প্লেয়ারদের হোটেলে ফেরত যাওয়ার সময় হল। ওয়াংখেড়েতে টিম-বাস যেখানে দাঁড়ায়, তার ঠিক সামনেই দেখছি
এক তরুণী প্ল্যাকার্ড হাতে। মুখে গেরুয়া-সবুজ রং মাখা। অথচ যাবতীয় নিরাপত্তাকে ভ্রূক্ষেপ না করে
পজিশন নিচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
টিম-বাসের বাইরে! প্ল্যাকার্ডের
লেখায় চোখ পড়লে তবেই খটকাটার সমাধান হচ্ছে।
‘গেল প্লিজ প্লিজ স্কোর এ ডাবল টুমরো!’
স্টেডিয়ামে লাগানো সচিন তেন্ডুলকরের অজস্র ছবি আর নানান শুভেচ্ছাকে ছাপিয়ে তরুণীর হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডটাই দিন শেষে গোটা ভারতবর্ষের আকুতি! যার সঙ্গে ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যার তুমুল সংঘর্ষ হতে বাধ্য। সেখানে যে একমাত্র প্রশ্ন বেঁচে রয়েছে, শনিবার লাঞ্চ অবধিও খেলাটা গড়াবে কি না।
মনে আবেগের মাস্তুল নিয়ে কে আর কবে অঙ্কের দাসত্ব করেছে? এই মেয়েটি এবং গোটা ভারতবর্ষ এখন কাতর ভাবে চায়, বাকি ২৭০ রানের ঘাটতি কাটিয়ে ক্যারিবিয়ানরা গেলের মাধ্যমে ফুঁসে উঠুক। যাতে ভারত আবার ব্যাট করতে পারে। সেই বৃহত্তর প্রার্থনাকে সফল করতে তা হলে যে সচিনকে শেষ বারের মতো ব্যাট হাতে দেখা যাবে!
তরুণী তো তবু এত পরে তৎপরতা দেখাচ্ছে। সেঞ্চুরির স্বপ্ন ২৬ রান আগে আরব সাগরে চলে যাওয়ায় তখনই জনপ্রিয় আবেদন ছিল, ধোনি এখনই ডিক্লেয়ার করো। আমির খান এসে কমেন্ট্রিতে বলে যাওয়ায় হয়তো ব্যাপারটা আরও প্রচার পেল।
কিন্তু হোস্ট ব্রডকাস্টার মহলে তার আগেও অনেকেই এসে বলছিলেন, ক্রিকেট কত রোমান্টিক হবে ধোনি এখনই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ব্যাট করতে পাঠালে!
শেন ওয়ার্ন তখন এবিপি-কে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছিলেন শুক্রবারের সচিন সম্পর্কে; “কী শেষটা করল! যেন মাঠের বস্। যেন সব কিছুর আমিই ইন-চার্জ! এখানে যা ঘটবে সবআমার তৈরি নিয়মে।” বলতে বলতেই এক টিভি কর্মীকে ডাকলেন, “আরে এরা কি চেঁচাচ্ছে ধোনি ডিক্লেয়ার করুক? অবিশ্বাস্য!” |
ফেরা। এটাই কি শেষ বার, প্রশ্ন জাগিয়ে প্যাভিলিয়নের পথে সচিন তেন্ডুলকর। শুক্রবার ওয়াংখেড়েতে। |
