সর্বনাশের খবর এসেছিল মাঝরাতেই। ঘুম ভাঙার পর সেই এস এম এস দেখে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিলেন বিপ্লব কুণ্ডু। জেনেছিলেন, রাতারাতি অ্যাকাউন্ট থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে ১.৫৯ লক্ষ টাকা। যার মধ্যে ৮০ হাজার তোলা হয়েছে মুম্বইয়ের এটিএম থেকে। অথচ বিপ্লববাবুর দাবি, তখন এটিএম কার্ড বেঙ্গালুরুতে তাঁদের কাছেই ছিল। তার পিন নম্বরও জানতেন শুধু তিনি আর তাঁর স্ত্রী!
দিনে ৪০ হাজারের বেশি টাকা তোলা যায় না বিপ্লববাবুদের কার্ডে। সেই নিয়ম ফাঁকি দিতে টাকা তোলা হয়েছে এমন ভাবে, যাতে কয়েক মিনিটের ব্যবধানেও তারিখ আলাদা হয়। একই রাত। কিন্তু ১১:৫২ মানে ১ জুলাই। আর তার ১২ মিনিট পর ১২:০৪ হতেই ২ জুলাই। সে দিন রাতে এ ভাবেই দু’বারে ৪০ হাজার করে তুলে নেওয়া হয়েছে মোট ৮০ হাজার টাকা। তা হলে এটিএম থেকে কার্ড ছাড়া টাকা তোলা হল কী ভাবে? না কি ব্যবহার হল কার্ডের নকল?
ঘটনার প্রায় সাড়ে ৪ মাস পরেও এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।
পরের দিন (২ জুলাই) সকালেই ব্যাঙ্কে বিষয়টি জানান বিপ্লববাবু। অভিযোগ করেন লালবাজারের সাইবার ক্রাইম বিভাগেও। কিন্তু সুরাহা হয়নি। টাকা ফেরতের আশ্বাস তো দূর অস্ৎ। উল্টে কিছুটা দায় ঝেড়ে ফেলার ভঙ্গিতে ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, প্রতারণার জন্য গ্রাহকের গাফিলতিই দায়ী কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে। দোষীকে খুঁজে বার করার দায়ও পুলিশের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে তারা। যদিও এ নিয়ে পুলিশের কাছে পৌঁছতে তাদের ২০ দিন লেগেছে। তা-ও শেষ পর্যন্ত পুলিশের চিঠি পাওয়ার পর!
বিপ্লববাবু ও তাঁর স্ত্রী সুবর্ণাদেবী গড়িয়ার মানুষ। স্টেট ব্যাঙ্কের গড়িয়া শাখায় তাঁদের একটি যৌথ (জয়েন্ট) সেভিংস অ্যাকাউন্ট রয়েছে। যার এ টি এম কার্ড সুবর্ণাদেবীর নামে। চাকরি সূত্রে তাঁরা এখন বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা। ঘটনার সময় তাঁরা সেখানেই ছিলেন। |
স্কিমিং |
কার্ড সোয়াইপের সময় বিশেষ যন্ত্র দিয়ে তা থেকে
তথ্য হাতানোর নাম স্কিমিং। তথ্য নাগালে পেলে,
তা দিয়েই তৈরি করা হয় নকল কার্ড। |
|
হ্যাকিং |
|
ইন্টারনেটে সিঁদ কেটে তথ্য চুরি। চোর যে-ভাবে
সোনা-দানা চুরি করে, ঠিক তেমনই নেটে
ঢুকে অন্যের তথ্য হাতানোর নাম হ্যাকিং। |
|
ব্যাঙ্কের বয়ান অনুযায়ী, ১ জুলাই রাত ১১:৫২-য় প্রথমে ৪০ হাজার টাকা তোলা হয় মুম্বইয়ে স্টেট ব্যাঙ্কের থানে শাখার এটিএম থেকে। রাত ১২:০৪-এ ফের ৪০ হাজার সরানো হয় ওই এটিএম থেকেই। ৬০ হাজার অনলাইনে সরানো হয় স্টেট ব্যাঙ্কের নিউ গুয়াহাটি শাখায় দীপজ্যোতি শর্মার অ্যাকাউন্টে। তার পর নেটে ১৯ হাজারের কেনাকাটা করা হয় বিপ্লববাবুদের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে।
পরের দিন (২ জুলাই) সকালেই বিষয়টি স্টেট ব্যাঙ্কের গড়িয়া শাখার ম্যানেজারকে জানান বিপ্লববাবু। কিন্তু ২১ জুলাই পর্যন্ত ব্যাঙ্ক পুলিশের কাছে অভিযোগ জানায়নি। সাইবার ক্রাইম দফতরের কাছে বিপ্লববাবুর অভিযোগের সুবাদেই ব্যাঙ্কের কাছে বিষয়টি জানতে চিঠি দেয় তারা। তার পরই ব্যাঙ্ক বিষয়টি পুলিশকে জানায়।
ব্যাঙ্কের দাবি, নিউ গুয়াহাটি শাখায় দীপজ্যোতি শর্মার অ্যাকাউন্টে লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু টাকা খোয়া যাওয়া নিয়ে তাদের দায় নেই। কে প্রতারণা করেছে, তার তদন্ত করবে পুলিশই। কিন্তু তা হলে পুলিশকে না-জানিয়ে বিষয়টি ২০ দিন ফেলে রাখা হল কেন?
কর্তৃপক্ষের দাবি, “এ ধরনের অভিযোগ পেলে, আগে দেখা হয় ওই টাকা ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে গিয়েছে কি না। ব্যাঙ্কের পরিভাষায় যাকে বলে ‘সাকসেসফুল ট্রানজাকশন’। তা হয়ে থাকলে ক্লোজ সার্কিট টিভির ফুটেজ খতিয়ে দেখা হয়। এ ক্ষেত্রে ফুটেজে সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েনি।”
কিন্তু ফুটেজ তো সাধারণত দেখাবে কেউ কার্ড দিয়ে এটিএম থেকে টাকা তুলছেন। তা থেকে প্রতারণা বোঝা যাবে কী করে?
কর্তৃপক্ষ মেনে নিচ্ছেন যে, সত্যিই তা বোঝা যায় না। কিন্তু তা হলে পুলিশকে জানাতে দেরি কেন? ব্যাঙ্কের জবাব, “আমরা সাধারণত এ সব ব্যাপারে সরাসরি পুলিশকে অভিযোগ করি না। পুলিশ জানতে চাইলে তবেই তাদের জানাই। এ ক্ষেত্রেও ফুটেজ সাইবার ক্রাইম দফতরে পাঠিয়েছি।”
টাকা ফেরত পেতে আবেদন করলে, তা খতিয়ে দেখার জন্য ব্যাঙ্কের বিশেষ কমিটি আছে। বিপ্লববাবুরা তার কাছে আবেদনও করেছিলেন। কিন্তু তা খারিজ হয়ে গিয়েছে। বিপ্লববাবুর প্রশ্ন, “যেখানে ব্যাঙ্কই বলছে যে বিষয়টি পুলিশ তদন্ত করবে, সেখানে তা হওয়ার আগে আবেদন কী করে খারিজ হল?” এমনকী প্রতারণায় ব্যাঙ্কের কেউ জড়িত কি না, তা-ও তদন্ত করা উচিত বলে মনে করছেন তিনি। |