|
|
|
|
|
শেষ যুদ্ধে ডনকে
পেরোলেন সচিন
গৌতম ভট্টাচার্য • মুম্বই |
|
চাপ দাড়ি। নীল স্ট্রাইপড শার্ট। দোহারা চেহারা। মন দিয়ে এত ক্ষণ সূক্ষ্ম টেকনিক্যাল ব্যাখ্যা করছিলেন শিখর ধবন আর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ট্রোক খেলার সময়ে শরীরের পজিশন কতটা আলাদা। হঠাৎই ভারতের প্রথম উইকেট পড়ল আর জনতার তুমুল হর্ষধ্বনি। চাপ দাড়ি সবিস্ময়ে ঘাড় ঘোরালেন, “এ কী, পাবলিক ইন্ডিয়ার উইকেট পড়াতে উল্লাস করছে কেন?” আসলে কুড়ি বছর বাদে বিষ্যুদবার প্রথম ওয়াংখেড়েতে ঢুকছেন। তাঁর কোনও আন্দাজই নেই যে, আধুনিক ভারতীয় ক্রিকেট-দর্শকের রিংটোনটা এখন কী দাঁড়িয়েছে? ভারতীয় ক্রিকেট জঙ্গলের দীর্ঘ দিনের আইন, টেস্ট ম্যাচে দেশের প্রথম উইকেট পড়া থেকেই তীব্র চিৎকার শুরু হবে। ওয়ান ডাউন যে নামল, তার প্যাডে লাগামাত্র বিদেশি বোলারের সঙ্গে জনতাও অ্যাপিল করবে। যে করে হোক ইন্ডিয়ার দু’টো উইকেট চাই। তবেই না প্যাভিলিয়ন থেকে ওই বেঁটেখাটো ছায়াটা বেরোবে!
আরব সাগর-ধারে ওয়াংখেড়ে মাত্র তিরিশ হাজার লোক নিয়েও চিৎকারটাকে এ দিন সমুদ্র গর্জনে নিয়ে গিয়েছিল। কোনও কোনও সময় ভ্রম হচ্ছিল, এক লাখের পুরনো ইডেন! মুরলী বিজয় যখন ফরোয়ার্ড শর্ট লেগের হাতে ক্যাচ দিয়েও দাঁড়িয়ে আছেন, আম্পায়ার নো বল ডাকলে আবার ফিরবেন বলে, জনতা তাঁকে তীব্র তিরস্কার শুরু করে দিল: চলো, নিকলো। আম্পায়ারকে নির্দেশ দিচ্ছিল: ডোন্ট ওয়েট। রেইজ ইওর ফিঙ্গার। মাঠের দক্ষিণ-পূর্বে দিভেচা প্যাভিলিয়নের সব চেয়ে টঙে বসে থাকা চাপ দাড়ি দেখেশুনে আশ্চর্য হয়ে পড়ছেন। ক্রিকেটমহলে তিনিই একমাত্র মনুষ্য, যিনি গত দেড় দশকেরও বেশি সময় সচিন তেন্ডুলকরকে লাইভ ব্যাট করতে দেখেননি। না মাঠে, না টিভিতে। সচিনের ম্যাচ থাকলে তিনি হয় বাড়ি বন্ধ করে টেনশনে ঘুমিয়ে পড়েন। কেউ বেল বাজালেও খোলেন না। অথবা গাড়ি নিয়ে যে দিকে দু’চোখ যায়, চলে যান। বহু বহু বছর বাদে তেন্ডুলকরের শেষ ম্যাচ বলে বাধ্য হয়ে এসেছেন। আর থেকে থেকে আধুনিক ক্রিকেট মাঠের ব্যবহারে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছেন। এই সব কাজ-কারবার তো জীবনে দেখেননি। তাঁর সব প্রশ্ন করার ধরন দেখলে মনে হবে, আরে এ তো ক্রিকেটের রিপ ভ্যান উইঙ্কল। নির্ঘাৎ এত দিন ঘুমিয়ে ছিল। চাপ দাড়ির সঙ্গে এ বার পরিচয়ের সময় হয়েছে— অজিত তেন্ডুলকর। দু’শোতম টেস্টের তাজমহল গড়া মনুষ্যের দাদা, ফ্রেন্ড, ফিলোজফার এবং চিরকালীন পথপ্রদর্শক।