অবিশ্বাস্য একটু কমই বলা হল। আধিদৈবিক বোধহয় বেশি উপযুক্ত। ওয়াংখেড়েতে সচিনের ক্রিকেটীয় মহাপ্রস্থান ঘিরে ক্রমাগত যা যা ঘটল। সকালে তাজমহল হোটেলে সচিন ব্রেকফাস্টে নামেননি অন্য দিনের মতো। বোঝা গেল সেঞ্চুরির জন্য তীব্র ফোকাস রাখতে চান। কিন্তু ৮টা ৫ হয়ে গেল। টিম-বাস ছাড়ব ছাড়ব করছে। সবাই উঠে গিয়েছেন। তিনি তখনও নেই কেন? বরাবর যিনি সবার আগে বাসে ওঠেন, তাঁর কি না আজ দেরি হল পাঁচ মিনিট। কোনও তুকতাক ছিল না তো? নয়তো আজ ঠিক চব্বিশ বছর পূর্ণ হওয়া তাঁর ক্রিকেটজীবনে কোনও দিন টিম-বাসে উঠতে তো দেরি হয়নি। সচিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, বিখ্যাত ফটোগ্রাফার অতুল কসবেকর কাল রাত্তির থেকে সবাইকে সতর্ক করে দিচ্ছেন, “বন্ধুরা, যা পরেছিলে সবাই সেই ড্রেস রিপিট করবে। যেখানে বসেছিলে বিষ্যুদবার, সেখানেই বসবে।” অজিত তেন্ডুলকর ও বন্ধুদের আজ দেখলাম অবিকল সেই পোশাক। সেই একই জায়গায়।
অনেকের অবশ্য পোশাক বদলাবার প্রশ্ন নেই। তাঁরা এ দিনই মাঠে প্রথম। রাহুল গাঁধী, রাজ ঠাকরে, মনোহর জোশী, যুবরাজ সিংহ এবং হৃতিক রোশন। প্রথম বল থেকেই সেই পরিত্রাহী ‘স্যা-চি-ন, স্যা-চি-ন’। স্টার টিভির প্রোডিউসার ঘনঘন তাঁর ক্যামেরাম্যানকে নির্দেশ পাঠাচ্ছেন কন্ট্রোলরুম থেকে, “ওঁকে শুধু ক্লোজে রাখো।” ক্রিকেটবিশ্বে টিভি সম্প্রচারের দুনিয়ায় ইতিহাস সৃষ্টি করে মুম্বই টেস্টে একা সচিনের জন্যই দু’জন ক্যামেরাম্যান। সহজ বিট— যেখানে পাবে ক্লোজ ধরবে। এগ্জিকিউটিভ প্রোডিউসার তা-ও অনুযোগ করছিলেন, “চার জন চেয়েছিলাম। বাজেটে আটকাল।”
দু’জনই অবশ্য গতকালের মহানাটক ফের শুরু করে দেওয়ার পক্ষে পর্যাপ্ত! মাঠের মেজাজেও যেন তেমনই ক্রিকেট-বসন্তের অপরূপ হাওয়া বইছে। টিনো বেস্ট, যাঁকে এত দিন ভারতীয় পেস বোলিং ইউনিটেও বল করার যোগ্য মনে হচ্ছিল না, তিনি অদ্ভুত ভাবে সকালে অ্যান্ডি রবার্টসের উপযুক্ত বংশধরে উন্নীত হলেন। ওয়াংখেড়েতে বল পড়ে ঘুরলেও প্রেসবক্সের দিকের উইকেটে যথেষ্ট বাউন্স। বেস্ট সেটা কাজে লাগিয়ে অফস্টাম্পের ওপর বল তোলা শুরু করলেন। এমনিতে এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমটা অখাদ্য। ব্যাটিংয়ের যা নমুনা, ফ্র্যাঙ্ক ওরেল তাঁর সমাধিতে নড়েচড়ে বসতে পারেন। কিন্তু শুক্রবারের প্রথম ঘণ্টাটা ক্যারিবিয়ানরা উত্তেজক ফাস্ট বোলিংয়ের মাধ্যমে সিরিজের প্রথম লড়াই দিল। টিনো বেস্টের শরীরী ভাষা দেখে মনে হচ্ছিল, ডেল স্টেন খেলে রিটায়ার না করতে পারার অতৃপ্তি আজ থেকে আর তেন্ডুলকরের থাকবে না!
