব দিয়েছিলেন বলে গোয়েন্দাদের একাংশের অনুমান। “পরাগই সরাসরি পিনাকেশকে টাকা দিয়েছিলেন ধরে নিলেও প্রশ্ন থাকছে, পরাগ অত টাকা পেলেন কার কাছে। আমরা নিশ্চিত, আরও বড় কেউ টাকা ঢেলেছিল। তাঁকে চিহ্নিত করতে হাওড়ার ফেরার ব্যবসায়ীর জবানবন্দি কাজে লাগতে পারে।” অভিমত এক অফিসারের। তাঁদের দাবি, ষড়যন্ত্র সফল করতে মোট দেড় কোটি টাকা ঢালা হয়েছিল। একাধিক ব্যক্তিও ‘বিনিয়োগ’ করে থাকতে পারেন। পিনাকেশের লকারে ৮২ লক্ষের হদিস পাওয়ার পরে দেখা হচ্ছে, বাকিটা কোথায় গেল। তদন্তে আগেই বেরিয়েছে, পার্থকে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছিল। অভিযানের ‘অপারেশনাল কস্ট’ হিসেবে অরূপবাবু পান ৫০ হাজার। অবশিষ্টাংশের সন্ধানে পরাগ-সহ ধৃত কয়েক জন ও হাওড়ার ব্যবসায়ীটির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের বিস্তারিত তথ্য যাচাই করা হচ্ছে।
পাশাপাশি জানার চেষ্টা হচ্ছে, বর্তমানে শর্ট স্ট্রিটের জমিটির আইনি অবস্থান ঠিক কোথায়। এ জন্য জমির আদি মালকিন, প্রয়াতা শৈলবালা সেনের ভাসুরপো দ্বারকানাথ সেন, দ্বারকানাথের দুই কন্যা রুমি ও রাখীর সঙ্গে তদন্তকারীরা কথা বলবেন। শৈলবালার ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ নিয়ে ১৯৯৯-এ জমিটি ‘হার্টলাইন এস্টেট’কে বিক্রি করেছিলেন যিনি, সেই ব্যবসায়ী শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও কথা বলা হবে। গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, হাওড়ার ওই ফেরার ব্যবসায়ীই হার্টলাইন এস্টেট নামে কার্যত ভুয়ো সংস্থাটির কর্ণধার। প্রসঙ্গত, হার্টলাইন এস্টেটের নামে জমিটির রেজিস্ট্রেশন করাতে যিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন, ৯এ শর্ট স্ট্রিটের দীর্ঘ কালের বাসিন্দা সেই রতনলাল নাহাটা পরে দাবি করেন, জমির মালিক তিনিই! রতনলালের যুক্তি ছিল, ২০০৩-এ সালে শৈলবালা জমি উইল করে দিয়ে যান রুমি-রাখীকে, এবং ২০১০-এ তিনি সেটি কিনে নেন। নথিতে হার্টলাইনের নাম সাদা রঙে ঢেকে সেখানে নিজের নাম বসিয়ে প্রবীর ঘোষ নামে এক ব্যক্তির থেকে কোটি টাকা নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে নাহাটার বিরুদ্ধে।
এ রকম ভুয়ো নথি দেখিয়ে ৯এ শর্ট স্ট্রিটের জমির বারবার হাত বদলের অভিযোগ আপাতত খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দা বিভাগের প্রতারণা ও জালিয়াতি দমন শাখা। চক্রান্তের ‘পুলিশি সংস্রব’ নিয়েও গোয়েন্দারা মোটামুটি নিশ্চিত। তাঁদের দাবি: শেক্সপিয়র সরণি থানার একাংশ ও কলকাতা পুলিশের কিছু পদস্থ কর্তাকে জানিয়েই হামলার ছক কষা হয়েছিল। লালবাজারের ইঙ্গিত, শর্ট স্ট্রিটের জমিটি কব্জায় আনতে আগেও থানার কিছু অফিসারের মদত চেয়ে মোটা টাকার টোপ দেওয়া হয়। তখন তাতে কাজ হয়নি। কিন্তু এ বার যে ভাবে পাঁচিল টপকে, দরজা খুলে জমিতে অনুপ্রবেশ ঘটেছে, পুলিশের একাংশের ‘বরাভয়’ ছাড়া তা সম্ভব ছিল না
বলে লালবাজারের কর্তারা মেনে নিচ্ছেন। এ দিকে লালবাজারের শীর্ষ মহলের খবর, সন্দেহভাজন অফিসারদের দু’জন গত শুক্রবার শাসকদলের এক প্রভাবশালী নেতা তথা সাংসদের বাড়িতে গিয়ে তাঁর হস্তক্ষেপ চেয়ে এসেছেন।
তাই উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ পেলেও জড়িত অফিসারদের ক’জনের
বিরুদ্ধে লালবাজার কঠোর হতে পারবে, পুলিশেরই অন্দরে সেই সংশয় ঘুরপাক খাচ্ছে। |