মুরলী বিজয়কে আম্পায়ার আউট দিতেই চাপ দাড়ির চেহারা আমূল বদলে গেল! ঝুঁকে পড়লেন রেলিং ধরে সামনের দিকে। বাইশ গজে ভাইয়ের অন্তিম অগ্নিপরীক্ষা। গ্যালারিতে তাঁর! গান্ধারীর চোখ বেঁধে রাখার মতো তাঁরও তো এত বছরের ব্রত ছিল যে, নিজের চোখে ভাইয়ের ব্যাটিং দেখবেন না। দেখলে ভাইয়ের চরম অকল্যাণ হবে। অথচ এখন এই দুপুর ৩টে বেজে ৩২ মিনিটে তো তাঁর ভাই গোটা মাঠ এবং ভারতবর্ষকে স্পন্দিত করে নেমে পড়লেন। প্রতিটা মিনিটে মনে হচ্ছে বাজ পড়ছে মাঠে। টিভি ক্যামেরার আক্রমণ থেকে বাঁচতে অজিত এই টঙে উঠে এসেছেন। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন সচিনের ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু সমীর দিঘে এবং প্রশান্ত বৈদ্য-কে। একটু দূরে অতুল রাণাডে। সামনে সচিনের মেয়ে সারা। দু’টো গ্যালারি পরে প্রেসিডেন্ট’স বক্সে সচিনের স্ত্রী অঞ্জলি। ছেলে অর্জুন। শাশুড়ি। এবং জীবনে প্রথম মাঠে আসা হুইলচেয়ারে বসা তাঁর মা। প্রেসিডেন্ট’স বক্সে দ্বিতীয় একটা হুইলচেয়ারও আনা হয়েছে। সেটাতে বসে আছেন রমাকান্ত আচরেকর। ঠিক উল্টো দিকের টিভি বক্সে সৌরভ, রাহুল, লক্ষ্মণ, কুম্বলে। আরও একটা বক্সে ক্লাইভ লয়েড, শেন ওয়ার্ন। কী অসাধারণ একটা মহাভারতীয় সমাবেশ!
অর্জুন যেন তাঁর তিরন্দাজ জীবনকে আজই স্বেচ্ছায় সমাপ্ত করে দিচ্ছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের যা হালচাল, এক ইনিংসের বেশি পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। গাণ্ডীব সমর্পণ হয়তো আজই হয়ে যাবে। আর সেই সমর্পণের মুহূর্ত দেখতে হাজির বাকি পাণ্ডবেরা। হাজির কুন্তী, দ্রৌপদী, অভিমন্যু। হাজির কৌরবপক্ষও। ওয়ার্নরূপী কর্ণ। লয়েডরূপী কৃপাচার্য। সকলে। আজ শৌর্যের দিন। পৌরুষত্বের দিন। আবার বিষাদের দিন। চোখের জল অবাধ্য হওয়ার দিন! অর্জুনের বীরগাথাই যে চিরকালের মতো স্তব্ধ হয়ে যেন কর্ণের নিয়তি আহ্বান করছে! |
চেনা ছন্দে। বৃহস্পতিবার ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে। |
