একটু আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে ২২ গজে ২৪ বছরের রাজত্ব। আবেগঘন বিদায়পর্বও শেষ। মাঠ থেকে ফেরা ইস্তক একের পর এক ফোন আসছে মোবাইলে। চেনা নম্বরগুলো ধরছেন, কথাও বলছেন। তার মধ্যেই একটা অজানা ল্যান্ডলাইন নম্বর থেকে ফোন! না ধরে কেটে দিলেন তিনি। ফের এল। এ বার কিছুটা বিরক্ত হয়েই কেটে দিলেন। ফের..।
এ বার ফোন এল ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সহ-সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় সংসদ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী রাজীব শুক্লর কাছ থেকে। তাঁর কাছে যা শুনলেন, তাতে চক্ষু চড়কগাছ! ওই ফোনটা আসছিল খোদ প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে! রাজীব জানালেন, আবারও ফোন আসবে। এ বার যেন ধরেন।
ফোনের ও পারে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ! জানালেন, ভারতরত্ন সম্মান দেওয়া হচ্ছে তাঁকে! সচিন রমেশ তেন্ডুলকরকে!
ভাবা যায়! নাকি এ-ও এক রূপকথা! অবসরের দিনেই ভারতরত্ন। দেশের প্রথম ক্রীড়াবিদ হিসেবে তো বটেই, কনিষ্ঠতম হিসেবেও। রাজীব গাঁধীকে ছাপিয়ে। এ দিন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বার্তা পাওয়ার পর ভারতরত্ন সম্মান মা-কে উৎসর্গ করেন সচিন।
এর আগে কেন্দ্রের মনমোহন সরকারই সচিনকে পদ্মবিভূষণ উপাধিতে সম্মানিত করেছিল। ২০০৮ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সে বছর এই পুরস্কার পেয়েছিলেন সচিন। কিন্তু আজ যে ক্ষিপ্রতা দেখালেন কংগ্রেস নেতৃত্ব, তার নজির নিতান্তই বিরল। আর তাই সচিনের ভারতরত্ন সম্মান পাওয়ার গর্ব এবং তা ঘিরে দেশ জুড়ে আবেগের সঙ্গে বেমালুম মিশে গেল কৌতূহলও! তা হলে কি এই সিদ্ধান্তের পিছনে কাজ করেছে রাজনীতিও?
সেই রাজনীতির গন্ধ শুঁকতে হলে অবশ্য একটু পিছনে তাকাতে হবে। দেখা যাবে, গত বছর ২৬ এপ্রিলের দুপুরে কালো কাচ লাগানো একটি গাড়িতে স্ত্রী অঞ্জলিকে নিয়ে দশ জনপথে ঢুকছেন সচিন। সঙ্গে রাজীব শুক্ল। তার ক’দিনের মধ্যেই রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য হিসেবে শপথ নিলেন সচিন। আর তার পর সচিনের শততম সেঞ্চুরির দিনে সংসদের মধ্যে কংগ্রেসের সাংসদরা প্রায় সমস্বরে দাবি তুললেন, সচিন তেন্ডুলকরকে ভারতরত্ন সম্মান দিতে হবে। এ ব্যাপারে দেরি করলে চলবে না। সচিনকে নিয়ে কংগ্রেসের আর একটি ইচ্ছেও হালফিলে গোপন থাকেনি। তা হল, লোকসভা ভোটে তাঁকে কংগ্রেসের হয়ে প্রচারে নামানো। তাঁকে কেন্দ্র করে কংগ্রেসের এই তৎপরতার সঙ্গে মিশে গিয়েছে গতকাল ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের ছবিটাও। বাইশ গজে যখন ব্যাট চালাচ্ছেন মাস্টার ব্লাস্টার, তখন স্টেডিয়ামে বসে রাহুল গাঁধী।
কী ভাবে এই সিদ্ধান্ত নিলেন কংগ্রেস নেতৃত্ব? রাজীব শুক্ল আজ বলেন, “কংগ্রেসের মধ্যে থেকে সেই দাবির পরেই ভাবনাচিন্তা শুরু হয়। এ ব্যাপারে সচিনের হয়ে সওয়াল করেন রাহুল গাঁধীও। দেশবাসীও সরকারের তরফে এই পদক্ষেপ প্রত্যাশা করেছিলেন।” সূত্রের খবর, গত সপ্তাহে শুক্রবার কংগ্রেসের কোর গ্রুপের বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা করেন মনমোহন ও সনিয়া গাঁধী। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও কথা হয় সনিয়ার। এবং তখনই সিদ্ধান্ত হয় যে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সচিনের অবসর গ্রহণের দিনেই এই ঘোষণা করা হবে। সেই চিত্রনাট্য মেনেই আজ বিকেল পৌনে চারটে নাগাদ সচিনের ভারতরত্ন নিয়ে বিবৃতি জারি করে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়।
