কথা ফেসবুকে। দেখা স্কাইপে। আমরা দ্রুত সাইবার-মানুষ। আক্ষেপ নিষ্ফল। নিন্দা অর্থহীন।
এই নতুন দুনিয়াটাকে বুঝে নিতে পারলে যুঝে নিতে পারব। লিখছেন
রুমি গঙ্গোপাধ্যায় |
ছেলেটি একটি সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে মেয়েটিকে খুঁজে বের করে। লিখে রাখে মিষ্টি একটি চিঠিও। প্রোফাইল খুলে রাখলেও মেয়েটি কিন্তু সাইটটি বিশেষ ব্যবহার করত না। অতএব চিঠি পড়েই থাকে। কয়েক মাস পর যখন মেয়েটি সেটি উদ্ধার করে, তত দিনে ছেলেটির ফেসবুক স্টেটাস ‘সিঙ্গল’ থেকে হয়ে গেছে ‘ইন আ রিলেশনশিপ’!
এ গল্প শুনে আমরা আজ আর অবাক হব না। এ-রকমই তো হওয়ার কথা। যোগাযোগ বলতে এখন তো সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো। আড্ডা, জমাটি প্রেম বা দরকারি কথা, সবের জন্যই ডব্লুডব্লুডব্লু...। সেখানে খামতি থাকলে হিসেব বদলে যাবে। সিঙ্গল হয়ে যাবে ইন আ রিলেশনশিপ।
দুরুদুরু বুকে ঘন ঘন ঘড়ির দিকে চোখ— প্রেমের সেই বিকেলগুলো এখন অতীত। তার জন্য অবশ্য এ প্রজন্মের সময় আর প্রয়োজন দুটোই নেই। অপেক্ষার দিনও ফুরিয়েছে। অফিসে কাজের ফাঁকে, রাতে বিছানায়, সকালে ঘুম ভাঙার আগেই পিং। মুখোমুখি কস্মিন কালেও দেখা নেই, চার চোখের মিলন বলতে স্কাইপ ভরসা, সেখান থেকে প্রেম, অনেক সময়েই বিয়ে পর্যন্ত।
শুধু কি তা-ই? এই শহরের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে ছাত্ররা খুঁজেই পায় না। কিন্তু ফেসবুকে তাঁর নামের পাশে দিনের বেশির ভাগ সময় জ্বলে সবুজ বাতি। প্রশ্ন থাকলে অগত্যা ফেসবুক। চটপট জবাব মেলে। মানুষে মানুষে যোগাযোগের সংজ্ঞাটাই দ্রুত পালটে যাচ্ছে। একই বাড়িতে দুটো ঘরে বসে দু’জন পরস্পর কথা বলে, ফেসবুকে।
পৃথিবীটা সত্যিই ছোট হতে হতে স্যাটেলাইট আর কেবলের খপ্পরে গিয়ে পড়ছে। যেমনটা পড়েছিলেন বসিরহাটের গ্রামের সাদামাটা এক স্কুলটিচার। ‘কম্প্যুটার’ ছিল যাঁর কাছে টাইপ মেশিন আর টিভির সমাহার মাত্র। ক্রমে ওই ছোট্ট বাক্সটাই তাঁর বউয়ের সতিনের ভূমিকা নিয়ে নেয়।
দূরত্ব বাড়ে দাম্পত্যে। বউয়ের সঙ্গে লুডো খেলা বা স্কুলের ক্লাসরুম পেরিয়ে সে তখন অনেক দূরে। |
গৌরব পাণ্ডের সাম্প্রতিক ছবি হনুমান ডট কম-এ ভাবেই উঠে এসেছে ‘অঞ্জনিপুত্র’র গল্প। ছবিতে সেই ভূমিকায় প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। বাস্তবে তাঁর জীবনে কতখানি থাবা বসিয়েছে প্রযুক্তি? “মোবাইল সঙ্গে না থাকলে মনে হয় দিনটাই খারাপ যাবে। পুরোটাই অভ্যাস। আমার ন’বছরের ছেলে আইপ্যাড সঙ্গে না থাকলে ডিপ্রেশন-এ চলে যায়। সকালে ঘুম থেকে উঠেই কম্পিউটারে। ওটাই ওদের জগৎ।”