ব্র্যাডম্যানের শেষ ইনিংসে শূন্য সম্পর্কে এ রকম জোরদার চোখের জলের তত্ত্ব রয়েছে। ডন নাকি আবেগে এত আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলেন যে, চোখ ছলছল করে এসেছিল। ওভালের ব্যাটিং উইকেটেও হোলিসের বলটা ঠিকমতো দেখতে পাননি। ডন আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিলেন জনতার সংবর্ধনা আর ইংল্যান্ড অধিনায়কের টিমকে জড়ো করে তাঁকে গার্ড অব অনার দেওয়ায়। সচিন— সচিন কী করবেন? তাঁকে সকালে টিমমেটরা আবেগে ভিজিয়ে দিয়েছে ২০০ লেখা বিশেষ কাউন্টি ক্যাপ উপহার দিয়ে। হাডলে তাঁকে টিম টক দিতে দিয়েছে। আর ব্যাট করতে এসে শুধু তো ডারেন স্যামির দল নয়, দুই আম্পায়ারও একধারে দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান জানাচ্ছেন। বিশ্বের কোথাও কখনও আম্পায়াররা ব্যাটসম্যানকে গার্ড অব অনার দিয়েছেন? নাকি ভেবেছেন? তারই মধ্যে নতুন উপদ্রব— সচিনের পিছুপিছু টিভি ক্যামেরাম্যান। উইকেটের কাছাকাছি টিভি ক্যামেরার যাওয়া— এই সমস্ত খেলো ব্যাপার টি-টোয়েন্টিতে হয়। গম্ভীর টেস্ট ম্যাচে কী করে চার নম্বরে ব্যাট করতে যাওয়া মানুষের সঙ্গে ক্যামেরা ঢোকে? গাওস্কর হলে নির্ঘাত বার করে দিতেন। সচিন তাকালেনই না। হাতের ব্যাটটাও আজ নতুন। ওটা অ্যাডিডাস শেষ ম্যাচে ত্রিবর্ণরঞ্জিত করে দিয়েছে। চিরকালীন দেশপ্রেমিকের শেষটা যেন হয় জাতীয় পতাকায় রাঙিয়ে। সব মিলিয়ে কী অসম্ভব চাপ!
প্রথম দিনের খেলা শেষ হতে তখনও তেইশ ওভার। গ্যালারিতে অজিতের দিকে তাকিয়ে কেউ একটা বলল— “চিন্তা হয়ে গেল খুব, তেইশটা ওভার আজ কাটাতে হবে।” অজিতের মুখ ফ্যাকাশে। ভাবলেশহীন ভাবে তাকালেন। ধুকপুক তো করারই কথা। সেই শিলিংফোর্ড! সেই ইডেনের ফিল্ড প্লেসিং। ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ, সিলি পয়েন্ট আর লেগ স্লিপ। তা-ও আবার অফস্পিনার বল করছেন নাইজেল লং-এর প্রান্ত থেকে— ইডেনের সেই ঘাতক আম্পায়ার! এই সময় এত চিৎকার শুরু হল যা প্রত্যক্ষদর্শীর জীবনের শেষ দিন অবধি মনে রাখা উচিত। টেনিসে যখন নাদাল বা ফেডেরার গেম, সেট ও ম্যাচের জন্য সার্ভ করেন, তাঁদের মনঃসংযোগে নীরবতা পাওয়ার সুযোগ আছে। টেনিস এক বলের খেলা নয়। কিন্তু সেখানে, ব্যাডমিন্টনে, ভলিবলে বা টেবল টেনিসে কোথাও দর্শক-চিৎকারে প্রতিযোগীর মনঃসংযোগ নষ্টের সুযোগ নেই। ক্রিকেট এক বলের কঠিনতম টেকনিক্যাল স্পোর্ট। ভদ্রলোকের অভিজাত খেলা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সেখানে জীবনের শেষ ইনিংসেও এক চিলতে নীরবতার সুযোগ নেই। অন্তত ব্যাটসম্যানের আদ্যক্ষর যদি হয় এসআরটি।
