সকালে ঘাম ঝরিয়ে জিমনাসিয়ামে শরীরচর্চা। সন্ধ্যায় ডাক আসে ‘বাউন্সার’-এর কাজের জন্য।
বেসরকারি সংস্থা থেকে নেওয়া ঋণ ঠিক সময়ে কেউ শোধ করতে না পারলে এক সময়ে এঁদের ডাক পড়ত। আদালতের ধমক খেয়ে তা বন্ধ। কিন্তু এখনও বিভিন্ন উচ্চ মার্গের অনুষ্ঠান, সেলিব্রিটিদের নিরাপত্তায়, নাইট ক্লাবে এঁদের দেখা পাওয়া যায়। ‘বাউন্সার’ মানেই পেটানো চেহারা। চওড়া বুকের পাটা। তাঁরা সামনে এসে দাঁড়ালে প্রতিদ্বন্দ্বী ধাক্কা খেয়ে (বাউন্স করে) পিছিয়ে যাবেন।
কাজ এক কথায়, ভয় দেখানো। কিন্তু বেশ কিছু ক্ষেত্রে এই পালোয়ানদের বিরুদ্ধে রীতিমতো গুণ্ডামির অভিযোগও উঠেছে। নিরাপত্তা সংস্থা গ্রুপ ফোর-এর এক উচ্চপদস্থ কর্তার কথায়, “প্রত্যেক কর্মীকে নেওয়ার আগে তাঁর সম্পর্কে পুলিশের কাছ থেকে যাচাই করে নিতে হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই বাউন্সারদের জন্য তা নেওয়া হয় না, এঁরা অস্থায়ী হিসেবে কাজ করেন।” ওই কর্তার অভিযোগ, বেশির ভাগ সংস্থাই বাউন্সার রাখতে পারে না। কারণ তাঁদের পিছনে খরচও বেশি। তাই অস্থায়ী ভাবে বাউন্সারদের নিয়োগ করা হয়। কোনও সংস্থার সঙ্গে চুক্তি হলে তবেই তুলে আনা হয় এই পালোয়ানদের।
পুলিশ সূত্রের খবর, এঁদের জন্য বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থায় রেডিমেড কালো সাফারি স্যুট তৈরি করাই থাকে। কোনও এক সংস্থার প্রয়োজন হলেই চড়া দামে সেই বাউন্সার বা পালোয়ান ভাড়া দেওয়া হয়। স্থানীয় আখড়া বা জিমনাসিয়াম থেকেই প্রধানত পালোয়ানদের পাওয়া যায়। এক-এক সন্ধ্যার জন্য এঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয় ৫০০ টাকা পর্যন্ত!
তবে লালবাজার সূত্রের খবর, শহর জুড়ে এখন যে সব নিরাপত্তা সংস্থা গজিয়ে উঠেছে, তাদের বেশির ভাগেরই লাইসেন্স নেই। পুলিশের এক কর্তা জানান, ২০০৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ‘প্রাইভেট সিকিউরিটি এজেন্সি রেগুলেশন অ্যাক্ট’ তৈরি করে। তা এই রাজ্যেও কার্যকর হয়েছে। তবে তিনি বলেন, “লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিটি নিরাপত্তা সংস্থাকে ওই আইন মেনে চলতে হয়। কিন্তু বহু নিরাপত্তা সংস্থারই লাইসেন্স নেই। তাদের এই আইন মানার বাধ্যবাধকতা নেই।”
সোমবার ভোরে কলকাতার শর্ট স্ট্রিটের একটি বাড়ির পাঁচিল টপকে যে ক’জন নিরাপত্তারক্ষী ভিতরে ঢুকেছিলেন, তাঁরা ‘অ্যাক্টিভ গ্রুপ’ নামে একটি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। কলকাতা পুলিশের ডিসি (দক্ষিণ) মুরলীধর শর্মা বলেন, “এই সংস্থাটির সম্পর্কে আমরা বিশদে খোঁজ নিচ্ছি।” লালবাজার সূত্রে বলা হয়েছে, লাইসেন্সপ্রাপ্ত যে ক’টি নিরাপত্তা সংস্থার নাম কলকাতা পুলিশের ওয়েবসাইটে রয়েছে, তার মধ্যে ওই সংস্থার নাম নেই। তবে অ্যাক্টিভ গ্রুপের কর্ণধার অরূপ দেবনাথের দাবি, “আমার সংস্থা দু’বছরের পুরনো। লাইসেন্সও রয়েছে।” কিন্তু পুলিশের ওয়েবসাইটে থাকা তালিকায় তাঁর সংস্থার নাম নেই কেন? অরূপবাবু বলেন, “পুলিশ আমার কাছে জানতে চায়নি, তাই।”
