দু’টো বাড়ির ভৌগলিক অবস্থানে দূরত্ব কতটা হবে? হাঁটাপথে বড়জোর মিনিট দশেক। মুম্বই-মানচিত্রে এত কাছে, তবু আজ কী আশ্চর্য বৈপরীত্য দুইয়ে!
শিবাজী পার্কের একফালি বারান্দাওয়ালা বাড়িটার সামনে গিজগিজে ভিড়, ছত্রিশ রকম টিভি চ্যানেল, সতেরোটা ওবি ভ্যানের গুঁতোগুঁতি, পাঁচিলের উপর দিয়ে উৎসাহীর উকিঝুকি, অশীতিপর পিতা রমাকান্ত আচরেকরকে পাশে বসিয়ে ইন্টারভিউ দিতে দিতে কন্যার চোয়ালে ব্যথা সব রইল।
চৌমাথা পেরিয়ে ইন্দ্রবদন কো-অপারেটভ হাউজিংয়ের এক ফ্ল্যাটের একতলায় বাড়ির সামনে ভিড় দূরস্থান, কাকপক্ষীও নেই। শুধু মাঝেমধ্যে বৃদ্ধার বাসস্থান থেকে গুটি গুটি বেরনো প্রতিবেশীর দল, তাঁর প্রখ্যাত ভাসুরপুত্রের অবসর নিয়ে টুকরো ফিসফাস, জানালার ফাঁক দিয়ে সান্ধ্য হাতা-খুন্তি নাড়ার অতি স্বাভাবিক দৃশ্যের বাইরে আর কিছু রইল না। |
বিদায়ের মুহূর্তে বল্গাহীন আবেগ। ছবি: উৎপল সরকার। |
অথচ দুই বাড়ির দুই বয়ঃজ্যেষ্ঠর প্রবল প্রভাব রয়েছে সচিন রমেশ তেন্ডুলকরের জীবনে। রমাকান্ত আচরেকরের হাত ধরে যদি সচিনের কেরিয়ারের সূর্যোদয় হয়, তা হলে আচরেকরের ‘গুরুকুল’ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন ইন্দ্রবদন কো-অপারেটিভ হাউজিংয়ের ওই বৃদ্ধা। নাম মঙ্গলা তেন্ডুলকর। পরিচয়ে যিনি সচিন তেন্ডুলকরের কাকিমা, বান্দ্রার সাহিত্য সহবাস-পরবর্তী সময়ে যাঁর বাড়িতে সচিনের বেড়ে ওঠা। যিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন ‘মাস্টারে’র ক্রিকেটজীবনের ‘কৈশোর’ থেকে ‘যৌবনে’ পদার্পণ। ঠিক যেমন দেখেছেন সারদাশ্রম স্কুলের হেড কোচ আচরেকর।
শনিবার অসাড় শরীর নিয়েও সাম্প্রতিকে ছাত্র-সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি কথা আচরেকর বললেন।
শনিবার টিভির সামনে ঠায় বসে ওয়াংখেড়ের সচিন-উৎসব দেখেও মঙ্গলা তেন্ডুলকর মিডিয়ার সামনে সামান্য উচ্চবাচ্য করলেন না।
শোনা গেল, মিডিয়ার সঙ্গে নাকি বহু দিন ধরেই কথাবার্তা বলতে চান না সচিনের কাকিমা। প্রতিবেশীদের কেউ কেউ কথাটা বলছিলেন। তাঁর নাকি শান্তি বেশি পছন্দ, সচিনের রোশনাইয়ে গা ভাসানো নয়। তার উপর সচিনের কাকা বর্তমানে হাঁটাচলা করতে পারেন না ঠিক করে। এবং মঙ্গলা তেন্ডুলকর গত তিন দিনে একবারের বেশি ওয়াংখেড়ে যাননি, সেটাও নাকি মাত্র আধঘণ্টার জন্য। আচরেকরের গতিবিধি যার সম্পূর্ণ বিপরীত-ধর্মী। ওয়াংখেড়েতে উপস্থিত ছিলেন দু’দিন। শুধু প্রিয় ছাত্রের অবসর দেখলে প্রচণ্ড কষ্ট হবে ভেবে কন্যা কল্পনা শনিবার আর নিয়ে যাননি। কিন্তু বিকেল-বিকেল সচিনের ভারতরত্ন প্রাপ্তির খবর কানে যাওয়ামাত্র মনে করে ফোন করতে ভোলেননি।
কী বললেন?
