|
|
|
|
|
সকালের ‘মৃত্যুপুরী’ সাহিত্য
সহবাস
বিকেলে স্বপ্নলোক রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায় • মুম্বই |
|
বিকেল-বিকেল যদি আজ ‘সাহিত্য সহবাসে’ ঢুকতেন, মনে হত সাক্ষাৎ ‘মৃত্যুপুরী’!
সারি সারি উঁচু হলুদ রঙের বাড়িগুলোর মুখ কেমন যেন গম্ভীর। পার্কিং স্লটে গাড়ি নেই বললেই চলে, জানালার পর্দা সরিয়ে কোনও অত্যুৎসাহী কচিকাঁচার উঁকিঝুঁকিও নেই সামান্যতম। গেটের উল্টো দিকের সিগারেট-বিক্রেতা দিব্য দিবানিদ্রায় ঢুলছে, ক্লান্ত ট্যাক্সিচালকের পকেটের ট্রানজিস্টর একমনে বাজিয়ে চলেছে ক্রিকেট কমেন্ট্রি...।
সবাই গেল কোথায়?
কোথায় আবার, ওয়াংখেড়ে! একটু আগে ভারত নামল যে!
ভুল হল। ভারত নামল নয়, বলা ভাল, ভারত নামার সঙ্গে সঙ্গে সচিন রমেশ তেন্ডুলকরের বিদায়ী টেস্ট ব্যাটিংয়ের মুখবন্ধটাও তৈরি হল। কেউ কেউ বোধহয় তখনও পড়ে ছিল ছুটকো-ছাটকা। বছর পঁচিশের এক যুবককে দেখা গেল ঊর্ধ্বশ্বাসে গেট পেরিয়ে ঢুকতে, এবং তিন মিনিটের মাথায় পরিবার সমেত ধুলো উড়িয়ে বেরিয়ে যেতে। ওইটুকু সময়েই ড্রাইভারকে ধমক, উপস্থিত মিডিয়াকে দাঁতখিচুনি, ‘সি লিঙ্ক’ ধরলে সুবিধে হবে, না কি সোজা যাওয়া ভাল—দুর্বোধ্য মরাঠিতে যাবতীয় আলোচনা শেষ করে ‘উসেইন বোল্ট’-এর দৌড়! কমপ্লেক্সের কেয়ারটেকারের হৃষ্টচিত্ত গলাও শোনা গেল, ‘‘ব্যস। ফাঁকা। আর কেউ নেই।”
জীবনে কখনও কখনও এক বা দু’ঘণ্টায় মনুষ্যচরিত্রে কতটা পরিবর্তন ঘটে, সেটা বুঝতে হলেও বোধহয় আজ ‘সাহিত্য সহবাসে’ আসতে হত। বান্দ্রা কলানগরের হাউজিং কমপ্লেক্স যে কোনও ক্রিকেটপ্রেমীর কাছে বহু দিন ধরে ‘দেবালয়’, যে কমপ্লেক্স দেখেছে সচিন রমেশ তেন্ডুলকরের শৈশব, দেখেছে ক্রিকেট-ঈশ্বরের প্রথম সব কিছু। যে ফ্ল্যাটবাড়ির লাগোয়া শুনশান মাঠে আজও ঘোরে খুদে সচিনের ক্রিকেট নিয়ে পাগলামির গল্প, প্রতিবেশীদের জানালার কাচ টেনিস বল দিয়ে টুকরো-টুকরো করে দেওয়ার কাহিনি। তাই ঘণ্টাদু’য়েকের ব্যবধানে ওই একই মুখগুলো যখন টেনশনের দাঁতখিঁচুনির বদলে পরিতৃপ্তি নিয়ে ফেরে, সন্ধে ছ’টার বান্দ্রায় হাজির করে ফেলে ওয়াংখেড়ের এক টুকরো উৎসবকে, মোটেও আশ্চর্য লাগে না। একুশের তরুণ থেকে একষট্টির প্রৌঢ়, সবার মুখে প্রায় একই অভিব্যক্তি, প্রায় একই রকম কথাবার্তার মেজাজ:
‘ও কিন্তু দেখে খেলছে। সময় নিচ্ছে। মনে হচ্ছে একটা বড় আসছে।’
‘সেঞ্চুরি হবে? আটত্রিশ কিন্তু এখন। হাফসেঞ্চুরিটা বরং শিওর।’
‘আরে ছোড়ো। কাল ডাবল সেঞ্চুরি হোগা!’