সচিন যে ভারতরত্ন পাওয়ার যোগ্য, তা নিয়ে সংশয় নেই রাজনৈতিক নেতাদের অধিকাংশের মনে। কিন্তু রাজনীতিতে সময়টাই তাৎপর্যপূর্ণ। সচিনকে ভারতরত্ন দিতে যে তাড়া কংগ্রেস দেখালো, তা থেকে স্পষ্ট, ক্রিকেট দুনিয়ার এই কিংবদন্তীর জনপ্রিয়তা ও তাঁকে ঘিরে মানুষের আবেগের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করতে চাইছে কংগ্রেস। তা ছাড়া সচিন হলেন যুব সমাজের ‘আইকন’। তাঁকে পাশে নিয়ে রাহুল যুব সম্প্রদায়ের কাছে বার্তাও দিতে চাইছেন।
তা বলে কি বিজেপি এই রাজনীতি বুঝতে পারছে না? অনেকেই বলছেন, দিব্যি বুঝতে পারছে বিজেপি। কিন্তু সচিনকে ভারতরত্ন দেওয়ার ব্যাপারে বিজেপি তো আপত্তি তুলতে পারে না। তাই নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে বিজেপির অন্য সব নেতাই আজ সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে বিজেপি যে বিষয়টি ভবিষ্যতে ছেড়ে দেবে না, তা-ও বুঝিয়ে দিয়েছেন দলের মুখপাত্র প্রকাশ জাভরেকর। তাঁর কথায়, “প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীকে ভারতরত্ন দেওয়ার ব্যাপারে গত দশ বছর ধরে দাবি জানাচ্ছে বিজেপি। এ বার সেই দাবি মানতে হবে সরকারকে।” আবার আরএসএস নেতারা আজ তলে তলে এই প্রচারেও নেমে পড়েছেন যে, হকির জাদুকর ধ্যানচাঁদ-কেও ভারতরত্ন সম্মান দিতে হবে। শুধু তাই নয়, আর কাকে ভারতরত্ন সম্মান দিতে সরকার ঢিলেমি করছে, তাঁদের তালিকা তৈরিতেও নেমে পড়েছেন বিরোধী নেতারা।
এ দিনই সচিনের সঙ্গেই ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে বিজ্ঞানী ও রসায়ন শাস্ত্রের বিশিষ্ট অধ্যাপক চিন্তামণি নাগেসা রামচন্দ্র রাও-কেও। সচিনকে ভারতরত্ন সম্মান দেওয়ার নেপথ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের অভিযোগ খারিজ করছেন কংগ্রেস নেতারা। কংগ্রেস মুখপাত্র পি সি চাকোর কথায়, “সে রকম হলে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী অধ্যাপক সি এন রাও-কে একই সঙ্গে সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান দেওয়া হত না।” যদিও সে ব্যাপারেও বিরোধীদের বক্তব্য রয়েছে। তাঁদের মতে, সি এন আর রাও-কে ভারতরত্ন সম্মান দিয়ে কংগ্রেস আসলে ভারসাম্য বজায় রাখল। দেখাতে চাইল, তাদের এই সিদ্ধান্তের পিছনে রাজনীতি নেই।
তবে প্রশ্ন, সচিনকে ভারতরত্ন সম্মান দিয়ে কতটা ফায়দা পেতে পারে কংগ্রেস? জবাবে বিজেপি-র এক নেতা বলেন, আসলে কংগ্রেসের বিশ্বাসযোগ্যতা এখন এতোটাই তলানিতে ঠেকেছে যে খড়কুটো যা পারছে, তা-ই ধরে ভাসার চেষ্টা করছেন রাহুল গাঁধী! প্রথম ইউপিএ জমানা হলে হয়তো এমন করত না কংগ্রেস। কিন্তু এখন ভাঁড়ার যে শূন্য!” তাঁর কথায়, “ভুললে চলবে না, রাহুল কাল যখন ওয়াংখেড়েতে এসে বসেন, তখন তাঁকে কটাক্ষ করে স্টেডিয়ামে ‘মোদী-মোদী’ স্লোগান ওঠে।”
রাজনীতির এই বিশ্লেষণকে একটু পাশে সরিয়ে রাখলে একটা বিষয় আজ স্পষ্ট হয়ে গেল। ক্রিকেট ইতিহাসে সচিন নিজে শুধু রূপকথা হয়ে রইলেন না, তাঁর ভারতরত্ন উপাধি পাওয়াটাও রূপকথা হয়েই রয়ে গেল! |