বিসিসিআই থেকে সচিনের ওপর যাঁদের বিশেষ ফিল্ম তৈরি করতে বলা হয়েছিল, তাঁরা ক’দিন উত্তেজিত অনুযোগ করছিলেন, একটুও যদি সচিন আমাদের সময় না দেন, আমরা কী ডকুমেন্টারি তুলব? কলকাতায় ওর ঘরের বাইরে অতক্ষণ দাঁড়িয়ে ঘরেই ঢুকতে পারলাম না। বিষ্যুদবার বিকেলে মনে হচ্ছিল ছবির অখুশি পরিচালককে গ্যালারিতে খুঁজে বার করে বলি, ভাই, এখন যা ঘটছে সেটাই তুলে রাখো। এর চেয়ে ভাল ফিল্ম কোথাও দেখবে না। এই জিনিস ক্রিকেট মাঠে জীবনে কখনও ঘটেনি। আর ঘটবে বলেও মনে হয় না।
আবেগের এমন তীব্রতা যে, সঙ্গী ব্যাটসম্যান চেতেশ্বর পূজারা-কে মনশ্চক্ষে সবাই অদৃশ্যই করে দিয়েছে। যেন তিনি এক অপটিক্যাল ইলিউশন। আছেন— আসলে নেই। পূজারা ব্যাট করার সময়ও কি না তারা ‘স্যা-চি-ন স্যা-চি-ন’ করে আওয়াজ তুলছে। যেন উইকেটের দু’দিকেই সচিন ব্যাট করছেন। গ্যালারির উত্তর দিকে ঝুলছে পোস্টার, তাতে লেখা ‘লেজেন্ড’। ভিডিও স্ক্রিনে অনবরত ভেসে উঠছে টুইট এখন ঈশ্বর স্বয়ং ক্রিজে। কোনও টুইটে লেখা, আমার জীবনে ভগবান তিন জন। বাবা, মা আর সচিন। এমনকী দু’দিকের সাইটস্ক্রিনও সচিন নিয়ে সপ্রশংস। গোটা বৃত্তই যেন তাঁর ক্যাপটিভ অডিয়েন্স। আর তার মধ্যিখানে স্বয়ং তিনি।
দিভেচা আর গাড়ওয়াড়ে— দু’টো প্যাভিলিয়ন মিলে বসেছেন সচিনের শ’দুয়েক বন্ধু। একটা করে বল খেলছেন সচিন, আর তাঁদের নার্ভাসনেস বাড়ছে। বিশেষ করে অজিতের চোখমুখে ক্রমাগত জমছে উৎকণ্ঠা। এমন উইকেট বানিয়েছেন সুধীর নায়েক, যেখানে বাউন্স তো আছেই। এমন টার্ন আছে যে, তিনটে ক্যাচ ফেলেও ভারত বিপক্ষকে এত কম রানে নামিয়ে দিতে পেরেছে। শিলিংফোর্ড এক ইঞ্চিরও বেশি বল ঘোরাচ্ছেন দেখে প্রশান্ত বৈদ্য দেখলাম টেনশন কাটাতে মোবাইল নিয়ে ঘেঁটে যাচ্ছেন। সমীর দিঘে— ভারতের প্রাক্তন উইকেটকিপার পাশে বসা বন্ধুকে বলছেন, “সচিন কত লোকের জীবনে যে উপকার করেছে, কেউ খোঁজ রাখে না। আজ বিদায়বেলায় এইটুকু ওকে ঈশ্বর দেবেন না? অন্যায় হবে।” এ দিকে অজিত কার্যত মুখে হাত দিয়ে বসা। গ্যালারি চিৎকার ক্রমশ বাড়িয়ে যাচ্ছে। এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ আক্রমণ মুম্বইয়ের চলতি ভাষায় ‘পোপটওয়ারি’। মোস্ট ফালতু। পরিস্থিতি বিচারে সেটাই হয়ে যাচ্ছে লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ!
তখনও বোঝার উপায় নেই যে, সচিন বিরাশি মিনিট পরেও অক্ষত ৩৮ নিয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরতে পারবেন! তখনকার মতো বরং মনে হচ্ছিল, যে কোনও সময় আউট হলেন বলে। প্রথম সিঙ্গলসটা আসতেই তো অজিতের দিকে মুখ ঘুরিয়ে এক বন্ধু বললেন, যাক ডনের চেয়ে বেশি হল!
