রবিবার রাতের অতিরিক্ত ডিউটি করতে ইচ্ছুক ছিলেন না কেউ-ই। কিন্তু না গেলে চাকরি বাঁচবে না। তাই বাধ্য হয়েই শেষ পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। শর্ট স্ট্রিট ওঁদের দু’জনেরই প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।
ব্যারাকপুরের প্রসেনজিৎ দে এবং গয়েশপুরের পিকলু আচার্য। খেলাধুলো করা পেটানো চেহারা। আর্থিক অনটনে ডুবে থাকা পরিবারে একটু স্বাচ্ছন্দ্য আনতেই বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মীর কাজে যোগ দিয়েছিলেন দু’জনে। বিভিন্ন এজেন্সিতে মাসিক চুক্তির ভিত্তিতে কাজ। হাজার পাঁচেক টাকা মাইনের পাশাপাশি জুটত উপরি কাজের বরাতও। ঘটনাচক্রে সোনারপুরের যে এজেন্সি থেকে দু’জনে রবিবার কাজে গিয়েছিলেন, ওই এজেন্সিতে এটাই ওঁদের প্রথম কাজ। এজেন্সির মালিক অরূপ দেবনাথ অন্তত এমনটাই দাবি করছেন।
বাবার ছোট্ট মুদি দোকান। হৃদরোগে আক্রান্ত মা। চিকিৎসার খরচও অনেক। ব্যারাকপুর রায়বাগানের বাসিন্দা প্রসেনজিৎকে (২৪) তাই রোজগার শুরু করতে হয়েছিল স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েই। বেলঘরিয়ার ভৈরব গাঙ্গুলি কলেজের ছাত্রটির তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল আগামী বছর। নিজের পড়াশোনার খরচ শুধু নয়, সংসারের জোয়ালটাও নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছিলেন প্রসেনজিৎ। ছোট ভাই প্রণবের পড়ার খরচও তিনিই জোগাতেন। স্বপ্ন দেখতেন, পড়াশোনা শেষ করে সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন।
ছেলে এই মুহূর্তে ঠিক কী কাজ করে, সেটা অবশ্য জানতেন না প্রসেনজিতের বাবা প্রদীপবাবু। মা গোপাদেবী আর পাড়ার বন্ধুদের কাছে প্রসেনজিৎ বলেছিলেন, বাউন্সারের চাকরি। কলকাতার একটি পাঁচতারা হোটেলে সেলিব্রিটিদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকতে হয় তাঁকে। কাজের কোনও বাঁধাধরা সময় নেই। বন্ধুদের কাছেই গল্প করেছিলেন, সম্প্রতি প্রিয়ঙ্কা চোপড়া কলকাতায় এলে তাঁর বাউন্সারের দায়িত্ব সামলাতে হয়েছিল।
প্রসেনজিতের বন্ধু চিরঞ্জীব সরকার সোমবার বলেন, ‘‘রবিবার বিকেলে আমরা বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তখন ওর এক সহকর্মীর ফোন এল। ওকে ডাকছিল। ও প্রথমে যেতে চাইছিল না। বলছিল, ছুটির দিনে যেতে ইচ্ছে করছে না।” কিন্তু না গেলে নতুন চাকরি নিয়ে টানাটানি হতে পারে। তাই শেষ পর্যন্ত বেরিয়েই পড়েন প্রসেনজিৎ। চিরঞ্জীব বলেন, “সোমবার সকালে খবর পেলাম, শর্ট স্ট্রিটে গুলিতে ও মারা গিয়েছে।”
রুগ্ণ মায়ের কাছে খবরটা চেপে রাখার জন্য এ দিন সকাল থেকে প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়েছেন আত্মীয়-পরিজনেরা। বাড়ির টিভিটা বন্ধ করে রাখা হয়। প্রসেনজিতের ছোট ভাই ক্ষেত্রমোহন স্কুলের একাদশ শ্রেণির ছাত্র, প্রণব কার্যত পালিয়ে বেড়িয়েছে মায়ের কাছ থেকে। কিন্তু মায়ের মন ঠিকই বিপদের আঁচ পেয়েছে। গোপাদেবী সামনে পেলেই বারবার প্রশ্ন করেছেন, ‘‘তোর দাদা বেঁচে আছে তো?’’ বিকেলের পর আর তাঁর চেপে রাখা যায়নি খবরটা।
কল্যাণীর গয়েশপুরের পিকলু আচার্যের (২২) বাড়িতেও একই ছবি। ছোট ভাই পিন্টু কলেজে পড়ে। বাবা প্রিয়লাল আচার্য একটি বেসরকারি সংস্থায় সামান্য বেতনে কাজ করেন। বাবার একার আয়ে সংসার চলে না বলে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পরে আর লেখাপড়া করা হয়নি পিকলুর। এখানে ওখানে ছোটখাটো কাজ করার পর সোনারপুরের এই নিরাপত্তা সংস্থায় মাসে হাজার পাঁচেক টাকা বেতনের কাজটি জুটেছিল দিন পনেরো আগে। কাঁদতে কাঁদতে মা ডলিদেবী জানান, রবিবার বিকেলে সংস্থা থেকে ফোন এসেছিল। পিকলু প্রথমে যেতে চাননি। “তার পর সন্ধ্যা ছ’টায় বাড়ি থেকে বেরলো। বলল, বারবার ডাকছে। বলছে জরুরি দরকার। সকালেই ফিরব।’’ প্রসেনজিৎরা ফিরবেন না, এমনটা দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি সংস্থার মালিক অরূপবাবুও। বারবার খালি বলছেন, “আমাকে বলা হয়েছিল, সম্পত্তি পাহারা দেওয়ার কাজ! এমন জানলে আমার ছেলেগুলোকে কখনও পাঠাতাম না!” |