রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২...
গভীর এরিয়েলে
ছোটবেলায় আমাদের মফস্সলের বাড়িতে একটা বিশাল ভেঁপু-ওয়ালা গ্রামোফোন ছিল, আর ছিল তাবড়া তাবড়া রেকর্ড। তার বেশ কয়েকটাই ছিল আমার খুব প্রিয়, বার বার শুনতে চাইতাম, বিশেষ করে নবদ্বীপ হালদারের সেই অদ্ভুত গলায় একটা মজার গান: ‘লাগ লাগ লাগ আগুন লাগিয়ে বসে আছি।’ এরও দশ-বারো বছর পরে হঠাৎ কবিতার কাগজ কবিপত্র-র তখনকার সম্পাদক পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের একটা পোস্টকার্ড আসে— ‘এ যাবৎ প্রকাশিত সব কবিতাগুলো নিয়ে কবিপত্র থেকে একটা বই বের করলে কেমন হয়?’ তখন বয়েস সবে উনিশ। স্কটিশ-এ ইকনমিক্স নিয়ে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। গভীর প্রেম শুরু হয়ে গেছে সিনেমার সঙ্গে, পাশাপাশি মন মজে আছে ইকনমিক্স-এ। আর কবিতা তো লেখা চলছেই দেশ, কৃত্তিবাস, শতভিষা, অলিন্দ, এই সব কাগজে। ঠিকানাটা ছিল কত বাই যেন কত রানি শঙ্করী লেন, হাজরা রোডে দমকলের উলটো দিকের গলি দিয়ে যেতে হবে।
ঢুকেই দেখি, একটা পুরনো বাড়ির বাইরের দাওয়ায় খালি গায়ে, লুঙ্গি পরে উবু হয়ে বসে মনের সুখে বিড়ি খাচ্ছেন মাঝবয়সি এক ভদ্রলোক। ঠিকানা জানতে চাইলেই গড়গড় করে বলে গেলেন, ‘সোজা যাও, তার পর বাঁ-দিকে, তার পর আবার ডান দিকে, তার পর আবার...।’ আমি কয়েক পা এগিয়েই স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ছোটবেলা থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এল সেই ‘লাগ লাগ লাগ আগুন লাগিয়ে বসে আছি’। ফিরে গেলাম ভদ্রলোকের কাছে, চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম কয়েকটা মুহূর্ত...
—নবদ্বীপ হালদার?
—সেঁটা কেঁ? (তার পর মুচকি হেসে মাথা নাড়তে নাড়তে) হেঁ-হেঁ-হেঁ-হেঁ...
এর পর কথাবার্তা সব ঠিক হয়ে গেল, বইয়ের নাম ঠিক হয়ে গেল, প্রচ্ছদ করবেন কে, তা-ও ঠিক হয়ে গেল। পূর্ণেন্দু পত্রী। পূর্ণেন্দু পত্রী তখন থাকতেন লেকটাউনে। আমি চিনতাম আগেভাগেই, ওঁর সেই ‘দাঁড়ের ময়না’ পড়ে মুগ্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই। ফোন করে আগেই বলে রেখেছিলাম। পূর্ণেন্দুদা তখন মহা ব্যস্ত তাঁর প্রথম ছবি ‘স্বপ্ন নিয়ে’-র শুটিং-এর কাজে, আর লেকটাউনের আকাশ ভেঙে সেদিন প্রবল বৃষ্টি। ভেজা চিঁড়ের মতো নেতানো আমার অবস্থা।
বেল টিপতেই পূর্ণেন্দুদা দরজা খুলে বলে উঠলেন ‘এখন হবে না, এখন হবে না...’ তার পর কী মনে হওয়ায় আবার বললেন, ‘আগে জল ঝরে যাক তার পর ভেতরে ঢুকো।’ শুটিং কেমন চলছে জানতে চাওয়ায় বললেন, ভাল, কিন্তু ক্যামেরাম্যান আমার কথা শোনে না। যাই বলি, খালি বলে ‘হয় না, হয় না’... তার পরে একটু থেমে বললেন, ‘বইয়ের নাম কী?’
— গভীর এরিয়েলে।
হেসে বললেন, জীবনানন্দ দাশ থেকে মেরে দিয়েছ! কী যেন লাইনটা?
— প্রাণাকাশে বচনাতীত রাত্রি আসে, তবুও তোমার গভীর এরিয়েলে...
তার পর দু’কাপ চা, দুটো সিগারেট আর দশটা মিনিট। সেই প্রচ্ছদ তৈরি হয়ে গেল, যা এখনও পর্যন্ত আমার প্রকাশিত কবিতার বইগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
বাড়ি ফিরে মা’কে বললাম, কালকেই আমার তিনটে ইকনমিক্স-এর বই কিনতেই হবে, দুশো টাকা লাগবে। মা বললেন— সে কী! আগে বলবি তো। সামনের মাসে কিনিস।
— না না, কালই লাগবে, ভীষণ দরকার।
— বাবা আসুক, বাবাকে বলি...
— বোলো, সঙ্গে এটাও বোলো যে, বইগুলো না হলে আমি কিন্তু অনার্স পাব না। তখন যেন আমাকে...