যে পরিমাণ চাপ দর্শক আর পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছিল, তাতে একমাত্র মৃত মানুষের পক্ষেই অবিচলিত থাকা সম্ভব! জীবিতের নয়। সচিন এই সময় ফ্রন্টফুটে একটা ফ্লিক আর দারুণ ব্যাকফুট পাঞ্চ করলেন। অজিতকে সাহস জোগাতে বললাম, “সৌরভ বলে থাকেন, যে দিন সচিন শুরু থেকে ফ্রন্টফুটে ঠিকঠাক আসে, সে দিন জানবেন ও বড় রান করবে।” কিন্তু বাক্যটাই শেষ করা গেল না। কারণ অজিত অন্য জগতে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন। বোঝা গেল কিছু শোনেননি। পাশ থেকে ওঁর বন্ধু সতর্ক করলেন, “খবরদার, কথা বলতে যাবেন না। সচিন ব্যাট করার সময় ও নিজের জোনে চলে যায়। কেউ ওকে বিরক্ত করে না।” সচিনের বন্ধুদের জন্য দুপুর থেকে জল, খাবারদাবার আর বিশেষ টি-শার্ট আসছিল নীচ থেকে। আপাতত সবাইকে বলে দেওয়া হল, এখন এ দিকটা একদম মাড়াবেন না। অজিতের দিকে ধেয়ে আসা অটোগ্রাফ শিকারিদের তীব্র ধমকে থামিয়ে দেওয়া হল।
আমরা যেখানে বসে খেলা দেখছি, তার ঠিক পেছনে চার্চগেট স্টেশন। লোকাল ট্রেনগুলো পরের পর যাচ্ছে। একটা করে শট খেলছেন সচিন আর গোটা মাঠে তার রেশ আছড়ে পড়া দেখে মনে হচ্ছে তিনিই যেন আধুনিক ভারতের আশা ও আকাঙ্ক্ষার শেষ স্টেশন! নইলে এই যা ঘটছে, কোন খেলায় কোন ক্রীড়াবিদকে ঘিরে তাঁর বিদায়বেলায় ঘটেছে! এ তো কলোসিয়ামে জীবনের মহানাটক! |
শ্রদ্ধা
জীবনের শেষ টেস্টে ব্যাট করতে নামছেন। ক্রিস গেইলদের গার্ড অফ অনার। |
এত চিৎকারের মধ্যে মানুষ কনসেনট্রেট করবে কী করে? আওয়াজই তো তাকে খেয়ে ফেলবে! সচিন এই সময় পা ঝাড়া দিয়ে বারবার উইকেটের দু’ধারে হাঁটতে শুরু করলেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু বললেন, জোন-এ যাচ্ছে আরও বেশি করে। শুনলাম একলা প্রতিদিন আধ ঘণ্টা করে এই ‘জোন’-এ যাওয়ার মানসিক ট্রেনিং রপ্ত করেছেন সচিন। অন্তত পাঁচ-সাত বছর ধরে ট্রেনিংটা নিয়মিত করে আসছেন। কৌশলটা হল, মনের অ্যান্টেনা এমন ভাবে অনুশীলনে-অনুশীলনে সেট করা থাকবে যে, সে বাইরের চিল-চিৎকারের সিগন্যাল রিসিভই করবে না। শুধুই বোলার আর বল দেখবে। নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে পারবে পারিপার্শ্বিক থেকে। এটা দু’টো কানকে ট্রেন করার কৌশল যে, ভারতে খেলা হলে ব্যাট করতে নামার সময়ই দ্রুত শাটার টেনে দেবে।
কিন্তু চোখ? চোখের ট্রেনিং কী ভাবে সম্ভব? সচিন যখন দিনের শেষ ওভার ব্যাট করছেন, গোটা তেন্ডুলকর পরিবার এবং বন্ধুরা আতঙ্কিত— শেষ ওভার বিষ বয়ে আনবে না তো! ঠিক এই সময় হোস্ট ব্রডকাস্টার ভিডিও স্ক্রিনে সচিনের মা-কে বারবার দেখানো শুরু করল। সুপারহিট সোপ অপেরাতেও এই সব দেখার সুযোগ নেই। বিদেশি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনতার মাঝে ছেলে ব্যাট করছে। চাদর জড়ানো মা সামনে বসে সেটা দেখছেন। ভিডিও স্ক্রিনে তাঁর ছবি সরছে না। যখন সরলো, তখন এল কোচ আচরেকরের মুখ। এর পর আমির খান, নীতা অম্বানীরা। গ্যালারিতে সচিনের বন্ধুরা প্রচণ্ড উত্তেজিত— এটা কী করছে স্টার স্পোর্টস? বেচারা মা-কে বারবার দেখলে তো আরও উইক হয়ে যাবে। তা-ও কি না দিনের শেষ ওভার! এটা কী হচ্ছে?
