একমাত্র আর্থিক সংস্কারের হাত ধরেই আগামী দিনে উন্নতির পথে হাঁটতে পারে চিন। উন্নততর হতে পারে তার সমাজতন্ত্র এবং মার্ক্সবাদের ভাবধারাও! চিনের আর্থিক উদারিকরণের প্রস্তাবকে সমর্থন করে এই মন্তব্য খোদ চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিংপিংয়ের।
বিশ্বজোড়া মন্দার ধাক্কায় চিনের অর্থনীতি বেসামাল। বৃদ্ধির হার নেমে এসেছে ৭ শতাংশে। লাগামছাড়া হয়েছে ঋণের অঙ্ক। সেই পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে অর্থনীতিকে ফের চাঙ্গা করতে সংস্কারের উপরেই ভরসা রাখছে তারা। সেই চিন, যারা দীর্ঘদিন বিশ্বাস করে এসেছে পুরোপুরি সরকারি নিয়ন্ত্রণের অর্থনীতিতে।
সংস্কারের পরিকল্পনা হিসেবে একগুচ্ছ প্রস্তাব পেশ করেছে চিনের কমিউনিস্ট পার্টি। যার মধ্যে যথেষ্ট চোখে পড়ার মতো হল বাজারে প্রথম শেয়ার ছাড়ার ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস। শেয়ার বাজারে নথিভুক্তি এবং শেয়ার ছাড়ার পদ্ধতিকে অনেক বেশি স্বচ্ছ এবং সরল করা। যাতে উৎসাহিত হয় বেসরকারি সংস্থা। নিয়ন্ত্রকের কড়াকড়িতে এখন নতুন করে নথিভুক্তি কার্যত বন্ধই রয়েছে সাংহাই ও শেনজেন এক্সেচেঞ্জে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সাড়া জাগিয়েছে নতুন প্রস্তাব।
অবশ্য শেয়ার বাজারেই শেষ নয়। সংস্কারের ঢেউকে এ বার অর্থনীতির আরও অনেক ঘাটেই ছড়িয়ে দিতে চাইছে চিন। যেমন চিনের যে সব বড় সংস্থায় সরকারের হাতে সিংহভাগ (অনেক ক্ষেত্রে প্রায় পুরোটাই) মালিকানা রয়েছে, সেখানে আরও বেশি করে বেসরকারি বিনিয়োগ চাইছে তারা। অর্থনীতির হাল ফেরাতে আরও বেশি করে আস্থা রাখছে বেসরকারি পুঁজির উপর। চাইছে বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে আরও বেশি করে যৌথ উদ্যোগে সামিল হতে। অনেকেই মনে করছেন, সরকারের ধারের অঙ্ক বিপুল পরিমাণে বেড়ে যাওয়ার দরুন সরকারি বিনিয়োগে রাশ টানতে চাইছে চিন। অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে ডাকছে বেসরকারি পুঁজিকে।
যে জমি বা কৃষিকাজ নিয়ে চিন এত সংবেদনশীল, সংস্কারের হাওয়া সেখানেও ছড়িয়ে দিতে চাইছে তারা। এখন চিনে জমি মাত্রই তা সরকারের। কৃষিজীবীর অধিকার শুধু সেখানে চাষ করার। কিন্তু ‘নতুন’ চিনে জমির উপর ব্যক্তি মালিকানারও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, সেই জমি ব্যবহার তো করা যাবেই, তার হাত বদলেরও অধিকার থাকবে কৃষিজীবীর।
সংস্কারের এই প্রস্তাবকে বাস্তবে রূপায়িত করতে চিন কতটা আন্তরিক, এ দিন তা বারে বারে স্পষ্ট করতে চেয়েছেন জিংপিং। বলেছেন, “সংস্কার এবং অর্থনীতির দরজা খুলে দেওয়ার উপরেই নির্ভর করবে আধুনিক চিনের ভবিষ্যৎ। এর হাত ধরেই সত্যি হবে, দেশের অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন। আরও সমৃদ্ধ হবে সেখানকার সমাজতন্ত্র ও মার্ক্সবাদের পরম্পরা।”
শুধুমাত্র অর্থনীতিতে সংস্কারই নয়, চিনের ‘কুখ্যাত’ শ্রমশিবির ব্যবস্থাও বন্ধ করতে চাইছে তারা। ১৯৫০ সাল নাগাদ শ্রমশিবির নামের ব্যবস্থা চালু হয় চিনে। এতে সামান্য অপরাধেই কোনও ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে গিয়ে পুলিশ বিনা বিচারে চার বছর পর্যন্ত বন্দি করে রাখতে পারে। পুলিশের হাত থেকে সেই ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া ছাড়াও ২৩ লক্ষ সেনার সুবিশাল বাহিনীতেও কাটছাট করার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবে।
এ ছাড়া এক সন্তান নীতিতেও ছাড় দেওয়ার কথা ভাবছে চিন। শুক্রবার চিনের সরকারি সংবাদপত্রে জানানো হয়েছে, বাবা-মায়ের মধ্যে যে কোনও এক জন যদি একমাত্র সন্তান হন, তা হলেই তাঁরা দুই সন্তানের জন্ম দিতে পারেন। দেশের বিপুল জনসংখ্যা সামলাতে ১৯৭০ সালে এক সন্তান নীতি প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয় চিন। বলা হয়, বাবা-মা দু’জনেই যদি এক সন্তান হয়ে থাকেন, তা হলেই শুধুমাত্র দু’টি করে ছেলেমেয়ে থাকতে পারে। রীতিমতো বলপ্রয়োগ করেই আইন মানতে বাধ্য করা হয় দেশের মানুষকে। এ বার সেই আইনের রাশ খানিক হালকা করার কথা ভাবছে চিন।
তবে অনেকেরই মত, দেশের নাম যেহেতু চিন, তাই না আঁচালে বিশ্বাস নেই। কারণ এর আগেও বহু বার কমবেশি সংস্কারের কথা বললেও পুরোদস্তুর সেই পথে হাঁটেনি তারা। এ বার এ নিয়ে বিবৃতি দিচ্ছেন খোদ প্রেসিডেন্ট শি জিংপিং। এতে সিলমোহর দিচ্ছে চিনের কমিউনিস্ট পার্টি। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত এই সংস্কার বাস্তবায়িত না হচ্ছে তত ক্ষণ কিছুটা অবিশ্বাসী নজরেই চিনের দিকে তাকিয়ে গোটা বিশ্ব। |