ভূত বনাম ভূতের লেখক
ঙ্কর্ষণবাবু ভূতের গল্প লিখলেও যে খুব ভীতু মানুষ, তা অনেকেই জানেন না। আর জানেন না বলেই ভুলটা করে বসেন। সঙ্কর্ষণবাবুর থাকার জন্য ভুতুড়ে বাড়িই ঠিক করে রাখেন। নিজের দুর্বলতা আর পাঁচ জনকে তো প্রকাশ করার নয়, সে জন্য সঙ্কর্ষণবাবুও চুপ করে থাকেন।
আজও তিনি চুপ করেই ছিলেন। বিনোদবাবু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, খাসা জায়গা মশাই! ভাগ্যে থাকলে একটা-দুটো ভূতের দেখাও পেয়ে যেতে পারেন। আর সব থেকে বড় কথা কী জানেন, সন্ধের পর এ দিকে কেউ ভুল করেও পা মাড়ায় না। আপনাকে কেউ ডিস্টার্ব করার নেই।
বড় একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে তিনি বললেন, ফ্যান্টাস্টিক! আমি তো নিরিবিলিতেই থাকতে পছন্দ করি। ফাইফরমাশ খাটার জন্য হাতের কাছে এক জন থাকলেই হবে। আর বাড়ি পাহারার জন্য এক জন কেয়ারটেকার।
বিনোদবাবু বললেন, দিনেরবেলা মানে এই চারটে-সাড়ে চারটে পর্যন্ত সবই পাবেন, কিন্তু তার পর কাউকেই আর পাবেন না। তবে ভয়ের কিছু নেই। জায়গাটার এতই দুর্নাম যে চোর-ডাকাতরা ভয়ে এ দিকে পা বাড়ায় না।
সঙ্কর্ষণবাবু পড়লেন মহা ফাঁপড়ে। তাঁর ভয়ের কথা বলতে পারছেন না কাউকে, আবার ভয়ে অস্থির না হয়েও থাকতে পারছেন না।
অনেক ভেবে তিনি বুদ্ধি করে বিনোদবাবুকে দিয়ে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ কিনিয়ে আনলেন। বাড়িটা ফাঁকা হলেই তিনি রাতের খাবার খেয়ে ওষুধটা খেয়ে নেবেন। তার পর এত গভীর ঘুমে ঢলে পড়বেন যে, মানুষ তো দূরের কথা হাজারটা ভূতও তাঁকে জাগাতে পারবে না। সন্ধে না হতে হতেই সঙ্কর্ষণবাবু ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিলেন। তার পর বাংলোর সব দরজা-জানলা বন্ধ করে, তাঁর শোওয়ার ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ করে বিছানায় একটা বই নিয়ে বসলেন। অফিসের কাজের চাপ আর অবসরে লেখার চাপ সামলে বইপত্র তেমন পড়া হয় না তাঁর। যদি ঘুম না আসা পর্যন্ত দু’একটা পৃষ্ঠা পড়ে নিতে পারেন, এই আশায়। লেখক তাঁর অতি প্রিয় জগদীশচন্দ্র গুপ্ত। জীবিত কালে পাঠকের সমাদর লাভ না করলেও এখনও তিনি লেখকের লেখক। সাগরময় ঘোষ তাঁর ‘সম্পাদকের বৈঠকে’-তে এই লেখককে নিয়ে সুন্দর স্মৃতিচারণ করেছেন।
গল্প পড়তে পড়তে সঙ্কর্ষণবাবু যখন রচনা সংকলনটি শেষ করলেন, তখন রাত বারোটা। ঘড়ির দিকে তাকিয়েই আঁতকে উঠলেন, অত কড়া ডোজের ওষুধ খাবার সাত ঘণ্টা পরেও যে ঘুম এল না। ঠিক তখনই কেউ যেন উড়ে এসে জুড়ে বসল দক্ষিণের জানলার সামনের চেয়ারে, যে চেয়ারে বসে তিনি লিখবেন ভেবেছিলেন। তার পর ফিসফিসিয়ে বলল, ভেজাল মশাই, ভেজাল! ভেজালে দেশ ছেয়ে গিয়েছে। সাত ঘণ্টা কেন, সতেরো ঘণ্টা পরেও ঘুম আসবে না।
ছবি: সুমিত্র বসাক।
সঙ্কর্ষণবাবু ভয়ে ভয়ে দেখলেন লোকটিকে। মানুষের মতোই লাগছে বটে, কিন্তু বন্ধ ঘরে যে ঢুকতে পারে, সে সাধারণ মানুষ হতে যাবে কেন?
