আনন্দবাজার এক্সক্লুসিভ: আজই হয়তো ক্রিকেট-সূর্য অস্তাচলে
তেন্ডুলকরের নন-স্ট্রাইকারকে দেখে
নিজের দুর্ভাগ্যের কথা মনে পড়ে গেল

কোনও একটা ক্রিকেট ওয়েবসাইট বছরখানেক আগে খবর দিয়েছিল, তিনি মারা গিয়েছেন। ডাহা মিথ্যে! সিডনি থেকে দেড়শো মাইল দূরে তাঁর বাড়িতে শুক্রবার বিকেলে যখন ফোনে ধরলাম, মরিস-পত্নী জানালেন আগামী ১৭ জানুয়ারি তাঁর স্বামীর বিরানব্বই বছর পূর্ণ হবে। শরীর যথেষ্ট ভাল। কিন্তু কানটা বিগড়েছে। ফোনে বারবার করে একই প্রশ্ন করলে তবে বোঝেন। তা-ও থেমে থেমে জিজ্ঞেস করতে হয়। দু’বার তো স্ত্রীকে ফোন দিলেন প্রশ্নটা পরিষ্কার শুনে তাঁকে বোঝানোর জন্য। কথাবার্তা এবং চিন্তায় কিন্তু খুব গোছানো। নিজের ব্যাটিংয়ের মতোই। স্মৃতিশক্তিও দেখা গেল খুব ভাল। নইলে আর্থার মরিস এত স্বচ্ছন্দে পঁয়ষট্টি বছর আগের এক বিকেল পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে পারেন না। ব্র্যাডম্যানের ওভাল টেস্টের শেষ ইনিংসের সময় মরিসই ছিলেন নন-স্ট্রাইকার। আজ যেমন সচিনের উল্টো দিকে ছিলেন চেতেশ্বর পূজারা। আরও মিল চান? পূজারা যেমন সেঞ্চুরি করে গেলেন, তেমনই মরিসও ব্র্যাডম্যান আউট হওয়ার পরে বড় সেঞ্চুরি করেছিলেন। ওভাল দর্শক তাঁকেও মহানায়ক বিদায়ের পর আর ক্রিজে সহ্য করতে চায়নি। অথচ ৪৬ টেস্ট খেলা মরিস অস্ট্রেলিয়ান বোর্ডের সর্বকালের সেরা দল এবং ডনের বাছা টিম, দুটোতেই আছেন। নিজের সে দিনের অভিজ্ঞতা আর এ দিন টিভিতে বসে সচিন দেখা নিয়ে আনন্দবাজার-কে বিরল সাক্ষাৎকার দিলেন অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বেশি বয়সি জীবিত টেস্ট ক্রিকেটার...

...কানটা অনেকটাই এই বুড়ো বয়সে গিয়েছে। কিন্তু চোখে ঠিকঠাক দেখি। ফক্স স্পোর্টসে সকালে বসে বম্বের ম্যাচটা খুব আগ্রহ নিয়ে দেখলাম। তেন্ডুলকরের জন্য দেখলাম। নইলে অস্ট্রেলিয়ার খেলা না থাকলে টিভিতে সব সময় ক্রিকেট চালাই না। আমার অনেক বন্ধু অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার আছে যাদের সঙ্গে তেন্ডুলকরের আলাপ আছে। আমার কখনও সেই সুযোগ হয়নি। কিন্তু দূর থেকে এত বছর দেখে দেখে আমি ওর এক জন বড় ফ্যান। টিভিতে বলছিল সচিন চলে যাওয়ায় সবার মন খুব খারাপ। হবেই। ডন চলে যাওয়ার পর আমরাও খুব ইনসিকিওর মনে করতাম নিজেদের। সময় যায়। নতুন লোক আসে। আস্তে আস্তে সয়ে যায়।
নন-স্ট্রাইকার

জীবনের শেষ ইনিংসে ব্র্যাডম্যান যখন আউট হন,
আর্থার মরিস ছিলেন নন-স্ট্রাইকার। নবতিপর ফোনে
বললেন, “সচিনের ফেরা দেখতে দেখতে সে দিনের
কথা মনে পড়ছিল।... ডন ক্লাসেই ওকে রাখব।”
