আজই হয়তো ক্রিকেট-সূর্য অস্তাচলে |
|
ম্যাচ শেষ হলেই ‘ওয়েলকাম’
জানাতে চান ওয়াড়েকর রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায় • মুম্বই |
|
অজিত ওয়াড়েকর ভাবছেন, আজ বা কাল টেস্টটা শেষ হলে সচিনকে একটা ফোন করবেন। বলবেন, “তুমিও তো এখন থেকে আমাদের টিমে ঢুকে পড়লে!” টিম মানে, প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটারদের টিম। ওয়াংখেড়ের বাইরে গাড়িতে ওঠার সময় হাসতে হাসতে ওয়াড়েকর বলছিলেন, “কথাটা বললে মন্দ হবে? জোকস অ্যাপার্ট। সত্যি বলতে অবসরের পর সচিনের অনেক কিছু করার আছে। ক্রিকেট প্রশাসনেই আসুক কিংবা সাংসদ হিসাবে, সব জায়গাতেই ও সমান জনপ্রিয় হবে।”
ক্রিকেট-ঈশ্বরের সম্ভবত জীবনের শেষ টেস্ট ইনিংস দেখার পর কেমন যেন ঘোরে আছন্ন দেখায় কিরণ মোরেকে। মেরিন ড্রাইভের গায়ে অজস্র মিডিয়া বুমের গুঁতোগুঁতি, টিম ইন্ডিয়ার বাসে মহানায়ককে আরও একটু দেখার শ’য়ে-শ’য়ে ক্রিকেটপ্রেমীর ক্ষুধার্ত ইচ্ছে— কোনও কিছুই যেন ছুঁতে পারে না ’৮৯-র পাকিস্তান সফরে কিশোর সচিনের রুমমেটকে। অদ্ভুত গলায় কিরণ মোরের আকুতি চলে, “ক্রিকেট থেকে চলে যাওয়ার পরেও নিশ্চয়ই সচিন সব জায়গা থেকে উধাও হয়ে যাবে না...নিশ্চয়ই রোজ সকালে উঠে টিভিতে ওর মুখটা দেখতে পাব...নিশ্চয়ই ওর পুরনো ইনিংসগুলো দেখাবে এর পর থেকে...।” |
সেরা ডিফেন্স |
সেরা শট |
শিলিংফোর্ডের দুসরা শেষ মুহূর্তে বুঝে সামলালেন |
ভিন্টেজ স্ট্রেট ড্রাইভে হাফসেঞ্চুরি |
|
অভিজাত সিসিআই আজ এক ধাক্কায় পিছিয়ে গিয়েছে ছাব্বিশ বছরের পুরনো এক ক্রিকেট ম্যাচে। ’৮৭-এর পুরুষোত্তম শিল্ডের ম্যাচ। যেখানে সিসিআইয়ের বিরুদ্ধে চোদ্দোর তেন্ডুলকরের ব্যাট হাতে ৭০, যেখানে সিসিআই ক্যাপ্টেন ছিলেন মাধব আপ্টে, যার পর ক্লাবের প্রচলিত নিয়মে ভাঙা হয় শুধু সচিনকে নেওয়ার জন্যই, যার কয়েক মাসের মধ্যে সিসিআইয়ের হয়ে কাঙ্গা লিগে বিস্ময়-প্রতিভার আবির্ভাব এবং ক্রস ময়দানে কর্নাটক স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের সেরা পেসারকে প্রথম বলে বিশাল ছয়! সন্ধেয় যে সিসিআই কর্তা কথাগুলো বলছিলেন, তাঁর বয়স খুব বেশি নয়। অধিকাংশই শোনা, কিন্তু মুগ্ধতায় সে সব অবিশ্বাসের কোনও প্রশ্ন নেই।
আরব সাগরের তীরে শুক্রবার বিকেলের ক্যানভাসে পরের পর রংগুলোকে দেখলে ধন্ধ লাগবে, তা হলে কি ক্রিকেটীয় চিরবিদায়টা আজই ঘটে গেল? সরকারি ভাবে টেস্টের বাকি এখনও দু’দিন। ক্রিকেটকে যদি অনিশ্চয়তার সমার্থক ধরা হয়, তা হলে আপাতদৃষ্টিতে প্রায় অলৌকিক হলেও এখনও ঘটতে পারে অনেক কিছু, আরও একবার ড্রেসিংরুম ছেড়ে ব্যাট হাতে বেরোতে দেখা যেতে পারে মহানায়ককে। কিন্তু ওয়াংখেড়ের আবেগ সেটা বলবে। যুক্তি নয়।
|
মনঃসংযোগের প্রতিমূর্তি |
শঙ্কার মুহূর্ত |
শেষ মুহূর্তে বাউন্সার ডাক |
আপার কাট মারতে গিয়ে ফস্কানো |
|
নইলে কেন-ই বা চা বিরতির সময় বিনু মাঁকড় গেটের সামনে যন্ত্রণাবিদ্ধ দেখাবে ব্রায়ান লারার মুখ? যখন তিনি বলে ফেলবেন, “এত ভাল খেলেও শেষ টেস্টে সেঞ্চুরিটা পেল না। খারাপই লাগছে।” টেস্ট ক্রিকেটে যে সেকেন্ড ইনিংস বলেও একটা বস্তু আছে, কোথায়, ক্যারিবিয়ান প্রিন্সের গলা শুনে তো মনে হল না।