শহরের অন্য এক নিরাপত্তা সংস্থা ‘এনআইএস’-এর কর্ণধার দেবজিৎ চৌধুরী জানান, চাহিদা বাড়ার জন্য তাঁরা নিয়মিত পালোয়ান রাখেন। তাঁর কথায়, “বাউন্সার বলে কিছু হয় না। সবাই নিরাপত্তারক্ষী। তবে, শরীরচর্চা করে কারও বড়সড় চেহারা হয়। তাঁদের পিছনে খরচ যত বেশি, তেমনই তাঁদের ভাড়াও বেশি।” দেবজিৎবাবুদের নিজস্ব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। সেখানেই প্রশিক্ষণ হয়। শর্ট স্ট্রিটের ঘটনা প্রসঙ্গে দেবজিৎবাবুর প্রতিক্রিয়া, কোনও সম্পত্তি বা ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্য কেন্দ্রীয় আইন মেনে নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন করা হয়। অন্য কারও এলাকায় ঢুকে তাকে বিতাড়নের জন্য নয়। তাঁর কথায়, “অনেক রকম অনুরোধ আসে। বিতর্কিত জমির নিরাপত্তার জন্যও রক্ষী চাওয়া হয়। কিন্তু, সেখানে গিয়ে ভিতর থেকে কাউকে বার করে দিতে বললে আমরা পাল্টা বলি, ‘আমরা বাইরে থেকে কাউকে ঢুকতে দেব না। কিন্তু, ভিতর থেকে বার করার দায়িত্ব আমার নয়।”
ফলে, শর্ট স্ট্রিটে যে ভাবে পাঁচিল টপকে নিরাপত্তারক্ষীরা ভিতরে ঢুকেছে, তা কোনও ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন দেবজিৎবাবু এবং গ্রুপ ফোরের ওই কর্তা। এটা কোনও ভাবেই কোনও বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষীর এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না বলে তাঁরা জানিয়েছেন। অনেক সময়ে এই রক্ষীরা নিজেদের সীমা পার হয়ে যান বলে মনে করছে পুলিশের একাংশ। সম্প্রতি কলকাতার ক্যামাক স্ট্রিটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটার ক্রিস গেইলের অনুষ্ঠানেও বাউন্সারেরা সাংবাদিকদের হেনস্থা করেছিল বলে অভিযোগ। সোমবার সকালে শর্ট স্ট্রিটের ওই বাড়িতেও এক্তিয়ার বহির্ভূত ভাবে ঢোকার অপরাধে পুলিশ একটি নিরাপত্তা সংস্থার ৯ জন বাউন্সারকে গ্রেফতার করে একটি মামলাও শুরু করেছে।
পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, এক সপ্তাহ আগেই এ ভাবে ওই বাড়িতে চড়াও হওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সে বার তা ভেস্তে যায়। সোমবারের এই ‘অপারেশন’-এর আগে রবিবার ওই সংস্থার কয়েক জন শর্ট স্ট্রিট ঘুরে যান। যে ভাবে প্রধানমন্ত্রীর মতো ভিআইপি আসার আগে এলাকা ঘুরে যান পুলিশকর্তারা, সে ভাবেই ঘটনাস্থল ‘রেকি’ করেন ওই সংস্থার পালোয়ানেরা। সংস্থার পক্ষে অরূপ দেবনাথ বলেন, “দখল নেওয়ার জন্য আমার নিরাপত্তারক্ষীদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা জানতাম না। জানলে কর্মীদের পাঠাতাম না।” |