এমন এক মন ভারাক্রান্ত দিনে সচিন নিয়ে একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা লেখার শুরুতে বলার লোভ সামলাতে পারছি না। কিছু মাস আগে পশ্চিম বান্দ্রায় সচিনের নতুন বাড়িতে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আড্ডায় ও এমন ভাবে ওই অত্যাধুনিক বাংলোর বর্ণনা দিচ্ছিল, শুনতে শুনতে অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। কোন মার্বেলটা ইতালির কোন গ্রামে দেখে পছন্দ হওয়ায় নিজের বাড়িতে লাগিয়েছে। কোন দেওয়ালে কোন রং সবচেয়ে ভাল দেখায়। বার-এ দেখলাম ১০৮ ধরনের আলোর একটা অটোমেটিক সিস্টেম লাগিয়েছে। সেটা আমাকে দেখাতে গিয়ে কাজ না করায় সচিনের সেকী চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় করে তোলার অবস্থা! তখনই ইলেকট্রিশিয়ান ডেকে সেটা চালু করে আমাকে দেখিয়ে তবেই ওর শান্তি।
আসলে সচিন তেন্ডুলকর মানে শুধু বাইশ গজের কিংবদন্তি নয়। ক্রিকেটের বাইরেও জীবনের রোল মডেল। প্রাক্তন হয়ে যাওয়ার দিন সচিন তা-ই শুধু বর্তমান আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ক্রিকেটারদের সামনে অনেক ব্যাপারে পথপ্রদর্শক হয়ে থাকল না, গোটা সমাজ জীবনের কাছেও শিক্ষণীয় হয়ে থাকছে ওর চব্বিশ বছরের অতুলনীয় কেরিয়ার।
যেমন, যে কোনও ব্যাপারে পারফেকশনিস্ট হওয়ার তুমুল চেষ্টা। কোনও মানুষের পক্ষেই পারফেক্ট হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সচিন শুধু ব্যাটিং নয়, জীবনের সব ক্ষেত্রে পারফেকশনের যতটা সম্ভব কাছাকাছি পৌঁছতে মরিয়া। সেটা বাড়ি তৈরি নিয়ে হতে পারে। গাড়ি নিয়ে হতে পারে। মিউজিক নিয়ে হতে পারে। বিএমডব্লিউ-র সেভেন সিরিজের গাড়ি, যেটার সিট, স্টিয়ারিং, দরজা সবেতে এসআরটি লেখা, সেই গাড়ির চাবি কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর সচিনকে দিতে গেলে ও নাকি ভদ্রলোকের সঙ্গে ঝাড়া এক ঘণ্টা গাড়ির টেকনিক্যাল ব্যাপারস্যাপার নিয়ে গভীর আলোচনা করেছিল! এ দিন যে দীর্ঘ একুশ মিনিটের বিদায়ী বক্তৃতাটা দিল সেটাও কী নিখুঁত। আমি নিশ্চিত, কাগজ দেখে না পড়লেও বক্তৃতার ব্যাপারে ওর আগে থাকতে রীতিমতো হোমওয়ার্ক করা ছিল। পারফেক্ট বক্তৃতা হয় যাতে।
নিজের যেটা কাজ সেটা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে করে চলার ব্যাপারে সচিনের খিদে অফুরন্ত। ওর মধ্যে ক্রিকেট খেলার খিদে একটা বাচ্চার মতোই। বাচ্চাকে পার্কে নিয়ে গেলে সে যেমন যতক্ষণ না ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে ততক্ষণ বাড়ি আসতে চায় না, খেলেই চলে, সচিনও অনেকটা তেমনই। সে জন্যই শুক্রবার ক্রিকেটজীবনের অন্তিম দিনও ও এক মুহূর্তের জন্যও ফিল্ডিং ছেড়ে ড্রেসিংরুম ফেরত যায়নি, ইনিংস জয় নিশ্চিত জেনেও। ওয়েস্ট ইন্ডিজের আট উইকেট পড়ে যাওয়ার পরেও বোলিং করেছে। শুধু রানের খিদেই নয়, সচিনের মধ্যে ক্রিকেটের খিদেই অবিশ্বাস্য রকম বেশি। নিজের পেশার কাজে এ রকম অফুরন্ত খিদে থাকলে তবেই বোধহয় সাফল্যের শিখরে পৌঁছনো যায়। সচিন যেমন পৌঁছেছে।
সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে নিজের কাজকেও সময়োপযোগী করে তোলার শিক্ষাটাও সচিন যেন সবাইকে দিয়ে যাচ্ছে। আমি অমুক সময়ে অমুক ভাবে ব্যাট করে বড় রান পেয়েছি মানে সেই স্টাইলেই ব্যাটিং করে যাব, সচিনের মধ্যে সেটা একদম নেই। আড়াই দশকের কেরিয়ার ওর। গত চব্বিশ বছরে শুধু ক্রিকেট কেন, বিশ্বের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটই কত পাল্টে গিয়েছে! শুধু একই রয়ে গিয়েছে সচিনের রানের চূড়ান্ত ধারাবাহিকতা। তবে তার জন্য ও যখন যেমন দরকার পড়েছে নিজের ব্যাটিং স্টাইল পাল্টেছে। শাফল-ই করেছে একেকটা সিরিজে, একেকটা দেশে একেক রকম। কখনও ডান পা-এ। কখনও সামনের পায়ে। কখনও পুরো স্টাম্প ঢেকে খেলেছে। বিদেশের বাউন্সি পিচে পেসার শর্টপিচড করছে। সেটার জবাবে নতুন স্ট্রোক আমদানি করেছেআপার কাট। ওৎ পেতে থাকা স্লিপ-গালি টপকে যাতে বাউন্ডারি আসে।
প্রতিদ্বন্দ্বী যতই শক্তিশালী হোক, তার সামনে ভয়ডরহীন থাকার মনোভাব সচিন-ই শিখিয়েছে ভারতীয় দলে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে। সহবাগ থেকে কোহলি। যুবরাজ থেকে ধবন। ষোলো বছর বয়সে প্রথম টেস্ট সফরে ওয়াকার ইউনিসের বাউন্সারে নাক থেকে রক্ত ঝরার পড়েও ক্রিজ ছাড়েনি। জবাবে হাফসেঞ্চুরি করেছে।
এবং বরাবর অন্যদের রোল মডেল থেকে গিয়েছে সচিন। তার জন্য মনে হয়, সচিনকে ওর বাবা যে শিক্ষা দিয়েছিলেন সেটাকেই পাথেয় করেছে ও। এ দিন যেটা বিদায়ী বক্তৃতায় বলল। “নিজের স্বপ্নকে তাড়া করার যেমন কোনও শর্টকাট রাস্তা নেই, তেমনই স্বপ্নপূরণের সঙ্গে সঙ্গে সত্যিকারে মানুষ হয়েও ওঠো।” সচিন যত বড় ক্রিকেটার ততটাই বড় মানুষ। রমেশ তেন্ডুলকর যে শিক্ষা তাঁর ছোট ছেলেকে দিয়ে গিয়েছিলেন, সচিন তেন্ডুলকর সেই অমোঘ শিক্ষাই বিদায়বেলায় আমাদের দিয়ে গেল!
|