ডনের সঙ্গে আমি অনেক দিন খেলেছি। ওর আটচল্লিশের দলে আমি ছিলাম থার্ড সিলেক্টর। টিমের এক জন ক্রিকেটার হয়েও আমাকে ট্যুর সিলেক্টর বাছা হয়েছিল। অবসর জীবনেও আমাদের প্রচুর কথাবার্তা হয়েছে। ডন আমার দেখা গ্রেটেস্ট ব্যাটসম্যান। তেন্ডুলকরের সঙ্গে ওর তুলনা করতে চাই না। দুটো জমানার তুলনা করা যায় না। উইকেট কভার্ড হয়ে যাওয়া একটা মস্ত তফাত। প্লাস ব্যাটের ওজন। আমার নিজের ব্যাটের ওজন ছিল ২.৩ পাউন্ড। এখন কেউ তিন পাউন্ডের নীচে হাতেই তোলে না। তুলনাটা হবে কী করে? তবু আমি যা দেখেছি, তার ভেতর ডন ক্লাসেই আমি তেন্ডুলকরকে রাখব। কী চমৎকার ব্যাট করছিল! ডন আর ওর দু’জনেরই পায়ের ব্যালেন্সটা চমৎকার। বলের লেংথটা খুব ভাল বুঝতে পারে। কিন্তু ডন যেখানে এগিয়ে থাকবে তা হল, দ্রুত রান তোলার ক্ষমতা। নিউ সাউথ ওয়েলসের মাঠে আমি যখন প্রথম ডনকে দেখি, সদ্য টিনএজে পড়েছি। কিন্তু ওই ব্যাটিং দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
তখন কি আর জানতাম, পাকেচক্রে ওর বিদায়ী ইনিংসের সঙ্গে যে আমি জড়িয়ে যাব। আমিই থাকব সেই মুহূর্তে হতভাগ্য নন-স্ট্রাইকার। ওভালে যখন ও নামল আর ইয়ার্ডলি টিমকে জড়ো করে গার্ড অফ অনার দিল, আমি কিন্তু ওকে ইমোশনাল হতে দেখিনি! হোলিসের গুগলিটা ও আসলে কিছু বুঝতেই পারেনি। ও লেগ ব্রেক ভেবে খেলেছিল। বলটা অফস্টাম্পের বাইরে থেকে টার্ন করে অফস্টাম্পে লাগল। ডন বেশ বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল। বলটা সত্যিই ভাল পড়েছিল। এটাই ক্রিকেট। তখন লাইভ টিভির কোনও কাহিনি ছিল না। আমার কাছে ওই ম্যাচের সাক্ষী কিছু ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবি। এমনকী আমরা এটাও জানতাম না আর একটা বাউন্ডারি হলেই যে, ডনের অ্যাভারেজ গিয়ে একশোতে দাঁড়াবে। পরে অনেকে বলেছিল, ইংল্যান্ডকে ফলো-অন করাবার কী দরকার ছিল! আবার ডন ব্যাট করে চার রানটা করে নিতে পারত তো! আমি তখন বলেছিলাম, কী গ্যারান্টি যে সেকেন্ড ইনিংসেও একটা ভাল বল পড়ত না? ও যে আবার জিরো করত না? ক্রিকেটে যে কোনও কিছু হতে পারে।
এই যে তেন্ডুলকর এত ভাল ব্যাট করেও সেঞ্চুরি পেল না— এটাই ক্রিকেট। তেন্ডুলকরের নন-স্ট্রাইকার ছেলেটাকে দেখে আমার নিজের কথা মনে পড়ছিল। আমরা দু’জনেই কী রকম হতভাগ্য! ডন উইকেটে আসার আগে আমি সেঞ্চুরি পার্টনারশিপ করি বার্নসের সঙ্গে। কেউ অভিভূত হয়নি। সবাই ডন কখন ব্যাট করতে আসবে, সেই অপেক্ষায় বসে ছিল। তার পর যখন আউট হয়ে গেল, অনেকেই বেরিয়ে গেল। তখনকার দিনে দর্শকরা এত রূঢ় ছিল না। একটা সভ্যতা মেনটেন করত। অথচ সেই আমলেও কি না ডন আউট হতে দলে দলে বেরিয়ে গেছিল। খেলাটাই যেন আউট হয়ে গেল সবার মন থেকে। আমি দু’দিন ব্যাট করে ১৯৬ করি। কিন্তু গ্যালারির প্রতিক্রিয়া ছিল; ওহে তোমাকে বাধ্য হয়ে আমরা সহ্য করছি।
ওভাল ১৯৪৮
ওয়াংখেড়ে ২০১৩
