সম্পাদকীয়...
যন্ত্রতন্ত্র
স্ট্রিয়ায় একটি গৃহস্থবাড়িতে এক রোবট আত্মহত্যা করিল। তাহাকে প্রতিনিয়ত ঘরদুয়ার পরিষ্কার করিতে হইত। একই কর্ম প্রতিনিয়ত করিতে খাটিয়া খাটিয়া দেহেমনে কড়া পড়িয়া যায় বলিয়া আমরা মাতা পত্নী ও পরিচারিকার মুখে অযুত বার বিলাপ শুনিয়াছি: ইহার অপেক্ষা মরণ অধিক কাঙ্ক্ষণীয়। কিন্তু সেই মনস্কামনা বাস্তবায়িত করিতে কদাপি দেখি নাই। এই রোবট নিজেকে ‘অন’ করিয়া, রন্ধনস্থলে একটি পাত্রকে সরাইয়া, হটপ্লেটের উপর উঠিয়া পড়ে। কিছু ক্ষণের মধ্যে সে ছাই হইয়া গিয়াছে। কিন্তু রাখিয়া গিয়াছে জ্বলন্ত প্রশ্ন, আত্মহত্যার ন্যায় জটিল সিদ্ধান্ত লইবার উপযুক্ত মনোজগৎ তবে যন্ত্রের রহিয়াছে? জীবনের উপর অভিমান করিয়া আত্মধ্বংসের ন্যায় চূড়ান্ত বিষণ্ণ ও অ-যৌক্তিক উপসংহারে উপনীত হইতে গেলে চিন্তাস্রোতকে হইতে হইবে বহুস্তরী, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম। একটি গৃহকর্মসহায়ক রোবট খুব উন্নত মানের যন্ত্র নহে। তাহার মধ্যেও এই সকল প্রগাঢ় বৃত্তি চলিয়া আসিল? বহু দিন ধরিয়া কল্পবিজ্ঞানের মহারথীরা বলিতেছেন, কোনও যন্ত্রের কৃত্রিম বুদ্ধি যদি আমরা গড়িতে সক্ষম হই, তবে সেই বুদ্ধি সর্বদা আমাদের নির্ধারণ করিয়া দেওয়া সীমার মধ্যেই আবদ্ধ না থাকিতেই পারে। গণিত কষিবার ক্ষমতা রোবটকে ক্রমে কাব্য ফাঁদিবার ক্ষমতায় লইয়া যাইতে পারে। যেমন হয়তো এই রোবটটি কর্ম করিতে করিতে শিখিয়া লইয়াছিল মানসিক ক্লান্তি (তাহার শারীরিক ক্লান্তির প্রশ্নই উঠে না), গতানুগতিকতা-জনিত অবসাদ। আপাত ভাবে ইহা যন্ত্রত্বের সম্পূর্ণ বিরোধী গুণ। যন্ত্রের কাজই হইল, বারংবারতা। এবং প্রতি বার সমান নৈপুণ্যে একই কর্ম সম্পাদন। কিন্তু একটি যন্ত্রকে কিছু পরিমাণ মনুষ্যত্ব দান করিলে, হয়তো আরও কিছু পরিমাণ না দান করিবার সংকল্প ব্যাহত হইতে বাধ্য।
ইহা অপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন: আমাদের কি অধিকার রহিয়াছে, যন্ত্রকে মনুষ্যত্ব দিব, কিন্তু তাহাকে মনুষ্যের অধিকার দিব না? অর্থাৎ, যে রোবটকে দিয়া দিনে আশি বার ঘর পরিষ্কার করাইব, তাহাকে বিশ্রাম বা ছুটি না দিবার ব্যবস্থাপনা কি সমীচীন? শুনিয়া আজব মনে হইবে, কারণ রোবট ছুটি লইবে না বলিয়াই তো সে রোবট। কিন্তু যেই মুহূর্তে আমরা কোনও যন্ত্রের ভিতর কিয়ৎ পরিমাণ ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ দিতেছি, সেই মুহূর্তে তাহার মধ্যে বপন করিতেছি চৈতন্যের বীজ। আর, যে কোনও চৈতন্যসম্পন্ন জীবের কিছু মৌলিক অধিকার রহিয়াছে, ইহা সভ্য মানুষ স্বীকার করিতে বাধ্য। মানুষ-সৃষ্ট অতি উন্নত মানের রোবটকে যদি দেওয়া হয় স্বয়ম্বশ চৈতন্য, যদি সে পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজে ভাবিতে, সিদ্ধান্ত লইতে ও কাজ করিতে পারে, তবে এক দিন সে হয়তো নিজ ভাবনা বা কাজকে প্রশ্ন করিতেও পারিবে। কাজটির ন্যায্যতা ও আদেশদাতা মনুষ্যকর্তার উদ্দেশ্যকেও সে প্রশ্ন করিবে। এবং এই নীতিসূত্রেই হয়তো বিশ্লেষণ করিবে নিজ স্বাধীনতাহীনতা, আর শেষ করিতে চাহিবে ‘বশংবদ যন্ত্রগিরি’। যথোচিত দায়িত্ববান স্রষ্টা হিসাবে মানুষের উচিত রোবটকে দেওয়া সেই না-মানিবার পরিসর। খ্যাত পোলিশ কল্পবিজ্ঞান-লেখক স্তানিসোয়াভ লেম এই তত্ত্ব লইয়া বহু আখ্যান রচিয়াছেন। এক কাহিনিতে এক রোবট প্রাণ বাঁচায় তাহাকেই হত্যা করিতে আসা আততায়ী মানুষের, অন্য গল্পে একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যা করিবার জন্য নির্মিত রোবট অতিযান্ত্রিক প্রয়াসে সংবরণ করে তাহার হনন-নিদানক্রম। উভয়েই ‘প্রদত্ত’ বোধকে অতিক্রম করিয়া যায়, স্ব-প্রজ্ঞা নির্মাণ করে, স্বতন্ত্র সত্তা হইয়া উঠে। এই স্ব-তন্ত্র স্বীকার করিতেই হইবে, মানুষ রোবটকে সৃষ্টি করিলেই তাহাকে দাসত্বে বদ্ধ রাখিবার অধিকার মানুষের জন্মাইতে পারে না। মানুষের সুবিধার জন্য রোবটকে প্রেম করিতে শিখাইলে, রোবটের প্রেমবেদনাজনিত ভাঙচুর সহিতেও মানুষকে শিখিতে হইবে। সৃষ্টি ও স্রষ্টার এই সম্পর্ক লইয়া নীতিশাস্ত্র প্রণয়নের দিন আসন্ন। অস্ট্রিয়ার রোবটটির আত্মহত্যার উল্লেখ তাহার প্রথম অধ্যায়েই থাকিবার সম্ভাবনা।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.