‘হিরোগিরি’র নেশাতেই দাদাগিরি বাউন্সারদের
স্যান্ট্রো গাড়িকে টপকে পথ আটকে দাঁড়াল একটি বড় গাড়ি। তার দরজা খুলে ঝটিতি নেমে এলেন জনা চারেক যুবক। পরনে সাফারি স্যুট, পালোয়ানের মতো দশাসই চেহারা। অনেকটা সিনেমার মতোই।
স্যান্ট্রো গাড়িটির অপরাধ? কয়েক মুহূর্ত আগেই বড় গাড়িটিকে ওভারটেক করেছিল সেটি। হাত দেখিয়ে সরে যেতে বলেছিল। তাই তাকে পাল্টা ওভারটেক করে এ ভাবে পথ রোধ। ভাবখানা যেন, এত সাহস! আমরা পালোয়ানের দল যে গাড়িতে বসে রয়েছি, সেই গাড়িকে অমন হাত দেখিয়ে ওভারটেক করা!
স্যান্ট্রো-র সামনের সিটে এক মহিলা। অন্ধকারে দূর থেকে তাঁর মুখ ভাল করে দেখতে পেল না পালোয়ানের দল। ধেয়ে এল গাড়ির দিকে। ততক্ষণে স্যান্ট্রোর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে আরও কয়েকটি গাড়ি। সেগুলি থেকে খোলা রিভলভার হাতে নেমে পড়েছেন নিরাপত্তারক্ষীরা। তাঁদের পরনেও সাফারি স্যুট। কিন্তু বোঝা যায়, তাঁরা পুলিশের লোক। থতমত খেয়ে গেলেন বড় গাড়ি থেকে মস্তানের মতো নেমে আসা জনা চারেক পালোয়ান! এর মাঝেই স্যান্ট্রোর সামনের সিট থেকে মুখ বাড়িয়েছেন সেই মহিলা। তাঁর দিকে নজর পড়তেই এ বার পালোয়ানদের ঘেমে ওঠার পালা।
তিনি, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঘটনাস্থল: এ শহরেরই সন্ধ্যার রাজপথ।
বেশি দিনের পুরনো ঘটনা নয়। ওই চার পালোয়ানকে সেখানেই তিন-চারটি প্রশ্ন করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। জানা গিয়েছিল, এঁরা কোনও এক ব্যবসায়ীর পোষ্য ‘বাউন্সার’। সেই ব্যবসায়ীর দেহরক্ষার কাজে নিযুক্ত। ইদানীং এই পেশার লোকেদের প্রায়ই দেখা যাচ্ছে ভিআইপি নিরাপত্তায়, অনুষ্ঠান-মঞ্চের সামনে, নৈশ ক্লাবে। অভিযোগ আসছে, এঁরা কখনও এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে ভীতি প্রদর্শন করছেন। কখনও ক্ষমতা প্রদর্শনের চেষ্টা করছেন। কখনও বা জমি-বাড়ি দখল নেওয়ার মতো কাজে সাহায্য করছেন ব্যবসায়ীদের।
অঙ্কন: সুমন চৌধুরী।
এক সময়ে এই পেশার লোকেদের দিয়েই ঋণ শোধ করতে না পারা গৃহস্থকে ভয় দেখানোর কাজ করত কিছু আর্থিক সংস্থা। ঋণ নিয়ে গাড়ি কেনার পরে সময় মতো ঋণ শোধ করতে না পারলে এ রকম চেহারার লোকেরাই এসে বাড়ির সামনে থেকে গাড়ি তুলে নিয়ে চলে যেতেন। আদালতের নির্দেশে যা আপাতত বন্ধ।
কিন্তু, এক্তিয়ার-বহির্ভূত কাজ যে বন্ধ হয়নি, তার টাটকা প্রমাণ শর্ট স্ট্রিটে সোমবারের ঘটনা। পাঁচিল টপকে সেই বাড়ির দখল নিতে পাঠানো হয়েছিল মুশ্কো চেহারার এই বাউন্সারদেরই। যার ফল হল মারাত্মক। সেখানে রুখে দাঁড়ালেন এক মহিলা। গুলি চলল। অচিরে মুছে গেল দুই যুবকের প্রাণ। তাঁরা বাউন্সারই ছিলেন।
কেমন হয় এই বাউন্সারদের জীবন? সত্যিই কি নিরাপত্তার কাজ করতে করতে তাঁরা নিজেদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ভেবে বসেন?