গত এক বছর তেন্ডুলকর মোটেই নিজের মাপে খেলেননি। ওয়াংখেড়ের ইনিংসটা না ঘটলে বলার যথেষ্ট সুযোগ থাকত যে, রিটায়ার করতে দেরি করল। কিন্তু দ্বিতীয় দিনের মুম্বই যে সচিনকে দেখল, তিনি যেন নব্বই দশকের সেই তরুণ, যে বিশ্বাস করত ব্যাটসম্যানশিপ মানে ফাস্ট বোলিংয়ের সামনে শুধু বুক ফুলিয়ে দাঁড়ানো নয়। ওটাকে পাল্টা আক্রমণ করা। বেস্ট এই সময় আগুনে মেজাজ দেখাতে শুরু করলেন। মাঠে সমবেত ভাবে তাঁকে তীব্র ব্যারাকিং, চিৎকার, বেস্টের আরও গনগনে মেজাজে বোলিং মার্কে ফিরে যাওয়া। গোটা মাঠ শুভার্থীর চাদর বিছিয়ে দিয়ে হাততালি দিচ্ছে। মা রজনী তেন্ডুলকর টেনশন ভরা চোখে তাকিয়ে। স্ত্রী আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন একটা কট বিহাইন্ড হতে হতে সচিন নিষ্কৃতি পাওয়ায়। নিকটবর্তী মেরিন ড্রাইভের ফুটপাথে বসে তখন তাঁর মঙ্গল কামনায় সুফি গায়কেরা গাইছেন, মনে হচ্ছে সেটাও যেন একটা সেঞ্চুরির জন্য দেশবাসীর তরফে যজ্ঞ।
এই সব মুহূর্ত তেন্ডুলকরের এত বর্ণময় ক্রিকেটজীবনেও আসেনি! আজ যে চিরবিদায়ের বেলা! |
স্তব্ধ গ্যালারি। শুক্রবারের ওয়াংখেড়ে। |
সংঘর্ষটা জারি ছিল এক ঘণ্টা ন’মিনিট। তার পরেই তো স্লিপে ডারেন স্যামির অনবদ্য ক্যাচ এবং গোটা ভারতের সম্ভাব্য দিওয়ালি ছারখার হয়ে যাওয়া! কিন্তু তারই মধ্যে সচিনের পঞ্চাশ পূর্ণ হতে মাঠের আর্দ্রতা এমন মাত্রায় উঠে গিয়েছিল যা গত কালও দেখিনি। ইয়ান বিশপ তো পাবলিক ফোরামে প্রকাশই করে ফেললেন তাঁর বিস্ময় জড়ানো অভিব্যক্তি, “এ তো জীবনের থিয়েটার! মনে হয় না ওয়াংখেড়ের বাইরে কোথাও কিছু ঘটছে বলে।”
সচিনের সেঞ্চুরিপ্রাপ্তি অবাধ্যতা করেছে তো কী! ২০১৩-র ১৫ নভেম্বরের ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে মায়াবী বিষণ্ণতার দিন হিসেবে চিত্রিত হওয়া তো আর আটকাতে পারেনি!
