দুপুর দেড়টা এখন। অন্তিম বারের মতো সাড়ে পাঁচ ফুটের ক্রিকেট-ঈশ্বরের শরীরটা কাঁধে চড়ে আসছে সতীর্থদের, আসছে সচিন তেন্ডুলকর স্ট্যান্ডের দিকে, ঠিক যেখানে গ্যালারির ‘লৌহকবচে’র ফাঁকফোঁকর দিয়ে বেরিয়ে হাজার-হাজার হাত, শ’য়ে-শ’য়ে অটোগ্রাফের খাতা, কণ্ঠনালী চৌচির করে শেষ বারের মতো ‘সচিন...সচিন...’ সমুদ্রগর্জন সৃষ্টির সেই আদিম ইচ্ছে...।
আরে, বিলবোর্ডের সামনে কে একাকী দাঁড়িয়ে? সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় না? চোখের অভিব্যক্তিটা আজ বোঝা যাচ্ছে না। সানগ্লাসে ঢাকা। দু’ফুট দূর দিয়ে হাত নাড়াতে নাড়াতে ক্রিকেট-দেবতা চলে গেলেন, তিনি হাততালি দিলেন শুধু।
পাঁচ বছর আগের নাগপুর মনে পড়ছে? আপনাকেও তো কাঁধে করে সে দিন নিয়ে এসেছিলেন হরভজন সিংহরা?
শুনে ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি। “নাহ্, সে রকম কিছু নয়। তবে আমার চেয়ে সচিনের বিদায়টা অনেক বেশি জাঁকজমকে হল। চোখধাঁধানো বিদায়, না?” অতি প্রিয় ‘ছোটবাবু’র বিদায়-দৃশ্য দেখতে দেখতে যেন আনমনা হয়ে পড়েন দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা অধিনায়ক। একটু থেমে আনন্দবাজারকে বলে ফেলেন, “আসলে চব্বিশটা বছর দেশকে ও টেনেছে। এমন কিছু পড়ে নেই, যা সচিন করেনি। ভারতীয় ক্রিকেটের কাছে এটা তাই প্রচণ্ড আবেগের ব্যাপার। আর আমার অবসর? আমারটা হয়েছিল নাগপুরে। ঘরের মাঠে নয়। সচিনেরটা হল ওয়াংখেড়েতে। ওর ঘরের মাঠে। দু’টোয় তফাত তো থাকবেই।”
|
আর একটু হলে কেঁদেই ফেলতাম। ওয়াংখেড়ে
যে
ওকে এ ভাবে বিদায় দেবে, ভাবতে পারিনি। —লক্ষ্মণ |
|
শুনলে মনে হবে শনিবারের পর থেকে একটা দুঃখ কখনও না কখনও বোধহয় চোরাগোপ্তা আক্রমণ করবে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে। ঘরের মাঠে অবসর নিতে না পারার দুঃখ। এ দিনের ওয়াংখেড়েতে সচিন রমেশ তেন্ডুলকরের মহানায়কোচিত অবসর ঘিরে যা ঘটে গেল, তা বোধহয় ভারতীয় ক্রিকেট তার কোনও ‘সন্তান’-এর জন্যই কখনও বরাদ্দ রাখেনি। স্টেডিয়ামের বাইরে তাসা বাজিয়ে উন্মত্ত নাচ, ভিতরে ‘সচিন বাপ্পা মোরিয়া’ বলে বারংবার হুঙ্কার, জায়ান্ট স্ক্রিনে মরাঠা-সম্রাটের শৈশব থেকে অবসরের দুর্লভ কিছু মুহূর্ত দেখতে দেখতে ক্রিকেটপ্রেমীর প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়া সৌরভ কেন, যে কাউকে নস্ট্যালজিক করে দিয়ে যাবে। যদিও প্রাক্তন ভারত অধিনায়ককে শুধু, “ইডেনে আমার অবসর হলে তো ভালই হত। কিন্তু হয়নি যখন, ভেবে আর কী হবে,” বলতে শোনা গেল। তার বাইরে তিনি কতটা আবেগাচ্ছন্ন আন্দাজ দেননি সৌরভ। কিন্তু ভিভিএস লক্ষ্মণ দিয়ে গেলেন।
