প্রবন্ধ ১...
দুই ভাই
রা জঙ্গলের ভিতরে হঠাৎ স্টার্ট বন্ধ করলেন থিয়ো। নাকটা টানলেন। ঠোঁটে আঙুল। ধীরে ধীরে গড়িয়ে চলল খোলা ল্যান্ডরোভার। ম্যালকম সামনে থেকে চটজলদি আমাদের মাঝখানে। বুঝলাম, সামনে ভয়ঙ্কর কিছু রয়েছে। কিন্তু কী? কিছুতেই বলবেন না ওঁরা। ইশারায় সামনে তাকিয়ে থাকতে বললেন। অক্টোবরের শেষ। ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, জঙ্গলের হাওয়া। জ্যাকেটের চেনটা কখন খুলে ফেলেছি জানি না।
ভোর সাড়ে পাঁচটায় গাড়িতে চেপেছি। একঘণ্টা রাস্তায় এবং পাশের ঝোপঝাড়ে নানা জাতের অ্যান্টিলোপ, জেব্রা, জিরাফ দেখতে দেখতে জঙ্গলের পথে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ম্যালকম আর থিয়ো ধারাবিবরণী দিচ্ছিলেন। কোন প্রাণী একসঙ্গে থাকতে ভালবাসে, কে একলা থাকে, এই সব বলতে বলতে অয়্যারলেসে বিট অফিস থেকে জেনে নিচ্ছিলেন, কোথায় কী প্রাণী আছে। হঠাৎ এই উত্তেজনা।
কিছুটা এগোতেই দেখি, সামনে, কিছু দূরে রাস্তা জুড়ে বসে আছে দু’জন। এ সুযোগ ছাড়া যাবে না। গাড়ি দেখে রাস্তা থেকে উঠে জঙ্গলে ঢুকে গেলেই হয়ে গেল। টেলিলেন্স দিয়ে ফটাফট ছবি তোলা শুরু হল। কিন্তু থিয়ো জানিয়ে দিলেন, এমন করলে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যাবেন। “কথাবার্তা, নড়াচড়া চলবে না। ছবি তোলার সুযোগ পাবে সবাই।”
এশিয়ায় চিতা প্রায় বিলুপ্ত। আফ্রিকার জঙ্গলেও তাদের সংখ্যা কমছে দ্রুত। দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যটন বিভাগের কাছে অনুরোধ ছিল, এমন কোথাও যেন যেতে পারি যেখানে চিতার দেখা মিলবেই। সেই অনুসারে ডারবানের প্রায় চারশো কিলোমিটার দূরে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। পৌঁছেই জানতে চেয়েছিলাম, কী কী দেখা যাবে আপনাদের এখানে? বনাঞ্চলের ম্যানেজার বিল অলিভার জানিয়েছিলেন, “আফ্রিকার বিগ ফাইভ। সিংহ, হাতি, গন্ডার, বাইসন আর জিরাফ একেবারে সামনে থেকে দেখা যাবে। নানা ধরনের অ্যান্টিলোপ অজস্র।”
কিন্তু চিতা? মূলত যার টানে কলকাতার পুজো ফেলে এত দূর এসেছি? চিতা আছে বলেই তো আপনাদের এখানে আনা হল আমাদের? অলিভার বলেন, “চিতা দেখার জন্য আপনাদের ভাগ্য ভরসা। এখানে অক্টোবরের শুরুতেই বর্ষা ঢোকার কথা। এ বার তা হয়নি। প্রচণ্ড গরমে আগুন লেগে জঙ্গলের বেশ খানিকটা পুড়ে গিয়েছে। বেশ ক’দিন চিতাগুলিকে দেখছি না।”
জঙ্গল দেখার উত্তেজনা অনেকটাই মিইয়ে গিয়েছিল ওলিভারের কথা শুনে। প্রথম দিন বিকেলে জঙ্গলে ঘণ্টা দুয়েক ঘুরলাম। এক পাল হাতি, কয়েকটা জিরাফ, ব্যস। পরের দিন আলো ফোটার আগেই যখন ল্যান্ডরোভার চালু হল, থিয়োকে বলেছিলাম, ‘চিতা কিন্তু দেখানো চাই।” থিয়ো আমার কপালের দিকে আঙুল দেখিয়েছিলেন। এখন, হঠাৎ চিতার সন্ধান পেয়ে তিনিই সবচেয়ে অবাক।
আমাদের গাড়িটা পাহাড়ের লাল রাস্তা বেয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে গেল। রাস্তার উপরে আড়াআড়ি ভাবে শুয়ে দুটি চিতা। থিয়ো চাপা স্বরে বললেন, “ওদের দু’জনকেই তো গত ক’দিন করে খুঁজছি। ওরা দু’ভাই। একসঙ্গেই ঘোরে। আপনারা ভাগ্যবান। ক’দিন এখানেই থাকবে মনে হচ্ছে।”