তেন্ডুলকর আউট হওয়ার পর আর খেলা দেখছি না। আন্দাজ করতে পারি, ওই ছেলেটা নামটা জানি না, বেশ স্ট্রেট খেলে। ওরও ভাগ্যে নিশ্চয়ই অবহেলাই জুটছে। ব্যক্তি ডন সম্পর্কে অনেক রটনা আছে। তার অনেকটাই মিথ্যে। ও খুব কম লোকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল। লাকিলি আমি সেই ছোট গ্রুপে পড়তাম। আমি এক দিন আমার বান্ধবীকে নিয়ে বেরিয়েছি। হোটেলের লবিতে ডনের মুখোমুখি। ও জানত আমরা কিছু দিনের মধ্যে বিয়ে করতে যাচ্ছি। আমার ভাবী স্ত্রী তাই বলল, হ্যালো স্যর ডোনাল্ড! ও তখন উত্তর দিয়েছিল, স্যর নয় আমাকে ডন বলবে। ব্যক্তিজীবনে ভীষণ প্রাইভেট হলেও ডনের মধ্যে একটা দারুণ জিনিস ছিল! ও নিজেকে নিছক গ্রেটেস্ট ব্যাটসম্যান নয়, শ্রেষ্ঠ রোল মডেল হিসেবে দেখত। এই বাড়তি চাপটা ও সব সময় নিজের কাঁধে নিয়েছে। এই গুণটা আমার দারুণ লাগত যে, নিজেকে স্রেফ ক্রিকেটার হিসেবে দেখছে না। অনেক আড্ডা হয়েছে আমাদের। একটাই আশ্চর্য, ওভালের জিরো করাটা এক বারের বেশি কখনও আলোচনায় তোলেনি। শুধু এক বার বলেছিল, আর্থার, বলটা কিন্তু সোজা স্টাম্পে লাগেনি। তুমি কি খেয়াল করেছিলে? আমি তখন বলি, হ্যাঁ, তোমার ব্যাটে হাল্কা লেগে স্টাম্পে লাগে। ও ঘাড় নাড়ে। কোথাও মনে হয়েছিল ওই বোল্ড হওয়াটা ওর এমন একটা ক্ষত যেখানে হয়তো কোথাও ওর ক্রিকেটীয় ইগো ধাক্কা দেয়। আমার আজ সচিনের প্যাভিলিয়নে ফেরা দেখতে দেখতে ডনের ওভালে ফিরে যাওয়া মনে পড়ছিল। ব্যাটটা কাঁধের ওপর তুলে যে ভাবে দ্রুত আসত, সে ভাবেই চলে গেল চিরকালের মতো। শুধু ঘাড় ফিরিয়ে এক বার আমাকে বলল, কিপ গোয়িং। মানুষ চলে যায়। বছরগুলো চলে যায়। চ্যাম্পিয়নরা চলে যায়। স্মৃতি এসে কোথাও মিলিয়ে দেয় নতুন দিনের সঙ্গে। আজ টিভি খোলার আগেও ভাবিনি এত পিছনে ফিরব এত বার...
কিংবদন্তিদের শেষ টেস্ট ইনিংস
ডন ব্র্যাডম্যান
রান ০। প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, কেনিংটন ওভাল, ১৯৪৮।
গ্যারি সোবার্স
রান ২০। প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, পোর্ট অব স্পেন, ১৯৭৪।
লেন হাটন
রান ৫৩। প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড, অকল্যান্ড, ১৯৫৫।
গ্রেগ চ্যাপেল
রান ১৮২। প্রতিপক্ষ পাকিস্তান, সিডনি, ১৯৮৪।
সুনীল গাওস্কর
রান ৯৬। প্রতিপক্ষ পাকিস্তান, বেঙ্গালুরু, ১৯৮৭।
ভিভ রিচার্ডস
রান ৬০। প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, কেনিংটন ওভাল, ১৯৯১।
জাভেদ মিয়াঁদাদ
রান ৩১। প্রতিপক্ষ জিম্বাবোয়ে, লাহৌর, ১৯৯৩।
স্টিভ ওয়
রান ৮০। প্রতিপক্ষ ভারত, সিডনি, ২০০৪।
ব্রায়ান লারা
রান ৪৯। প্রতিপক্ষ পাকিস্তান, করাচি, ২০০৬।
রিকি পন্টিং
রান ৮। প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা, পারথ, ২০১২।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.