সচিন রমেশ তেন্ডুলকরের ক্রিকেট-জীবনের শেষ মাঠ-প্রদক্ষিণ দেখতে দেখতে তো তাঁর চোখে জল এসে গিয়েছিল! “আর একটু হলে কেঁদেই ফেলতাম। ওয়াংখেড়ে যে ওকে এ ভাবে বিদায় দেবে, ভাবতে পারিনি। সচিনের মুখচোখ দেখেছেন? কেমন ঝকঝক করছিল,” কী রকম অদ্ভুত কান্নাভেজা শোনায় লক্ষ্মণের গলা। টিভিতে লাইভ শো সেরে ফেরার সময় বলছিলেন, “একটা জিনিস অবিশ্বাস্য লেগেছে। সব কিছুর শেষে পিচে এসে আবার প্রণাম করল! দিস ইজ সচিন তেন্ডুলকর। এই সচিনকেই আমরা দেখে এসেছি, এই সচিনকেই আমরা চিনি। যদি জিজ্ঞেস করেন, সচিনের ক্রিকেটজীবনের সেরা মুহূর্ত কোনটা? বলব, ফিরে এসে বাইশ গজকে এই প্রণাম করাটা। ওই একটা জিনিসে সচিন বুঝিয়ে দিল যে, ক্রিকেট-পিচের সম্মান ওর কাছে কোথায়। ও ভাবে নিচু হয়ে পিচে হাত ছুঁইয়ে মাথায় ঠেকানো, স্রেফ ভাবা যায় না।” শুধু লক্ষ্মণ নন, ভারত-পাক ভূগোলের সীমানা টপকে ওয়াংখেড়েতে হারিয়ে যেতে দেখা গেল রামিজ রাজাকেও। প্রাক্তন পাকিস্তান অধিনায়ক যখন বলে ফেললেন, “এমন রাজকীয় অবসর যে কোনও ক্রিকেটারের জীবনে ঘটতে পারে, আজ এখানে না থাকলে জানতাম না। কোথাও কখনও এ জিনিস দেখিনি।”
আর সচিন-যুগ পরবর্তী ভারতীয় ক্রিকেট?
ভারতীয় ক্রিকেটের ঐতিহাসিক ‘ফ্যাব ফোর’-এর দুই একটু যেন বিভক্ত। সৌরভ মনে করেন, সচিনের উপস্থিতির মাহাত্ম্য ড্রেসিংরুমে ছিল অবশ্যই। কিন্তু ক্রিকেট চলবে তার নিজস্ব নিয়মে। “ক্রিকেট কখনও থেমে থাকে না। ক্রিকেট এর পরও এগোবে,” বলছিলেন সৌরভ। যিনি এ দিন ভারতীয় ড্রেসিংরুমে ঢুকলেন সচিনকে শুভেচ্ছা জানাতে। কিন্তু ধ্রুপদী হায়দরাবাদির আবার মনে হয়, সচিন ছাড়া ক্রিকেটের বেঁচে থাকা মানে, অসম্পূর্ণ হয়ে বেঁচে থাকা। বলেও গেলেন, “দেখবেন, সচিনের উপস্থিতিকে ইন্ডিয়ান ড্রেসিংরুম এর পর মিস করবে। ক্রিকেটকেও এর পর আর সম্পূর্ণ মনে হবে না।”
আসমুদ্রহিমাচলের ভাবাবেগ, ওয়াংখেড়ের বাইরে দেশ-বিদেশের সচিন-ভক্তদের বিলাপ, সব কিছুর সঙ্গে যেন মিশে যায় ভিভিএসের সংলাপ। সত্যিই তো, শনিবারের পর ভারতবর্ষের ‘সচিন-অব্দ’ শেষ, নতুন ‘অব্দে’র সূচনা। যেটা হয়তো বা কোনও বিরাট কোহলির। কোনও রোহিত শর্মার। বা কোনও চেতেশ্বর পূজারার।
আজ রবিবার থেকে, ভারতীয় ক্রিকেট-ক্যালেন্ডারের সন-তারিখ বোধহয় পাল্টে গেল। মোটেও আর ওটা ১৭ নভেম্বর, ২০১৩ দেখাবে না।
আজ থেকে ওটা১/১/১! |