কী অসাধারণ, আউটের পর সচিনের ফিরে যাওয়াটা! গত চব্বিশ বছর বাইশ গজের দিকে তাঁর হেঁটে যাওয়ার মধ্যে আধুনিক ভারত নিরাপত্তা পেয়েছে। আখ্যা দিয়েছে— দ্য সচিন ওয়াক। আজ সেই ‘ওয়াকের’ রিভার্স হওয়ার লগ্ন! মাঠের কোণে গিয়ে সিঁড়িতে ওঠার মুখে সচিন হেলমেট খুলে ফেললেন। ঘুরে ব্যাটটা তুললেন মাঠের দিকে। চিরকালীন ঐতিহাসিক মুহূর্ত! স্কোরবোর্ডে তখন ফুটে উঠছে, ‘সচ, চব্বিশ বছরের বিনোদনের জন্য ধন্যবাদ!’ আর মাঠে দাঁড়িয়ে সচ ধন্যবাদ দিচ্ছেন এত বছর সঙ্গে থাকার জন্য! কপিল-গাওস্কর-দ্রাবিড়-কুম্বলে কত চ্যাম্পিয়ন দেখেছে ভারত। ভারতীয় আম আদমির এই রকম বন্ধন কারও সঙ্গে তৈরি হয়নি। নরসিংহ দেওনারায়ণের ওই একটা ডেলিভারি গোটা মাঠে যেন হাহাকারের আলখাল্লা বিছিয়ে দিল। সচিনের ক্রিকেট মাঠ থেকে মহাপ্রস্থান তো নিছক প্রিয় ক্রিকেটারের বিদায় নয়। নিজেদেরও স্মৃতিজড়িত এক একটা সিন্দুকের তালা চিরকালীন বন্ধ হয়ে যাওয়া। মাঠ মুহূর্তে অর্ধেক ফাঁকা।
ব্র্যাডম্যানের কথা মনে পড়ে গেল। তাঁদের বেনিফিট ম্যাচে ডনকে বোল্ড করে গ্রিমেট তীব্র ব্র্যাডম্যান-বিরোধী এবং নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভিক্টর রিচার্ডসনকে বলেছিলেন, “সাউথ আফ্রিকা নিয়ে যায়নি তো আমাদের। আচ্ছা বদলা নিলাম!” ম্যাচটা রিচার্ডসনেরও বেনিফিট। তিনি উত্তেজিত হয়ে গেলেন, “মূর্খ, এটা কী করলে? ডন আউট হয়ে যাওয়ায় লাঞ্চের পর তো আর কেউ টিকিটই কাটবে না!” এটা সিডনির কথা। আর ওভালের শেষ ইনিংসে ডনকে বোল্ড করা বলটা এরিক হোলিস নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন অনেক বছর। ওই বলটা নিয়ে নানা জায়গায় ক্রিকেট শো করতেন। তার পর এক দিন একটা প্রোগ্রাম থেকেই ওটা চুরি হয়ে যায়। আজও তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। এই সে দিনও মৃত হোলিসের মেয়ে সেটা ফেরত চেয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন। দেওনারায়ণও অবধারিত ম্যাচ বলটা তাঁর কাছে রেখে দেবেন। এ দিন অনেকে বলছিলেন, “ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোনও বার-এ আর ওর টাকা লাগবে না। বার স্টুলের ওপর কাউকে না কাউকে পেয়ে যাবেই, যে আউটের গল্পটা শোনার জন্য দু’তিন পেগ ওকে খাওয়াতে আজীবন রাজি থাকবে।”
কিন্তু ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেট দর্শক, তার কী হবে? তাকে কে দেখবে? এই তো রোহিত শর্মা উপর্যুপরি দু’টো সেঞ্চুরি করলেন। পূজারা সেঞ্চুরি করলেন। কোহলি রান পেলেন। মিলিত প্রভাবেও কি চার নম্বরে বেরিয়ে আসা ওই ছায়াটা পাওয়া গেল, যা নির্যাতিত যৌনকর্মী থেকে রাজা-মহারাজা, সবাইকে এত বছর সমান ভরসা দিয়েছে!
বিকেলে ভারতীয়রা কেউ কেউ নেট করতে নামলেন। পরিচিত মুখটা আর দেখলাম না। অদ্যই তো তাঁর শেষ রজনী। শনিবার নিয়মরক্ষার জন্য স্রেফ ক’ঘণ্টা মাঠে থাকা। হয়তো কয়েক ওভার বল করা। তাতে কী? আত্মাটা তো মৃত আজই। কাল শুধু আনুষ্ঠানিক চুল্লিতে দেওয়া!
ভরা থাক স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি! |