— বাবা রে বাবা! কালকেই নিস।
পর দিন সকালে টাকা নিয়ে সোজা রানি শঙ্করী লেন। আবার বিড়ি হাতে দাওয়ায় বসা নবদ্বীপ হালদার। সে দিন গায়ে গেঞ্জি। আমাকে দেখে অদ্ভুত ভাবে হাসলেন। পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের হাতে দু’শো টাকা গুঁজে দিলাম, কিন্তু দুশো টাকায় দুশো কপি বই হল না। ওঁর পকেট থেকেও বেশ ক’টা টাকা গেল।
বই উৎসর্গ করলাম পিতামহ এবং মাতামহকে, আর ছোট্ট একটা ভূমিকাও লিখলাম। তার একটুখানি অংশ তুলে দেওয়া যেতে পারে—
...তারিখ দিয়ে কোন কিছু লেখা হয় না হয় নি বলে বিন্যাসে কালানুক্রমিকতা নেই। এ সকল লেখার জন্য কারুকেই কৈফিয়ৎ দেবার নেই কেননা ঈশ্বর কিম্বা শয়তান একমাত্র কৈফিয়ৎ শোনার যোগ্য। জ্বরে শীতে নির্জনে আলোয়ান গায়ে একা কখনো বা অলৌকিক অপরাহ্নে অসম্ভব মুখোশের ভীড়ে কখনো মধ্যরাতে রাজপথে ট্রামস্টপে দাঁড়ানো ভয়ঙ্কর একা আমি এদের অপেক্ষায় ছিলাম অপেক্ষায় আছি এযাবৎ...
তার পর এক দিন সেই বচনাতীত মুহূর্ত এল। আমার সামনেই বাঁধানো হয়ে গেল প্রথম একশো কপি ‘গভীর এরিয়েলে’। ভাবা যায়? আমার বই, আমার প্রথম বই। দু’কাঁধে দু’ঝোলা ভর্তি বই নিয়ে উড়তে শুরু করলাম রাস্তা দিয়ে। কলকাতায় তখন জাঁকিয়ে নামছে সন্ধ্যা। পৌঁছে গেলাম কফিহাউস। চেনা ও চেনা-চেনা যত কবি, আধকবি ও অ-কবি ছিলেন, সবাইকে বিলিয়ে দিলাম একঝোলা বই। তার পর আবার শুরু হল উড়ে চলা।
এই বার ঝুপ করে নামলাম খালাসিটোলায়। তখন খালাসিটোলা আলো করে বসে আছেন কমলকুমার মজুমদার, ইন্দ্রনাথ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, হরিসাধন দাশগুপ্ত... আরও কত কত মানুষ। সবাইকে আবার বই দেওয়া শুরু হল। শেষ পর্যন্ত ব্যাগে আর মাত্র দুটো কপি পড়ে। কে যেন দূর থেকে জড়ানো গলায় চেঁচিয়ে উঠল— ‘দাদা আমাকেও একটা...।’ হাতে রইল হারাধনের একটি মাত্র ছেলে। এক দিনেই নিরানব্বই কপি শেষ। গর্বে বুক ভরে উঠল, আর পর দিন ভোরে ঘুম ভাঙল পাঁচ নম্বর বাসের ভেতর, গড়িয়ার বাস-গুমটিতে। শুরু হয়ে গেল আমার কবি-জীবন।
অনেক অনেক দিন পর, এই তো সে দিন, ‘আনোয়ার কা আজব কিস্সা’র শুটিং করছি। কাজ যখন শেষ হল, তখন মাঝরাত। সবাই প্রায় চলে গেছে, আমি যে কেন তখনও বসে আছি আমি নিজেই জানি না। রাস্তার মধ্যিখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক টলমলে মাতাল। শক্তিদার কথা মনে পড়ে গেল। এ রকমই রাতের কলকাতায় ‘চোখের জলে লাগল জোয়ার’ গাইতে গাইতে হেঁটে চলেছেন শক্তিদা, পাশে-পাশে আমি। বাড়ি ফিরব বলে গাড়িতে উঠে বসেছি, হঠাৎ ডান দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখি রাস্তার ও-পারে হাজরার সেই দমকল স্টেশন। গাড়ি থেকে নেমে ঢুকে গেলাম উল্টো দিকের রাস্তায়। কী আশ্চর্য, এই তো সেই বাড়ি, এখানেই তো আমি চার দিন ধরে শুটিং করছি! ওই তো সেই দাওয়া! লুঙ্গি পরে বিড়ি হাতে উবু হয়ে বসে আমার দিকেই তাকিয়ে খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হাসছেন নবদ্বীপ হালদার। হঠাৎ মনে পড়ল, আরে, ওঁকে তো দেওয়া হয়নি আমার ‘গভীর এরিয়েলে’। মনে পড়ল ছুটকি পিসি ছুটে আসছে রেকর্ড হাতে। আর কারও হাতে রেকর্ড বদলানোর ভার দিত না ছুটকি পিসি। আমি ঘুমোব, সেই শর্তে চালিয়ে দিল নতুন রেকর্ড। বিশাল ভেঁপুর লম্বা অন্ধকার গলা থেকে বেরিয়ে আসছে ‘লাগ লাগ লাগ আগুন লাগিয়ে বসে আছি...’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.