পৃথিবীর দুই প্রান্তে দুটি মানুষ প্রেমে পড়ছেন। সেই প্রেম বিয়ে অবধিও গড়াচ্ছে। একা মানুষ সঙ্গী খুঁজে পাচ্ছেন। এ যদি হয় মুদ্রার একটা দিক, তবে অন্য দিকটা একেবারেই উল্টো। দুই বছর প্রেম করার পরও অনেকে ‘কনফিউজড’। শরীরী আর চোখের ভাষার অনুপস্থিতিই এ সবের পিছনে— এমনটাই অনেক সমাজতাত্ত্বিকের অভিমত। আবার ফেসবুকে অন্যের নাম আর ছবি ব্যবহার করে অ্যাকাউন্ট খুলে অনন্তকাল ধরে প্রেম করে চলেছে কেউ। যার নামে অ্যাকাউন্ট, সে ঘুণাক্ষরেও জানে না! অতএব প্রযুক্তি থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকলেও নিস্তার নেই। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক শমিত করের কথায়, ‘‘ব্যাপারটা অনেকটা দশচক্রে ভগবান ভূতের মতো। জীবনটাই এখন টেক্সচুয়াল। সম্পর্কগুলি মানবিকতা-রহিত। রক্তমাংসের অস্তিত্ব নেই।” ভাল-মন্দ’র বিচার করতে বসলে হিসেব গুলিয়ে যাবে। সব কিছু বদলে যাচ্ছে, এটুকুই নিশ্চিত করে বলা যায়।
শৈশবের সংজ্ঞাও কি বদলে যাচ্ছে না? প্রসেনজিৎ গল্প করছিলেন, ‘‘আমাদের ছোটবেলায় কেউ কিছু বললে চট করে বিশ্বাস করতাম। চাঁদের বুড়ি চরকা কাটে বললে সেটা দেখার চেষ্টা করতাম। আজকের কোনও বাচ্চাকে বলুন, গুগ্ল খুলে দেখিয়ে দেবে চাঁদে কী কী আছে। বলতে পারেন, আজকের বাচ্চারা অনেক বেশি বুদ্ধি রাখে। আবার এ-ও মনে হবে, ইনোসেন্স হারিয়ে যাচ্ছে।” আপনি কী সিদ্ধান্তে পৌঁছবেন, তা নির্ভর করে আপনি কী ভাবে দেখছেন তার ওপর। বয়স্করা গেল গেল রব তুললেও আজকের প্রজন্ম কিন্তু এতেই কমফর্টেব্ল। আসলে সিস্টেমটাকে নিয়েই ওরা বড় হচ্ছে। ওয়েল্যান্ড গোল্ডস্মিথ স্কুলের ক্লাস টেনের ঈশান চক্রবর্তী যেমন ভাবতেই পারে না, ইন্টারনেট বাদ দিয়ে পড়াশুনো হতে পারে!
তবে প্রযুক্তিকে জীবনে কত দূর এন্ট্রি দিচ্ছি, সেটা কিন্তু নিজেকে ঠিক করে নিতে হবে। প্রসেনজিৎ একটা উদাহরণ দিলেন, “অর্পিতা দরকারি কথা বলছে, তখনই জরুরি মেল এল। মেলটা চেক করতে শুরু করলাম। অর্পিতার অনুযোগ, আমি কথাটায় গুরুত্ব দিচ্ছি না। আসলে অজান্তেই আমরা এই সবের কবলে পড়ি। কিছুটা প্রয়োজনেও।” সাইবার প্রযুক্তিকে বাদ দিয়ে ভাবা এখন অসম্ভব। তাই বলে কি তাকে সর্বগ্রাসী হতে দেব? মানুষে মানুষে দূরত্ব বেড়েই চলবে? ব্যালেন্স করে চলাকেই সমাধান হিসেবে মনে করেন প্রসেনজিৎ। “সারা দিন কাজের পর আমরা টিভি দেখি। ওখানেই খাই। এটা না করে যদি স্কাইপ-এ ব্যস্ত হয়ে পড়তাম, স্পেস বেড়েই চলত। তাই এই জায়গাটুকু রাখার চেষ্টা করি। এটা যে কোনও সম্পর্কের ক্ষেত্রে জরুরি।” এখানেই অঞ্জনিপুত্র আলাদা। প্রযুক্তি জীবনে থাবা বসালেও তিনি আবার শিকড়ে ফিরে আসেন। সাদামাটা জীবনে ভিড়ে যেতে তাঁর অসুবিধে হয় না। |