বাইশ গজ থেকে মহানিষ্ক্রমণের আগে
মহানায়কের ক্রিকেট-অঞ্জলি
পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য
বাবা-মা: অবসরের মুহূর্তে সবচেয়ে মিস করছি আমার স্বর্গীয় বাবাকে। আমার সাত বছর বয়সে উনি আমাকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, স্বপ্নকে তাড়া করো কিন্তু তার জন্য শর্টকাট রাস্তা নিলে চলবে না। স্বপ্নপূরণের জন্য প্রচুর কষ্ট আর ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। আরও বলেছিলেন, মানুষ হিসাবেও সত্যিকারের বড় হওয়ার চেষ্টা করতে।
আমি জানি না আমার মতো দুষ্টুকে মা কী ভাবে সামলেছেন। আমাকে বাগে আনা সহজ ছিল না। মা আমাকে সুস্থ-সবল রাখার দিকে আজীবন লক্ষ রেখে গিয়েছেন। আর সারা জীবন আমার জন্য প্রার্থনা করেছেন। সেটা আমার ক্রিকেটজীবন শুরু হওয়ার আগে থেকেই। মনে হয়, মা-র ওই অত অত প্রার্থনাই আমাকে সফল হওয়ার শক্তি দিয়েছে।

কাকা-কাকিমা: বাড়ি থেকে স্কুল অনেক দূরে হওয়ায় চার বছর আমার কাকা-কাকিমার কাছে থেকেছি। সেখান থেকে স্কুলটা কাছে ছিল। ওঁরা আমাকে নিজের ছেলের মতো দেখতেন। আজও তা-ই দেখেন। আমি যাতে ভোরবেলায় উঠে ঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছে ভাল খেলতে পারি সে জন্য কাকিমা আমাকে রাত তিনটের সময় খাবার বানিয়ে নিজের হাতে খাইয়ে দিতেন।

দাদা-দিদি: আমার বড়দা নীতিন খুব কম কথার মানুষ। আমাকে শুধু বলত, “তুই যে কাজই কর, আমি জানি সেই কাজে একশো ভাগ দিবি।” আমার দিদি সবিতার থেকেই আমি জীবনের প্রথম ব্যাট উপহার পেয়েছিলাম। একটা কাশ্মীরি ব্যাট। দিদি এখনও আমার ব্যাটিংয়ের সময় উপোস করে থাকত।

অঞ্জলি: আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ঘটনা নব্বই সালে অঞ্জলিকে প্রথম দেখা। আমি জানতাম, এক জন ডাক্তার হিসাবে ওর সামনে বিরাট ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। কিন্তু আমাদের বিয়ের পর যখন আমরা সন্তানের জন্ম দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ও বলেছিল, আমি যেন পুরোদমে ক্রিকেট চালিয়ে যাই। বাচ্চার যাবতীয় দেখভালের দায়িত্ব ও-ই নেবে। আমার সমস্ত বোকামিকে এত বছর ধরে সহ্য করে চলার জন্য অঞ্জলিকে ধন্যবাদ। আমার জীবনের সেরা পার্টনারশিপটা ওর সঙ্গেই। অঞ্জলিকে আমায় বিয়ে করতে দেওয়ার জন্য আমার শ্বশুর-শাশুড়িকে ধন্যবাদ।

অর্জুন-সারা: ওরা আমার জীবনের দুটো সবচেয়ে দামি হিরে। আমার মেয়ে সারা এখন ষোলো। ছেলে অর্জুন চোদ্দো। ক্রিকেটের জন্য আমি ওদের কত-কত জন্মদিন মিস করেছি। ওদের স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠান, স্পোর্টস ডে, ছুটির দিনগুলোতে পাশে থাকতে পারিনি। আমাকে বোঝার জন্য সারা-অর্জুন, তোমাদের ধন্যবাদ জানাই। তোমরা জানো না, আমার জীবনে কী প্রচণ্ড স্পেশ্যাল তোমরা দু’জন। ষোলো বছর আমি তোমাদের সময় দিতে পারিনি, কিন্তু আজ প্রতিজ্ঞা করছি, পরের ষোলো বছর আর তার পরেও আমি তোমাদের সঙ্গে কাটাব।