লোকটি তাঁর মনের ভাব বুঝতে পেরে বলল, ঠিকই ধরেছেন। আমি সাধারণ মানুষ নই। আমি ভূত। আর সাধারণ কোনও মানুষ হলে আমি কি এত জোর গলায় সত্যি কথাটা বলতে পারতাম আপনাকে? মানহানির মামলার ভয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকতাম।
ভূতের কথায় ভয়টা একটু গা-সওয়া হয়ে গেল সঙ্কর্ষণবাবুর। তিনি বললেন, বটেই তো! বটেই তো!
ভূতটা রেগে গেল সঙ্কর্ষণবাবুর এই তালে তাল মেলানোয়। বলল, অথচ এই পরিস্থিতিতে আপনার মতো লেখকরা ভূতের গল্প লিখে রাত কাটাচ্ছে। আপনার মতো লেখকদের লেখায় সমাজ নেই, শিক্ষা নেই, আছে কিছু কাল্পনিক ভূত আর তাদের অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড। আমার কী ইচ্ছে করছে জানেন? আপনার মুণ্ডুটা চিবিয়ে খেতে। আপনি লেখক নন সঙ্কর্ষণবাবু, লেখক নামের কলঙ্ক!
ভূতটা যে ভাবে দাঁত কড়মড় করতে করতে কথাগুলো বলছিল, তাতে সঙ্কর্ষণবাবুর মতো ভীতু মানুষের দাঁতকপাটি লাগার কথা, কিন্তু তা হল না। সঙ্কর্ষণবাবু মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন, ‘বলে যা, বলে যা। উৎসাহ দেওয়ার পরিবর্তে সারা জীবন তো খোঁচা দিয়ে গেলি। এ বার ভূত হয়েও খোঁচা দে। আরও কিছু বল না রে, হরিপদ। রূপ বদলেও স্বভাব বদলালি না!’ ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে আমতা আমতা করে বলল, আমি কিন্তু খাঁটি কথা বলেছি। একেবারে ঠিক কথা। রূপ বদলেছি বটে, কিন্তু কথাটা তো সত্যি!
চিল্লে উঠলেন সঙ্কর্ষণবাবু, কীসের ঠিক কথা। সমাজ নিয়ে শিক্ষা নিয়ে হাজার হাজার বই লেখা হয়েছে, তবু আজও সাদা চামড়ার মানুষরা কালো চামড়ার মানুষদের, এক ধর্মের মানুষ আর এক ধর্মের মানুষকে মানুষ বলে মনে করে না। তোর মতো বন্ধুরা মরে গিয়েও বন্ধুর গুণগুলোকে সম্মান দিতে পারে না। বন্ধুর ভূতের ভয় আছে জেনেও ভূত হয়ে আসে।
না, না, তা না। আসলে আমি এ পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম তাই ভাবলাম, বলতে বলতে হরিপদর ভূত যেন পালিয়েই বাঁচল। মনে মনে হাসলেন সঙ্কর্ষণবাবু। ভূতেদেরও ইগো আছে এবং সেই ইগোতে ঘা দিয়ে কথা বললে যে ভূতেরাও পালাবার পথ পায় না, তা তাঁর জানা হয়ে গেল আর ভূতের মুখোমুখি হলে যে ভূতের ভয় বলে আর কিছু থাকে না, এই সত্যটি তিনি জেনে ফেলেছেন বলে তাঁর পরবর্তী ভূতের গল্পগুলো লিখতে কাজে লাগবে।
পরের দিন বিনোদবাবু দেখা করতে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন লাগছে এখানে? সঙ্কর্ষণবাবু একগাল হেসে বললেন, ফ্যান্টাস্টিক! তবে ভূতের সংখ্যা একেবারেই কম। যেখানে একটু বেশি ভয়, বেশি ভূত সে রকম জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করলে ভাল হত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.