কেন-ই বা বিজয় মার্চেন্ট গ্যালারিতে বসে সারা দিন ‘স্যা-চি-ন...স্যা-চি-ন...’ চিৎকারে গলা ফাটানো আর টিনো বেস্টের বাপ-বাপান্ত করে চলা তরুণ এক সময় নিভে যাবেন, পাশের বন্ধুদের বলে উঠবেন, “চল রে। কাল এসে আর লাভ নেই। আর নামবে না।”
কেন-ই বা মুখচোখ তেরঙ্গার রঙে চুবিয়ে বিশাল ব্যানার নিয়ে ঘুরতে দেখা যাবে বছর তিরিশের এক মুম্বইকরকে। যেখানে লেখা থাকবে: ‘সৌরভ, রাহুল, সচিন, ভিভিএস তোমরা ভারতীয় ক্রিকেটকে অনেক কিছু দিলে। আমাদের আত্মা তোমাদের মনে রাখবে।’ |
|
অথচ সকাল সাড়ে ন’টা থেকে মুম্বইয়ের গরমকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যে আবহে ওয়াংখেড়ে ঢাকা পড়েছিল, দেখলে রবি শাস্ত্রীর ঢঙে বলতে ইচ্ছে করবে, ‘ইলেকট্রিফাইং অ্যাটমসফিয়ার!’ জলের বোতল পেলে জলের বোতল, দরকারে শুধু হাত, সচিনের এক-একটা বাউন্ডারিতে চেয়ারে সশব্দে আছড়ে পড়ছে। শরীর ঝুঁকিয়ে প্রত্যেকটা শটে সেলাম ঠুকছে গোটা স্টেডিয়াম। মহানায়কের নাম এবং গণপতি-কে সশ্রদ্ধ প্রণাম—দুইকে একসঙ্গে মিলিয়ে মিনিট পিছু কম করে দশ বার সৃষ্টি হচ্ছে মেঘগর্জন। ভিভিআইপি গ্যালারির বাইরে পঞ্জাব ক্রিকেট-প্রশাসক আইএস বিন্দ্রার গলা হিস্টিরিয়া আক্রান্তের মতো শোনায়, “অমর ইনিংস খেলছে, অমর ইনিংস!”
দশটা চল্লিশের পর সব কোথায় চলে গেল! ‘নবীন’ ভারতবর্ষের বারংবার হুঙ্কারেও সাড়া দিল না। পড়ে রইল ‘প্রবীণ’-কে নিয়ে শুধু স্মৃতি-রোমন্থন। |
বাবা তখন ক্রিজে। বলবয় ছেলে অর্জুন তেন্ডুলকর। ছবি: উৎপল সরকার। |
ওয়াড়েকর পরে বলছিলেন, ওয়াংখেড়েতে সচিনকে মহানায়কোচিত দেখালেও আজ পর্যন্ত সেরা ইনিংসটা মোটেও ওয়াংখেড়েতে নয়। এমনকী ভারতেই নয়। অকল্যান্ডে। যে ম্যাচে সচিন প্রথম ভারতের হয়ে ওয়ান ডে-তে ওপেন করেছিলেন। “আশির কাছাকাছি করেছিল। কিন্তু ওই ম্যাচে যা সব স্ট্রোক খেলেছিল, ওফ্! আজও যা খেলছিল, সেঞ্চুরি বাঁধা ছিল।” মোরের মনে আবার একই সঙ্গে হাত ধরে হাঁটে ক্রিকেটীয় এবং অক্রিকেটীয় সচিন। টিম ইন্ডিয়া ড্রেসিংরুমে সচিনের হায়দরাবাদি নাচ যদি মনে পড়ে, তা হলে সে দিনের শিয়ালকোট বনাম এ দিনের ওয়াংখেড়ের তুলনাও চলে আসছে আজ পিছু-পিছু। মোরে বলছিলেন, “শিয়ালকোটের সচিন অসম্ভব আগ্রাসী ছিল। যা পেত, উড়িয়ে দিত। কিন্তু এ দিনের ইনিংসটা খেলল পরিণত সচিন। দু’টোর মাহাত্ম্য দু’রকম।” আর ওই নাচ? “ওহ, ওটা বেঙ্কটপতি রাজুর আমদানি করা। বিকট একটা গান, হঠ শের আয়া। সচিন কিন্তু দিব্য নাচত!’’ |
স্বপ্নের মৃত্যু
আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে |
‘হঠ শের আয়া’ গেয়ে কি না জানা নেই, কিন্তু ওয়াংখেড়েও আজ নাচতে চেয়েছিল। কে জানত, কোনও এক অখ্যাত দেওনারায়ণ সর্বনাশটা করে যাবেন? কে জানত, কখনও ঘরের মাঠে শততম সেঞ্চুরির উৎসব আটকে যাবে মাত্র ছ’রান দূরে, কখনও বা বিদায়ী টেস্ট সেঞ্চুরি হবে না মাত্র ছাব্বিশটা রানের জন্য! দু’বারই ডারেন স্যামি বলে কোনও এক জনের হাতে সচিন রমেশ তেন্ডুলকরের ‘জীবন’ জমা হবে!
আফসোস তাই শহর মুম্বই কেন, পেরি ক্রস রোডের জগদ্বিখ্যাত বাসিন্দারও বোধহয় কোনও দিন যাবে না! |
প্রায় অলৌকিক কিছু না ঘটলে দ্বিতীয় ইনিংসে সচিনের ব্যাট করার সম্ভাবনা নেই।
ওয়াংখেড়েতে সচিনের ছবি পিটিআই ও উৎপল সরকারের। |
পুরনো খবর: সকালের ‘মৃত্যুপুরী’ সাহিত্য সহবাস বিকেলে স্বপ্নলোক |
|