অজিতকে তাতানোর চেষ্টা হল। উত্তরে তিনি কিছুই বললেন না। নাকি শুনতেই পেলেন না! তেন্ডুলকর প্যাভিলিয়নে ফেরার সময় প্রথম তাঁর দাদার মুখে শব্দ শুনলাম, “যাক”। ওটা অবশ্যই তাঁদের গোটা পরিবারের সমবেত আশ্বস্ত কণ্ঠস্বর। যাক, কাল একটা স্বপ্নের সুযোগ থেকে গেল।
কোনও কোনও ক্রিকেটপ্রেমীর আবার হয়তো মনে হবে, নতুন করে স্বপ্ন কী দেখব? বিষ্যুদবারেরটাই তো দিবাস্বপ্ন ছিল! হতে পারেন ব্র্যাডম্যান তাঁর ৯৯.৯৪ নিয়ে তর্কাতীত ভাবে সর্বোত্তম। সচিন সেখানে ৫৩। অন্তত ব্যাটিং গড়ে তুলনাই হয় না। কিন্তু বিদায়বেলার যুদ্ধে তিনি পরিষ্কার হারিয়ে দিয়েছেন ডনকে! শুধু ৩৮ রানে এগিয়ে নেই। ইতিহাস বলবে, টিভি স্পনসরের বাণিজ্যিক অভিসন্ধি, সমর্থক হয়েও কার্যত বিরোধী দর্শক এবং কুতুবমিনারোচিত চাপের সঙ্গে শেষ ইনিংসে মোটেও ব্র্যাডম্যানকে যুঝতে হয়নি। সচিন যা সামলালেন, তার চেয়ে প্রাচীন যুগের অরক্ষিত উইকেটে হেলমেটহীন খেলা সহজ।
স্কোরবোর্ডে রানটা হয়তো মাত্র ৩৮ ব্যাটিং। কাল তিন অঙ্ক হবে কি না, বিন্দুমাত্র স্থিরতা নেই। কিন্তু রূপকথার তেন্ডুলকর সিরিজে ওয়াংখেড়ের বিরাশি মিনিট অবধারিত উঠে গেল। মরুঝড়, ওয়ার্ন-নিধন আর সেঞ্চুরিয়নের পাশে।
এটা যে নিছক ক্রিকেট-যুদ্ধ জেতা বা রানে সীমাবদ্ধ ছিল না। মানুষের নিজেকে অবিশ্বাস্য অতিক্রম করার সংগ্রাম ছিল। ঘটনাচক্রেই কেবল ক্রিকেট মাঠে ঘটল!
|
|
ছবি: উৎপল সরকার।
|
পুরনো খবর: নয়া প্রজন্ম নিয়ে চর্চা সরিয়ে আজ মুম্বইয়ে সচিন-উৎসব |
|
|
|
|
|