ক্রিকেটসমাজের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য
অজিত তেন্ডুলকর: ওকে নিয়ে ঠিক কী বলব আমি জানি না! আমার এগারো বছর বয়স থেকে আমাদের দু’জনের ক্রিকেট-জার্নি শুরু। আমার স্বপ্নকে তাড়া করাটা আসলে আমাদের দু’জনের স্বপ্ন তাড়া করা। আমার ক্রিকেটার হয়ে ওঠার পিছনে সেরা ঘটনা, যে দিন আমার দাদা অজিত আমাকে আচরেকর স্যারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। প্রতিটা ম্যাচে আমার আউট হওয়া নিয়ে আমি আর অজিত আলোচনা করেছি। এমনকী গতকাল রাতেও এই টেস্টে আমার আউটটা নিয়ে ফোনে আমাদের দু’জনের আলোচনা হয়েছে। যদিও জানতাম, ওটার পর আমার সামনে আর কোনও ইনিংস পড়ে নেই। আমার ব্যাটিং টেকনিক নিয়ে অজিতের সঙ্গে প্রচুর মতবিরোধ হয়েছে। তবে এত বছর ধরে ক্রিকেট নিয়ে ওর সঙ্গে যদি আলোচনা না করতাম, তা হলে আমি হয়তো খারাপ ব্যাটসম্যানই হতাম।

রমাকান্ত আচরেকর: আমার কোচ আচরেকর স্যারের সংস্পর্শে এসে আমার জীবন পাল্টে গিয়েছিল। স্যার আমাকে ওঁর স্কুটারের পিছনে চাপিয়ে মুম্বইয়ের মাঠে মাঠে ঘুরে ব্যাট করার সুযোগ করে দিতেন। কখনও সকালে শিবাজি পার্কে একটা ইনিংস খেলে আবার দুপুরে আজাদ ময়দানে গিয়ে আরেকটা ইনিংস খেলেছি। যাতে আমি যথাসম্ভব বেশি ব্যাটিং প্র্যাকটিস পাই। মজা হল, স্যার গত উনত্রিশ বছরে আমাকে কোনও দিনও বলেননি, ‘ওয়েল প্লেড’। যাতে আমি আত্মতুষ্ট হয়ে না পড়ি। আজ মনে হচ্ছে, স্যার আমাকে বলতেই পারেন ‘ভাল খেলেছ’। আর তো আমার সামনে কোনও ম্যাচ নেই!

এমসিএ এবং বিসিসিআই: এই মাঠেই আমার ক্রিকেটজীবন শুরু হয়েছিল। এমসিএ-র সঙ্গে আমার আজীবন গভীর সম্পর্ক। মনে আছে, ভারতীয় দলের সঙ্গে নিউজিল্যান্ড সফর থেকে ভোর চারটেয় মুম্বই ফিরে সকাল আটটায় রঞ্জি খেলতে এই মাঠে এসেছি। তার জন্য কেউ যে আমাকে জোর করেছে বা মুম্বই ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন চাপ দিয়েছে এমন নয়।
বিসিসিআই আমার ক্রিকেটার সত্তার উপর সেই ষোলো বছর বয়স থেকে বিশ্বাস রেখে গিয়েছে। চব্বিশ বছর ধরে আমাকে ভারতীয় দলের যোগ্য মনে করার জন্য বোর্ডের নির্বাচকদের ধন্যবাদ। আপনারা আগাগোড়া আমার পাশে থেকে আরও বুঝিয়েছেন যে, আমার উপর আপনাদের আস্থা আছে।

চিকিৎসক আর সাপোর্ট স্টাফ: আপনাদের ধন্যবাদ না জানালে আমি কর্তব্যচ্যূত হব। আমার এ রকম একটা শরীরকে এত বছর ধরে সুস্থ আর খেলার পক্ষে উপযোগী করে রাখার জন্য আপনাদের অশেষ ধন্যবাদ। এমন অনেক বার হয়েছে যে, আমি চেন্নাই বা দিল্লিতে খেলতে গিয়ে মুম্বইয়ের ডাক্তার ডেকে পাঠিয়েছি। আর ওঁরা পরের ফ্লাইট ধরেই আমার কাছে পৌঁছে গিয়েছেন।

প্রাক্তন ও বর্তমান টিমমেট: এই ম্যাচটা শুরুর আগে ধোনি যখন আমাকে দুশোতম টেস্ট ক্যাপ উপহার দিল, টিমের জন্য আমার দিক থেকে একটা মেসেজ ছিল বলেছিলাম, দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাওয়ার জন্য আমরা প্রত্যেকে ভীষণ গর্বিত। আশা করি আমরা এ ভাবেই মর্যাদার সঙ্গে দেশের সেবা করে যাব। তোমাদের প্রতি আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে, ভবিষ্যতে তোমরা সঠিক মূল্যবোধ দিয়ে দেশের সেবা করবে। আমার সঙ্গে যে সব সিনিয়র ক্রিকেটার খেলেছে তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। মাঠের জায়ান্ট স্ক্রিনে রাহুল, ভিভিএস, সৌরভকে দেখছি... সবাইকে ধন্যবাদ।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.