“উইশ...” নিরন্তর চেষ্টা শেষে এটুকু বলে আওয়াজ থেমে গেল। পাশে বসা কল্পনা শেষটা করে দিলেন, “বাবা সচিনকে বোঝাল যে, ওর কীর্তিতে বাবাও সমান গর্বিত। কনগ্র্যাচুলেট করল। আজ সচিন ওয়াংখেড়েতে খোঁজ নিয়েছে স্যার আছেন কি না। নেই শুনে বলল, আসবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।” আর চিরবিদায় জানানোর আগে সেঞ্চুরি নয়, ব্যাটে এল চুয়াত্তর। সেটা নিয়ে দ্রোণাচার্য-র কী মনোভাব? “দেখুন সচিন যা করেছে, যথেষ্ট। চুয়াত্তরটা সেঞ্চুরির চেয়ে কম কিছু ছিল না। আর সবাই বলছে, অবসর হয়ে গেল। সচিন এখন প্রাক্তন ক্রিকেটার। আমার তো মনে হয়, রবিবার থেকেও ও দেশের ক্রিকেটে ততটাই বর্তমান থাকবে, যতটা ও আজ পর্যন্ত ছিল,” সোজাসাপ্টা বলে দেন কল্পনা।
রবিবার থেকে আগামীতেও সচিন ভারতীয় ক্রিকেটে সামগ্রিক ভাবে বর্তমান থেকে যাবেন কি না, সময় বলবে। সেই সরলীকরণ এখনই সম্ভব নয়। তবে এটাও নিশ্চিত যে, কারও কারও কাছে তাঁর কিছু স্মৃতি গর্বের মিনার হয়ে থাকবে জীবনের শেষ দিন অবধি।
সেটা কোনও মরাঠির হতে পারে। কোনও গুজরাতিরও হতে পারে।
এত দিন ধরে প্রচার-প্রদীপের তলায় পড়ে থাকা অশোক পটেল যেমন। ঠিক করেছিলেন, আজই ওয়াংখেড়ে আসবেন। পরিবারগত কারণে আসা হয়নি। আমদাবাদ থেকে ফোনে বলছিলেন, “সচিনের রঞ্জিতে দ্বিতীয় ম্যাচটা ছিল সৌরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। তখনই বুঝেছিলাম, ও কতটা দুর্ধর্ষ ব্যাটসম্যান।” বছর তিনেক আগে সচিনের সঙ্গে ডিনারে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল অশোকের। যেখানে তিনি সচিনকে বলে ফেলেন, জীবনে ভাল কিছু করেছি বলেই তোমার সঙ্গে বসতে পারছি। উত্তরে সে দিন নাকি সচিন বলেছিলেন, ইন্ডিয়ার জন্য তুমি ক’টা ম্যাচ খেলেছ সেটা বড় নয়। তুমি একশো শতাংশ চেষ্টা করেছ। তোমার সঙ্গে ডিনারে আসব না কেন?
কে অশোক? ইনিও ক্রিকেটার, অফস্পিন করতেন, সৌরাষ্ট্রের হয়ে রঞ্জিও খেলেছেন চুটিয়ে। তবে তা ছাড়াও তাঁর আরও একটা পরিচয় আছে।
প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ক্রিকেট-ঈশ্বরের সর্বপ্রথম উইকেট কিন্তু এঁরই নেওয়া! |
এই সম্মান সচিনের প্রাপ্য ছিল। অবশেষে এক জন ক্রীড়াবিদ ভারতরত্ন পেল। এর পর খেলার জগতের অন্যরাও দেশের হয়ে বড় কিছু করলে সর্বোচ্চ এই স্বীকৃতি পাওয়ার আশা করতে পারবে।
মিলখা সিংহ |
এই সবে জানতে পারলাম সচিনকে ভারতরত্ন দেওয়া হচ্ছে। আমি ভীষণ খুশি। আমার বিশ্বাস প্রত্যেক ক্রিকেটপ্রেমী আজ আমার মতোই খুশি হয়েছেন।
লতা মঙ্গেশকর |
|
|
ভারতীয় খেলাধুলোর জন্য দারুণ ব্রেকথ্রু। এসআরটি ভারতরত্ন পাচ্ছেএকদম ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত! এই একটা ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দলও দেখছি এই প্রথম একমতছোট্টখাট্ট গ্রেট ছেলেটার এমনই প্রভাব!
বিষেণ সিংহ বেদী |
ভারতের আদর্শ সন্তানকে দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক পুরস্কারে সম্মানিত করার এর থেকে উপযুক্ত সময় আর কিছু হতে পারত না।
অমিতাভ বচ্চন |
|
সচিন শুধু ভারতরত্ন নয়, ও হল বিশ্বরত্ন।
সুনীল গাওস্কর |
|
আমার শুধু মনে হয় এটা আমাদের অসম্ভব সৌভাগ্য যে, ভারতীয় ক্রিকেট টিম আর দেশের সেবা
করার সুযোগ পেয়েছি। এর থেকে বড় গৌরব আর নেই। তোমাদের আমি যত কাছ থেকে চিনি, তাতে জানি
যে
তোমরা সঠিক মানসিকতা
আর আদর্শ মূল্যবোধের সঙ্গে দেশের সেবা করে যাবে। আমি বিশ্বাস করি
আমরা
সত্যিই সেই সব ভাগ্যবান, স্বয়ং বিধাতা যাদের এই খেলাটার সেবা করার জন্য বেছে নিয়েছেন। ধোনির টিমকে সচিনের শেষ বার্তা |
|