পার্ক স্ট্রিট-কামদুনি-মধ্যমগ্রাম...
রাজ্যের জেলায় জেলায় তো বটেই, খোদ কলকাতা শহরে দিনদিন বাড়ছে যৌন হেনস্থার ঘটনা। পরিসংখ্যান বলছে, গত দু’মাসে এ শহরে ৪৮টি ধর্ষণ-শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিগ্রহের শিকার হচ্ছে কমবয়সি মেয়েরা। আত্মরক্ষার পাঠ দিতে এ বার এগিয়ে এসেছে ইন্ডিয়ান ক্যারাটে অ্যাসোসিয়েশন। নিখরচায় মহিলাদের ক্যারাটে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে তারা। তাদের একাধিক শিবিরে মেয়েরা ভিড় করে আসছেন, চোখে পড়ার মতো উপস্থিতি থাকছে সংখ্যালঘু পরিবারের মেয়ে-বউদেরও।
১৯৮৮ সালে ক্যারাটেতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন এম এ আলি। কলকাতার নামী ক্যারাটে প্রশিক্ষক হিসেবে পরিচিত তিনি। চারপাশের পরিস্থিতি দেখে আলি সাহেব এখন এগিয়ে এসেছেন নিখরচয়া মেয়েদের ক্যারাটে শেখাতে। রাজাবাজার লেডিজ পার্কে শুরু হয়েছে ক্লাস। সানা পরভিন-তানিয়া খান-জেবা তবসুম-নুসরত বানো-ফারহানা বেগমদের মতো সংখ্যালঘু পরিবারের মেয়েরাও ভিড় জমাচ্ছেন আত্মরক্ষার পাঠ নিতে। ফারহানা বেগম বলছেন, “বেশ কয়েক বার টিটকিরি-বিদ্রুপ-হেনস্থার শিকার হয়েছি। প্রতিবাদ-প্রতিরোধের উপায় খুঁজছিলাম। ফ্রি কোচিং-এর খবর পেয়ে সব বাধা ঠেলে চলে এসেছি।” রক্ষণশীল পরিবার। সেখান থেকে এই সাহস দেখানোটা সহজ ছিল না। কিন্তু ফারহানা সেটা করে দেখিয়েছেন। “এখন মন দিয়ে শিখছি কী করে নিজেকে এবং অন্য বিপন্ন মেয়েদের রক্ষা করা যায়। আত্মবিশ্বাস বহু গুণ বেড়ে গিয়েছে।”
বছর পনেরোর নুসরত যেমন। বাবা হোটেলে সামান্য চাকরি করেন। সাত ভাই-বোন। অনটনের সংসার। অর্থাভাবে লেখাপড়া বন্ধ করতে হয়েছে। “নিজেকে খুব অসহায় মনে হত। ফ্রি কোচিং-এর খবর পেয়ে চলে এলাম। এখন আত্মরক্ষার উপায় শিখছি। আমি ব্ল্যাক বেল্ট চ্যম্পিয়ন হবই। আয়েষার মতো।” |
আয়েষা কে? পাশেই দাঁড়িয়েছিল পিতৃহারা ষোড়শী কিশোরী, আয়েষা নুর। মা বাড়ি-বাড়ি কাজ করে সংসার চালান। পুজোর আগে ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্রের সহযোগিতায় ব্যাঙ্কক গিয়ে বিশ্ব প্রতিযোগিতার আসরে সোনা জিতে এসেছে এই আয়েষাই। এলাকার বাকি মেয়েদের কাছে সে এখন দৃষ্টান্ত।
তাকে দেখেই নানা বয়সের ৫০টি মেয়ে আলি সাহেবের কাছে ভিড় জমিয়েছেন। মাথার কালো স্কার্ফ ঠিক করতে করতে হাত-পা চালাতে শিখছেন। মাঠের বাইরে পড়ন্ত বিকেলে তাদের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখছেন বোরখায় মুখ ঢাকা মায়েরা।
খবরটা শুনে উচ্ছ্বসিত অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। ‘দহন’ ছবির নায়িকা বলছেন, “সাবাস! আলি সাহেবের মতো মানুষ তা হলে আমার শহরে আছেন! গর্ব হচ্ছে। আরও হাজার হাজার মেয়ে আত্মরক্ষার কৌশল শিখতে এগিয়ে আসুক, আর একটি মেয়েও যেন লাঞ্ছিত না হয়।”
মেয়েরাও ঠিক তাই বলছেন। ওঁদের চোখ জ্বলজ্বল করছে আর পড়ে পড়ে মার খাওয়া নয়। আন্দুলের রথতলা ভট্টাচার্য বাড়ির মেয়ে চিত্রা বলছেন, “আর কেউ কোনও দিন আমাকে পিটিয়ে-পুড়িয়ে মারার কথা ভাবতেও পারবে না। শ্বশুর বাড়ির লোক আমার সামনে আমার বাবাকে পেটাতে পারবে না। মেরে তাদের হাত-পা ভেঙে দেব।” বৈঠকখানা রোডের চট্টোপাধ্যায় বাড়ির বউ মিতালি। “মারধর করে তাড়িয়ে দিয়ে বাড়ির দখল নিয়েছে আত্মীয়রা। আর মাস ছ’য়েক। তার পর তিন জনকে একাই সামলে নেব।”
শুধু কলকাতা নয়। শুধু আলি সাহেবও নন। হাওড়ার টিকিয়াপাড়া ডন বস্কো আশালায়ুম-এর প্রাঙ্গণে ছাত্রছাত্রীদের ক্যারাটে শেখাচ্ছেন বালিটিকুরির মেঘনাদ পল্লি। সেখানে যোগ দিয়েছে ফুটপাথবাসী ছোট্ট মেয়েরাও! মগরাহাট কলেজ মাঠে বিনামূল্যে ক্যারাটে শেখাচ্ছেন রফিউল আজম সর্দার। অর্জুনপুরের রফিউল বলছেন, “আমাদের বাড়ির মেয়ে-বউরা খোলা মাঠে ক্যারাটে শিখছেন, এটা কয়েক মাস আগেও ভাবা যেত না। আজ মহিলারা বুঝছেন, প্রয়োজনে পাল্টা মারার কায়দাটাও শেখা কত জরুরি।”
ইন্ডিয়ান ক্যারাটে অ্যাসোসিয়েশন-এর উৎসাহে-উদ্যোগে শহরতলিতেও এ ভাবেই ছড়িয়ে পড়ছে ক্যারটে ক্লাস। সাহিত্যক সুচিত্রা ভট্টাচার্য সাধুবাদ জানিয়ে বলছেন, “এমন ক্যারাটে কোচিং কেন্দ্র প্রতিটা জেলায়, জেলা সদরে খুলতে হবে। কয়েকশো আলি সায়েবের আজ বড় প্রয়োজন।”
আলি সাহেব কিন্তু তৈরি। বলছেন, “যে যেখানে ডাকবেন, আমি বিনা পয়সায় ক্যারাটে শেখাব।” |