একবালপুরের ইন্তেখাব আলম গত প্রায় ১০ বছর ধরে বাউন্সারের কাজ করছেন। আগে ছিলেন একটি পানশালায়। মদ্যপানের পরে ‘অভব্য’ আচরণ করা পানাসক্তকে অর্ধচন্দ্র দেখানো ছিল তাঁর কাজ। ইদানীং তিনি সেলিব্রিটি-বাউন্সার। শাহরুখ খান কলকাতায় এলে তাঁর ডাক পড়ে।
৩০ বছর বয়স তাঁর। নিয়মিত শরীরচর্চা চালিয়ে যেতে হয়। দিনে সাধারণ মেনুর সঙ্গেই বেশ কয়েকটি কলা ও এক লিটার দুধ নিয়মিত খান। মদ বা সিগারেট ছোঁন না। অন্য কোনও নেশা নেই। পানশালায় কাজ করার সময়ে বেতন ও বখশিস মিলিয়ে মাসে প্রায় দশ হাজার টাকা রোজগার হত। এখন দিনে এক হাজার টাকা পান। তা-ও চার ঘণ্টা কাজ করার জন্য। মাঝেমধ্যে জামাইবাবুর ব্যবসার কাজে হংকং-ও যাতায়াত করেন।
কী ভাবে এলেন এই পেশায়? ইন্তেখাব বলেন, “ছোট থেকেই জিম করতাম। প্রতিযোগিতায় নামতাম। পাড়ার একটি ছেলে বলল পানশালায় চাকরি করার কথা। তখন আমার বয়স ২০ বছর। চার বছর সেই চাকরি করি।” তার পরে কলকাতায় এক বলিউডি ছবির শুটিং-এর সময়ে খোঁজ পড়েছিল তাঁর। এখন ভিআইপি-দের নিরাপত্তার ডিউটি ছাড়া কাজ করেন না তিনি।
এই কাজ করতে গিয়ে কি নিজেকে হিরো মনে হতে শুরু করে? বন্ধুদের কাছে কি মেলে আলাদা সম্ভ্রম? রাস্তাঘাটে ছোটখাটো গণ্ডগোলে গিয়ে দাঁড়ালে ভিড় হাল্কা হয়ে যায়?
ইন্তেখাব মানতে চাননি এ কথা। তাঁর দাবি, উল্টে গণ্ডগোল এড়িয়ে চলেন তাঁরা। একেবারেই ঝুট-ঝামেলায় জড়াতে চান না। তাতে শরীরের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। তবে, বন্ধু মহলে সম্ভ্রমের কথা স্বীকার করে নেন তিনি।
ইন্তেখাবের বক্তব্য যদি সমস্ত বাউন্সারের ক্ষেত্রে সত্যি হয়, তা হলে সন্ধ্যার রাজপথে মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি আটকানোর ঘটনা ঘটত না। বাউন্সারদের বিরুদ্ধে অযথা হেনস্থার অভিযোগও আসত না। অভিযোগ, কাঁচা বয়সে রাস্তাঘাটে, বন্ধু মহলে সম্ভ্রম এবং বড়সড় নিরাপত্তার দায়িত্ব পাওয়া এই যুবকের দল মাঝেমধ্যেই বেরিয়ে আসছেন খোলস ছেড়ে। হয়ে উঠছেন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।

পুরনো খবর:
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.