সকালের ওয়াংখেড়েতেও ঠিক এই কথাগুলোই শোনা যাচ্ছিল না?
|
|
ছবি উৎপল সরকার। |
ফুটপাথের উপরেই ধূপ-ধুনো দিয়ে যজ্ঞের আয়োজন চলছে পুরোদমে। পুণের পুরোহিত চিৎকার করে বলে চলেছেন, “চব্বিশ বার সুন্দরখণ্ড পড়ব...কারণ এটা ক্রিকেটে সচিনের চব্বিশ বছর হল...আমার পুজো ব্যর্থ হয় না... দেখে নিও ডাবল সেঞ্চুরি মারবে...।” একটু দূরে সচিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাংবাদিক মিডিয়াকে বাইট দিয়ে চলছেন, “এটা দুঃখের সময় নয়। দেশের একশো কুড়ি কোটি পরিবারের আদরের ছেলেটা আজ শেষ খেলছে। আমরা পাঁচ দিন শুধু আনন্দ করব।” মুম্বইয়ের বিখ্যাত ডাব্বাওয়ালারাও আজ কোথা থেকে ওয়াংখেড়ের সামনে দলে দলে হাজির। ওরা টিকিট পায়নি, তবু বাইরে থেকে চেঁচাতে চায়। শোলেপুরের এক হোটেলের ওয়েটারকে পাওয়া গেল যিনি পকেটে স্রেফ তিন হাজার টাকা নিয়ে মুম্বই এসেছেন, যার মধ্যে আড়াই হাজার চলে গেল টিকিটে, সম্বল বলতে পড়ে থাকা পাঁচশো এবং সচিনের চব্বিশ বছরের ক্রিকেট কেরিয়ারের প্রত্যেকটা রানের স্ট্যাটসবুক, মহানায়কের চোদ্দো থেকে চল্লিশের দুর্লভ কিছু ছবি।
অবাক লাগছে?
‘সাহিত্য সহবাসে’র গল্পগুলোও কিন্তু সমান অবাক করার মতো।
শোনা গেল, নতুন ফ্ল্যাটে উঠে যাওয়ার পরেও সচিনের ‘সাহিত্য সহবাসে’ যাতায়াত কমেনি। অন্তিম লগ্নের আগে যখন তাঁর খারাপ ফর্ম বেশ দীর্ঘায়িত হচ্ছে, তখনও একবার এসেছিলেন সচিন। প্রতিবেশীদের কেউ কেউ জিজ্ঞেসও করেছিলেন, গাওস্করও এখন বিরুদ্ধে বলছেন, এ বার ছেড়ে দেবে নাকি? উত্তরে নাকি সচিন বলে দেন, ছাড়বেন। কিন্তু ব্যাড প্যাচ কাটিয়ে। স্বমহিমায় ফিরে। ‘সাহিত্য সহবাসের’ যে ফ্ল্যাটে এখন মাঝেমাঝে এসে থাকেন অজিত তেন্ডুলকর, তার ঠিক পাশের ফ্ল্যাটের পি ডি মুজুমদার বলছিলেন, “সচিন কিন্তু কথা রাখছে। সসম্মানে যাচ্ছে। লাহলি দেখুন। ওয়াংখেড়েটাও এখন পর্যন্ত ভাল যাচ্ছে। ইডেনে তো ফালতু আউট দিল।”
ভদ্রলোক প্রখ্যাত ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট। যাঁর বাড়িতে কিশোর তেন্ডুলকরের কাজ ছিল ভদ্রলোকের ছেলেকে টেনে মাঠে বার করে আনা। এনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বল পেটানো। এবং ইচ্ছেমতো ‘পাও ভাজি’ সংহারে আবার ঢুকে পড়া! সেই পুরনো বন্ধুর সঙ্গে এখনও শোনা গেল যোগাযোগ আছে, ফোনে প্রায়ই কথা হয়। বয়ঃসন্ধির পর বেশি আর আসা হত না, রমাকান্ত আচরেকরের কড়া ক্রিকেটীয় শাসন থেকে ছাড়া পেয়ে ফিরতে ফিরতে রাত ন’টা-সাড়ে ন’টা বেজে যেত। ধীরে ধীরে সেটাও বন্ধ। বহু বছর আগের কথা, এক সময় মহল্লার টেনিস বল ক্রিকেটের অধীশ্বর সচিন আজ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে চিরবিদায়ের মুখে। তবু পঁচিশ বছরের স্মৃতিতে আজও ধুলো জমেনি, অরবিন্দ বেনাগের মতো কেউ কেউ এখনও গড়গড়িয়ে বলে দিতে পারবেন, সাহিত্যিক রমেশ তেন্ডুলকরের ডানপিটে ছোট ছেলে কী ভাবে খেয়ালখুশি মতো শুয়ে থাকত তাঁর বাড়িতে। সারঙ্গ উকিরওয়ের মতো ‘সাহিত্য সহবাসে’র কোনও কোনও কলেজপড়ুয়া অক্লেশে বলে দিতে পারেন, তাঁর পছন্দের জীবিকা ক্রিকেট নয়, ইঞ্জিনিয়ারিং। কিন্তু সেখানেও অনুপ্রেরণা সচিন। মধ্যবিত্তের দুনিয়া থেকে জীবনের উচ্চবিত্ত পৃথিবীতে উত্তরণের উদাহরণ সাড়ে পাঁচ ফুট মরাঠির মতো আর ক’টা আছে?