গাড়ি দাঁড়াল। দশ মিটারের মধ্যে দুই ভাই। চোখের নীচে কালো দাগ? আছে। ধনুকের মতো বাঁকানো পিঠ? আছে। সুঠাম লম্বা দুটি পা? আছে। ঘাড় ঈষৎ উঁচু করে শোয়া? সে ভাবেই তো আমার থেকে ফুট দশেক দূরে শুয়ে আছে ওরা। হুর্রে বলে চেঁচিয়ে উঠতে যাব, থিয়োর সতর্কবার্তা, “কেউ দাঁড়াবেন না। নড়াচড়া করবেন না। এমনিতে এমন গাড়ি ভর্তি পর্যটক দেখতে ওরা অভ্যস্ত। কিন্তু মাথার উনিশ-বিশ হলেই ওরা সচেতন হয়ে পড়ে। তখন কী করে বসবে কেউ জানে না।” ক্লিক ক্লিক চলছেই। এক সময় কিছুটা বিরক্ত হয়েই উঠে বসল দু’জন। রাস্তা থেকে নেমে গেল কাঁটাঝোপের নীচে। হাত কয়েকের দূরত্ব। এত কাছে উপাদেয় নরমাংস, কিন্তু ওদের চারটি চোখ স্থির হয়ে আছে দূরের এক জঙ্গলের দিকে। থিয়ো বললেন, “শিকার দেখেছে ওরা। জঙ্গলের উপর থেকে চোখ সরাবে না ওরা। ওরা ভালই জানে আমরা ওদের খাদ্য নই।”
আধঘণ্টা আমরা ঠায় দাঁড়িয়ে। এক সময়ে দু’জনে উঠে বসল। পাশেই এক জলাশয়। তার উল্টো দিকে ওদের দৃষ্টি। সেখানে দাঁড়িয়ে কান ঝাপটাচ্ছিল গোটা দশেক অ্যান্টিলোপ। জল খেতে আসছে। ওরা উঠল। জলাশয়ের এক দিকে ঝোপ, তার ভিতরে ঢুকে অ্যান্টিলোপদের পিছন দিয়ে ঘুরে যাওয়ার জন্য দুলকি চালে হাঁটা শুরু করল। তার পর ঝোপের মধ্যে বিদ্যুতের ঝলকানি। ধপ করে একটা শব্দ। ঠিক তখনই থিয়ো বললেন, “একটা নতুন গন্ধ পাচ্ছি। মনে হচ্ছে বনের রাজাকে এ বার দেখব আমরা।” চিতা ভাইদের শিকারের শেষটা না দেখেই আমাদের ওই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হল। সবাই তখন সিংহ দেখতে উৎসাহী।
ঘাসের জঙ্গলে গা এলিয়ে পড়ে ছিলেন পশুরাজ। থিয়ো যেখানে গাড়ি দাঁড় করালেন, সেখান থেকে নিদ্রামগ্ন পূর্ণবয়স্ক সিংহটির দূরত্ব ফুট দশেক। বুক ঢিপঢিপ করছে। ক্যামেরার লেন্সে দেখি পশুরাজ চোখ পিট পিট করছেন। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ক্ষণিকের জন্য হৃৎপিণ্ডের স্টার্ট বন্ধ। পশুরাজ এক বার আমাদের দেখে ফের গা এলিয়ে দিলেন বাদামি ঘাসে। আমাদের মুখ দেখে থিয়ো হাসলেন, “ওর পেট এখন ঠাসা। দু’দিন শিকার লাগবে না।” এ বার ফেরার পালা। আমার মন পড়ে আছে চিতা ভাইদের দিকে। ওদের ভাগ্যে কি সত্যিই আজ শিকার জুটল, না কি অভুক্ত রইল ওরা? তাঁবুর কাছে পৌঁছে দেখি, এক জটলা। সুইটজারল্যান্ড থেকে আসা ক্যাথরিনা বার বার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। শুনলাম, দুই ভাইয়ের দৌড় শুরুটা আমরা দেখে এসেছিলাম। ক্যাথরিনারা দেখেছেন শেষ দৃশ্য। দু’জনে এক অ্যান্টিলোপের ঘাড় মটকেছে। আর তা দেখে জ্ঞান হারিয়েছেন তিনি। কয়েক মাস আগেই তাঁর গর্ভস্থ সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। স্বামী ম্যাক তাঁকে নিয়ে এসেছেন জঙ্গলে বেড়াতে। চিতা ভাইরা যে অ্যান্টিলোপটি শিকার করেছে সেটি ছিল অন্তঃসত্ত্বা। ক্যাথরিনা দেখেছেন সেই দৃশ্য! ম্যাক স্ত্রীকে যুক্তি দিয়ে বোঝাচ্ছেন এটাই প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু যুক্তি দিয়ে কি আর মনকে বোঝানো যায়?
পর দিন সকালে আমরা জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ের দিকে। আকাশে কালো মেঘ। এক ফোঁটা দু’ফোঁটা করে বৃষ্টিও শুরু হল। আগের দিন যে রাস্তায় চিতা ভাইদের দেখেছি সেখানেই দেখি ওরা টান টান শুয়ে আছে। গাড়ির পথ ছেড়ে দিতে উঠে চলে গেল জঙ্গলের ভিতরে। গাড়ি চলে যেতেই ফের উঠে এল রাস্তায়।
যতক্ষণ রাস্তাটা চোখে পড়ল ওদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এক সময় বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল ওরা। বিদায় নেওয়ার সময় ম্যানেজার বিল বললেন, “যে ভাবে চিতারা হারিয়ে যাচ্ছে, আবার কখনও এলে আপনাদের দেখানো যাবে কি না জানি না।”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.