কিন্তু উচ্চবিত্ত পৃথিবী থেকে জীবনের নিম্নবিত্ত দুনিয়ায় অবতরণের একটা কাহিনিও তো থেকে গেল। ‘সাহিত্য সহবাস’ থেকে মাত্র পনেরো মিনিট দূরে!
ভারতীয় ক্রিকেটের সংসারে যখন এসেছিলেন, লোকে সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গে তাঁরই বেশি মিল পেত। সচিনের সঙ্গে সাদৃশ্য পেত তাঁর বোলার-নিধনের। বৃহস্পতিবার থেকে তিনিও মুম্বইয়ে, তিনিও মাঠে সাদা জার্সিতে, তবে ওয়াংখেড়ে নয়, বান্দ্রা কুর্লা কমপ্লেক্সের মাঠে। সচিনের মতো বন্দিত হওয়া দূরে থাক, মাঠে উপস্থিত জনা পাঁচেক সাংবাদিক বরং উদ্যত মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে তাঁর রঞ্জি ম্যাচের প্রথম দিনের ব্যর্থতা নিয়ে। লোপ্পা একটা ক্যাচ ছাড়লেন যে!
তিনি— বীরেন্দ্র সহবাগ। ক্যাচ তো বটেই, বোর্ডের চুক্তিটাও বৃহস্পতিবার যাঁর হাতছাড়া হল! |
ওয়াংখেড়ের ৮২ মিনিট |
বেলা ৩-৩৩: মুরলী বিজয় আউট। ব্যাট করতে নামলেন সচিন।
৩-৪৩: শিলিংফোর্ডকে ডিপ ব্যাকওয়ার্ড স্কোয়ারলেগে সুইপ করে প্রথম রান।
৩-৫২: শিলিংফোর্ডকে কাট করে প্রথম বাউন্ডারি।
৩-৫৫: শিলিংফোর্ডকে কভার ড্রাইভ মেরে দ্বিতীয় বাউন্ডারি।
৩-৫৮: শ্যানন গ্যাব্রিয়েলকে কভার ড্রাইভ মেরে তৃতীয় বাউন্ডারি।
৪-০১: ওয়াংখেড়ে স্কোরবোর্ড দেখাচ্ছে, ‘ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট’।
৪-২০: পূজারার সঙ্গে তৃতীয় উইকেটে হাফ সেঞ্চুরি পার্টনারশিপ।
৪-২৪: মার্লন স্যামুয়েলসকে ফ্লিক করে চতুর্থ বাউন্ডারি।
৪-৩২: ব্যাকফুটে গিয়ে স্যামুয়েলসকে কভার দিয়ে পঞ্চম বাউন্ডারি।
৪-৪৩: স্যামিকে ভিন্টেজ অন ড্রাইভে ষষ্ঠ বাউন্ডারি।
৪-৪৯: টিনো বেস্টের বাউন্সার। ডাক করলেন সচিন।
৪-৫২: ওয়াংখেড়েতে বিশাল ব্যানার: ‘শান্ত থাকুন, ঈশ্বর খেলছেন’।
৪-৫৬: প্রথম দিনের খেলা শেষ।
সচিন ব্যাটিং ৩৮। |
বাইশ গজের বাইরে। সবিস্তার... |
|
|
|
|
|
|